আলেমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক


রাজনীতির বাইরে বঙ্গবন্ধুর অন্য জীবন ছিল। বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। আলেম-উলামা থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। অনেকেই হয়তো অবগত নয় যে বঙ্গবন্ধু আলেম-উলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী ওলামা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ ও একান্ত ইচ্ছায় ১৯৬৬ সালে মাওলানা অলিউর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী ওলামা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক্ত কোনো কোনো আলেম ছয় দফাকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা দেন। সেই সময় মাওলানা অলিউর রহমান ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ছয় দফা’ নামক একটি বই লিখে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার কোনো দাবিই যে ইসলামী শরিয়াবিরোধী নয়, তা প্রমাণ করেন। তাঁর এই ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ বইটি সেই সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে ১৯৬৬ সালে মাওলানা অলিউর রহমানের ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ বইটি প্রত্যেক আওয়ামী লীগ কর্মীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাওলানা অলিউর রহমানই ১৯৬৬ সালেই বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে বিপুল আলেম-ওলামা নিয়ে ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। সেই সূত্রে ২৫ মার্চ কালরাতে এই আলেম বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তিনি মাওলানা হওয়ার পাশাপাশি একজন সুনামখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারও ছিলেন। ‘আরোগ্য কুটির’ নামে ঢাকার কেরানীগঞ্জে এই আলেম বুদ্ধিজীবীর একটি চিকিৎসালয় ছিল। (আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান : জীবন ও সাহিত্য)

বঙ্গবন্ধুর আধ্যাত্মিক সূত্রে দাদা ছিলেন সদর সাহেব হুজুরখ্যাত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)। তিনি যখন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম, তখন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রাজনীতিতে তরুণ নেতা। তিনি ছিলেন সদর সাহেব হুজুরের একান্ত ভক্ত। সপ্তাহে কয়েকবার দাদাকে দেখতে তিনি লালবাগে যেতেন। ফলে ফরিদপুরী হুজুরের সমসাময়িক অনেক আলেমকে তিনি দাদাজি বলে সম্বোধন করতেন। তাঁদের সঙ্গে সুগভীর এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। সে ইতিহাস কেউ লেখেন না। মাওলানাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এই প্রেমময় ভালোবাসা আড়ালেই রয়ে গেছে। মাওলানা আতাউর রহমান খান (কিশোরগঞ্জের সাবেক এমপি) তাঁর এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘আমাদের গাড়ি ইত্তেফাক অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার বাদে আমরা সবাই শায়েখদ্বয়ের (মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ও মাওলানা আতাহার আলী) পেছনে পেছনে গেলাম। তাঁরা খুঁঁজছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে। মুজিবুর রহমান সাহেব তখন বড় কোনো নেতা ছিলেন না। তবে ছাত্রনেতা হিসেবে ও জাতীয় নেতাদের কাছে যাতায়াত করতেন বলে অনেক কিছুই করতে পারতেন। আমরা অফিসের অনেক পেছনের এক রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, কয়েকজন লোক গল্পগুজবে মত্ত। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই শেখ মুজিব সাহেব চেয়ার ছেড়ে হন্তদন্ত অবস্থায় এগিয়ে এলেন। আর বিস্মিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, আরে, দাদা এখানে! হুজুর আপনি? দাদা এখানে কোনো খবর না দিয়েই সরাসরি উপস্থিত। কোনো দরকার হলে আমাকে একটু খবর দিলেই তো আমি উপস্থিত হতাম। আতাহার আলী সাহেব বললেন, আরে না না, খবর দেওয়ার হলে তোমাকে খবরই দিতাম। এখানেই প্রয়োজন। এরপর শেখ সাহেব তাঁর অন্য বন্ধুবান্ধবদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সদর সাহেব ও আতাহার আলী সাহেবকে বসালেন। ’ (হজরত ফরিদপুরী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) স্মারকগ্রন্থ, ১৯৯৯)

মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন একজন আজীবন সংগ্রামী মানুষ। তর্কবাগীশ ১৯৫৬-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা ১০ বছর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুগ্ম সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তর্কবাগীশের সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমানের মানস গঠনে তর্কবাগীশের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। দুজনের জীবনের নানা স্মৃতির কথা কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে ইতিহাসের পরতে পরতে।

একটি স্মৃতিকথা নিচে তুলে ধরছেন মুজতবা আহমেদ মুরশেদ। এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। উনি আমাকে আগে থেকেই চেনেন। আমাদের দিনাজপুরের বাসায় দেখা হয়েছে। মাওলানা তর্কবাগীশ আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বললাম। আব্বা আমাকে বললেন, উনি তোমার মাওলানা তর্কবাগীশ চাচা। ’ এর পর সেই ৩৬ মাইলের বর্ণনা দেন মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, ‘ঠাকুরগাঁ থেকে ৩৬ মাইল পথ ভেঙে গাড়ি ছুটছে। চলন্ত গাড়িতে বঙ্গবন্ধু, আব্বা, মাওলানা তর্কবাগীশ মাঝে মাঝেই নির্বাচন বিষয়ে কিছু কিছু কথা বিনিময় করছেন। এমন সময় হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে মাওলানা তর্কবাগীশ আমাকে প্রশ্ন করলেন, বড় হয়ে কী হতে চাও? এক মুহূর্তে আমার হয়ে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, ও তর্কবাগীশ হবে। ’ আমি বাদে তাঁরা একসঙ্গে হো হো করে দিলখোলা হাসি হেসে নিলেন। তর্কবাগীশ বললেন, মুজিব, তুমি সবাইকে তর্কবাগীশ বানিয়ে দেবে নাকি। আব্বাকে বললেন, সে নিজেও তর্কবাগীশ হতে চায়। মাওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুর টোকাটুকু উপভোগ করেছেন। ’ (মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩৬ মাইল, চ্যানেল আই, ১৫ আগস্ট, ২০১৫)

বঙ্গবন্ধু ইসলামের প্রতি কত অনুরাগী ছিলেন, তা কারি মোহাম্মদ ইসহাক সাহেবের স্মৃতিচারণা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা লাভের আগে ১৯৭০-৭১ সালের দিকে তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন পাকিস্তান রেডিওতে এবং পাকিস্তানেই থাকতেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করতেন বলে পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হন। পরে সে সুবাদেই বাংলাদেশ বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে তাঁর চাকরি হয় এবং বেতারে তিনি নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যান কারি সাহেব। তাঁকে দূর থেকে দেখেই বঙ্গবন্ধু বললেন, কারি সাহেব! আমি মুসলমান, আমি হিন্দু হইনি, বিশ্বাস না হয় আপনার সামনেই আবার কালেমা পড়ছি। এই বলে গড় গড় করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’—পুরো কালেমা তাইয়্যেবা পড়লেন। (মাওলানা ইসহাক ওবায়দী, ইসলামী কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর অবদান, দৈনিক যুগান্তর, ১৭ আগস্ট, ২০০১)

শুধু জীবিত ইসলামী ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই নয়, জাগতিক জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া ইসলামী ব্যক্তিকেও যে তিনি কত ভক্তি ও ভালোবাসার নজরে দেখতেন, তার নজিরও আছে। সেই ইসলামী ব্যক্তিত্ব আর কেউ নন, বিশ্ববিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল। বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন, “খাজা আবদুর রহিম পূর্বে আইসিএস ছিলেন (তখন ওকালতি করেন), খুব ভদ্রলোক। আমাকে তাঁর কাছে রাখলেন, জাভেদ মঞ্জিলে। তিনি জাভেদ মঞ্জিলে থাকতেন। ‘জাভেদ মঞ্জিল’ কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি। কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তাঁর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন, সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি। ” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২১৭)

SUMMARY

1263-B4.jpg