মুহাম্মদ ফারুক খান
বাঙালি জাতিকে শাসন ও শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অনেকে। অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেছেন বাঙালি জাতির অনেক বীর সন্তান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হলেও বাঙালির কোনো লাভ হয়নি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ২৩ বছরের ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’ ও ১৯৭১ সালের বীরত্বপূর্ণ ‘মুক্তিযুদ্ধে’র সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা অর্জন করি আমাদের হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত ‘স্বাধীনতা’।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি বিষয় ও ঘটনাগুলো ঐতিহাসিক স্বীকৃত সত্য। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অতি সহজে হঠাৎ করে আসেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে যে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে, তা শুধু আমাদের দেশবাসীরই জানা নয়, বিশ্ববাসীও তা ভালোভাবে জানে। সুতরাং এ বিষয়গুলো নিয়ে নতুন কিছু লেখা সম্ভব নয়, তবে কিছু লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী চারদলীয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির জনক ইত্যাদি বিষয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা চালিয়েছে, নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হলো একটি অন্যতম মাইলফলক। এ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধে’র ডাক দিয়েছিলেন এবং এ যুদ্ধ কিভাবে করতে হবে তার সুচারু দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’, ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দিব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশগুলো ৭ মার্চের পর থেকেই সব বাঙালির হৃদয়ে ধ্বনিত হয়েছে, আজও এবং যুগ যুগ ধরে প্রকৃত বাঙালির হৃদয়ে ধ্বনিত হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ১৮ দিন আগেই বাঙালি জাতিকে ও এ জাতির সব পর্যায়ের নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, এ যুদ্ধের রাজনৈতিক তাত্পর্য ও সামরিকভাবে এ যুদ্ধ কিভাবে করতে হবে; অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) ও রণকৌশলসহ (টেকটিক্যাল) সব দিকনির্দেশনাই দিয়ে দেন। একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি বুঝেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি হতে পরিষ্কার নির্দেশনার দরকার এবং ৭ মার্চের পর ঘটনা এত দ্রুত এগোবে যে পরে এ ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার উপযুক্ত সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। জাতির জনকের ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই ধর্ম, বর্ণ, দল-মত-নির্বিশেষে বাঙালি জাতি একতাবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে অসহযোগসহ সব সরকারি কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশ তখন চলত। তত্কালীন প্রধান বিচারপতি পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ না করানোর মতো সাহস দেখাতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত বা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর তথা আজকের বিজিবি) বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে ‘স্বাধীনতা’র ঘোষণা দিয়েছেন, যা আজ ঐতিহাসিক সত্য বলে প্রমাণিত। এর সাক্ষ্যপ্রমাণ এখনো অটুট (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড)। ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অনেকেই শুনেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা শুনেছিলেন তত্কালীন ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনে কর্মরত আইএসপিআরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক। তিনি তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ের ৭৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh.’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাসহ অনেকেই ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ শুনেছেন এবং এ ঘোষণা অনুযায়ী তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতেই টেলিফোনের মাধ্যমে আরো একটি ঘোষণা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ও বিভিন্ন সংস্থায় প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ঘোষণা অনুযায়ীই রাজনৈতিক নেতা, সামরিক কর্মকর্তা, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য, ছাত্রনেতাসহ সব স্তরের মানুষ ২৬ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পুরোপুরি দোষারোপ করে বলেছিলেন, ‘Sk Mujib has declared independence of East Pakistan. He is a traitor. This time he will not go unpunished.’ (শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি একজন দেশদ্রোহী। এবার তিনি শাস্তি এড়াতে পারবেন না)। ২৭ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Daily Telegram পত্রিকার প্রথম পাতায় নতুন দিল্লি থেকে তাদের সাংবাদিক ডেভিড লোমাকের পাঠানো সংবাদের ভিত্তিতে Civil War in East Pakistan : Sheikh a traitor, says President শিরোনামে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা লেখা হয়। সুতরাং ২৬ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকেই পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট দোষারোপ করেছিলেন। এ ছাড়া অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা নিজ কানে অথবা অন্যের মারফত শুনেছেন এবং তা তাঁদের বই, প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ সংবলিত টেলিগ্রাম পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে সেই নির্দেশ বিভিন্ন বাহিনী-সংস্থা ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। একই ধারায় ২৬ মার্চ বিকেল ও ২৭ মার্চ সকালে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ বিকেল ও ২৮ মার্চ সকালে তত্কালীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ প্রচারিত স্বাধীনতা ঘোষণার নির্দেশের আলোকে ও চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অনুরোধে কালুর ঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আবার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মেজর জিয়া কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও জওয়ানদের মধ্যে সাহসের সঞ্চার করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এসবই ঐতিহাসিক সত্য। সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
১৯৭৫ সালে গৃহীত আমাদের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ৩৪(খ) অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বহু নির্বাচিত, অনির্বাচিত ও সামরিক সরকার ও নির্বাচিত জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। এসব সরকার জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানে পঞ্চম থেকে চতুর্দশ অর্থাৎ ১০টি সংশোধনী এনেছে। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে চতুর্থ সংশোধনীর অনেক বিধানই রহিত করা হলেও ৩৪(খ) অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে উল্লেখ করার বিধান রহিত করা হয়নি। রহিত না করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে ১৯৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত সব সরকার ও জাতীয় সংসদ বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করেছে।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনো প্রধানমন্ত্রী আবার কখনো রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যরা বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের সবাই বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ও স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয় এবং ৪ নভেম্বর ১৯৭২ তা তত্কালীন গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। এ সংবিধান পাস করা উপলক্ষে দেওয়া বিভিন্ন সংসদ সদস্যের ভাষণও আমি সংসদ পাঠাগারে পড়েছি। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ও স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আমাদের গর্বের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে আজ ৪৫ বছর। স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক কারো কাম্য নয়। এ কথা সবারই জানা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। একে আলাদা করার কোনো উপায় বা পথ নেই। যত দিন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের দেশটি থাকবে তত দিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিও জড়িত থাকবে। এটা কোনো কাঠ পেনসিলের লেখা নয় যে রাবার দিয়ে মুছে ফেলা যায় বা যাবে। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীও এ দেশের অনেক দেশপ্রেমিক ত্যাগী নেতাকে সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল; কিন্তু তাদের কুচক্রান্তও সফল হয়নি। তেমনি আজও যারা বঙ্গবন্ধুকে, আমাদের স্বাধীনতাকে, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিতর্কিত করতে চায়, দেশপ্রেমিক ত্যাগী নেতাদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়, তারা কোনো দিন সফল হতে পারেনি, পারবে না। ইতিহাস সত্য বলবেই। বীর বাঙালি জাতি সত্য থেকে বিচ্যুত হবে না।
লেখক : সংসদ সদস্য, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক মন্ত্রী, বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়