মঈনুল ইসলাম
বাকশাল নিয়ে মুজিবের সাম্যবাদী ভাবনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ,“ এই যে নতুন সিস্টেমে যাচ্ছি আমি। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ (সমবায়) করা হবে। ভুল করেন না, আপনাদের জমি আমি নেবো না। ভয় পাইয়েন না, কারো জমি নিয়ে যাবো তা নয়। পাঁচ বচ্ছরের প্লানে বাংলাদেশের পয়ষট্রি হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে; প্রত্যেক গ্রামে। এই কো-অপারেটিভ (এ) জমির মালিক জমিরই (মালিক) থাকবে কিন্তু তার অংশ যে বেকার প্রত্যেকটা মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে সেই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে।
আলটিমেটলি পয়ষট্রি হাজার ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা হবে;পাঁচ বছরের প্লান নেয়া হয়েছে।....আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল ঐ টাউটের দল বিদায় দেয়া হবে।...পাঁচশ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কমপোলসারি কো-অপারেটিভ। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের, অংশ যাবে গভর্ণমেন্টে...।...এইভাবে একটা সিস্টেম আমি চিন্তা করেছি এবং করবো বলে ইন শা অল্লাহ আমি ঠিক করেছি। আমি আপনাদের সাহায্য সহানুভূতি চাই।”
এখানে স্পষ্টত বাকশাল কি তা দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু আধিপত্যশীল এক শতাংশ পুঁজিবাদীর কাছ থেকে জমি নিয়ে তাতে গরীবের ও কর্মক্ষম ব্যক্তিদের অংশীদারিত্ত্ব নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। এমন হলে বাংলাদেশের উর্বর ভূমি অল্প দিনেই সেই টাকায় আটমনের যুগের উৎপাদন ব্যবস্থায় চলে যেত।
যারা আজ ড. ইউনুসের সোশ্যাল বিজনেসকে নিয়ে উল্লাস করেন তারা মুজিবের এই কো-অপারেটিভ সিস্টেম নিয়ে ভেবেছেন কখনো?
৭০ এর দশকে বাংলাদেশের সাপেক্ষে এমন সাম্যবাদী সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতির যে স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না।
সেকারণেই তাঁকে বাংলাদেশ ও মানবতার শত্রুরা বাঁচতে দেয়নি। যেভাবে মাওবাদ, লেলিনবাদ, মার্কসবাদ নিয়ে আজ বিশ্বে ডিসকোর্স চালু হয়েছে ঠিক সেই ডিসকোর্স ‘মুজিববাদ’ও হতে পারতো। কারণ মুজিববাদ যে সাম্যবাদের দীক্ষা দিয়েছে তা বিশ্বে অনন্য, এই বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা বলা একমাত্র তাত্ত্বিক রূপ ছিল মুজিববাদ বা বাকশাল।
মুজিবের বাণিজ্য ভাবনা
দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে মুজিবের ভাবনা আরো বেশি জাতীয়তাবোধসম্পন্ন। তিনি বলেন,“আমার পাটের দাম নাই। আমার চায়ের দাম নাই। আমি বেচতে গেলে অল্প পয়সায় বেচতে হয়। আর আমি যখন কিনে আনি যারা বড় বড় দেশ তাদের জিনিসের দাম অনেক বাড়ায় দেয়া হয়েছে। আমরা বাঁচতে পারিনা। এইজন্য আমরা বলি, তোমরা মেহেরবানী করে যুদ্ধ মনোভাবটা বন্ধ করো। করে ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যয় করো। এই দিন থাকবে না।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে , আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টোক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাআল্লাহ এই দিন আমাদের থাকবে না।
ভাই আরবদের সঙ্গে আমার একাত্মবোধ। আজ প্যালেস্টাইনে আমি তাদের দাবী, আরব ভাইদের ন্যায্য দাবী সমর্থন করে বাংলার মানুষ। মোরাও ভাইদের পেছনে থাকবো প্যালেস্টাইনকে উদ্ধার করার জন্য। এ ও আমাদের পলিসি। যেখানে নির্যাতীত দুঃখী মানুষ আছে সেখানে আমরা যাবো।”
এমন দৃঢ়চিত্তকে এই জগতে আছে একই সঙ্গে যে তীব্র জাতীয়তাবাদ ও মানবতাবাদ ধারণ করতে পারে? বাংলাদেশের মানুষের, এই ভূখন্ডের, এই জমির এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদের শক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু জানতেন।
তাই তিনি স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রেখে বলেছিলেন, এই দিন থাকবেনা। তিনি ফিলিস্তিন না শুধু, যেকোন দুঃখী মানুষের মুক্তি আন্দোলনে শরীক হওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এই জাতীয়তাবোধসম্পন্ন মহান নেতা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশে এই অঞ্চলের ভৌগলিক পরাশক্তি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হতো এ কথা বুঝতে মাথা খাটানোর দরকার হয়না।
ভণ্ড বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু
বক্তব্যের একটি অংশে কথিত শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী নামের অন্ধসমালোচকদের উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন,“...আপনার কর্তব্য আছে যে ছেলেদের মানুষ করতে হবে। ফেল করানোতে আপনাদের বাহাদুরি নাই, পাশ করানোতে আছে...রাগ করেন না, রাগ করেন না। আপনারা আবার আমার উপর রাগ করেন। আমি নাকি বুদ্ধিজীবীদের, না না না বুদ্ধিজীবীদের আমি কিচ্ছু বলিনা। সম্মান করি। শুধু এইটুক করি যে বুদ্ধিটা একটু জনগণের খেদমতে আপনারা ব্যয় করেন-সেইটুকই চাই। এইটা মনে রাখবেন, এর বেশি আমি আপনাদের বলবোনা। বাবা বলে কি মারা যাবো! আবার কোনসুমা (কখন) বই লিখে বসবেন। আপনাদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু চাই ন্যায্য কাজটা করেন। খালি সমালোচনা করে লাভ হবেনা।
দেশবিরোধী ভূমিকায় থাকা কিংবা দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা বুদ্ধিজীবী নামধারী সুশীলদের এত প্রখর বুদ্ধিমত্তার সাথে জবাব দেয়ায় আজো এরা বঙ্গবন্ধুর নামে ভিত্তিহীন অসত্যতা ছড়ায়। অথচ মুজিব এই বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছেন ভালবাসায় সিক্ত প্রতিটি ক্ষণে। বরং ঘাতক ও ঘাতকদের সমর্থকরা আজ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে বেওয়ারিশের মত দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে।
ব্রিটিশপন্থী বিচারব্যবস্থার সমালোচনায় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা পরিবর্তনের ইচ্ছা ব্যক্ত করে বাকশাল বিষয়ক ঐ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, “...আরেকটা কথা বলতে চাই। বিচার বিচার। বাংলাদেশের বিচার। ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লাহর মর্জি- যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে সে মামলা শেষ হতে লাগে বিশ বছর। আমি যদি উকিল হই আমার জামাইরে উকিল বানাইয়া কেসটা দিয়ে যাই। ও মামলার ফয়সালা হয়না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়, চাইর বছর তিন বছরের আগে শেষ হয়না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে হবে যে, থানায় ট্রাইব্যুনাল করার চেষ্টা করছি আমরা এবং সেখানে যাতে মানুষ (একটা) এক বছর দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায় তার বন্দবস্ত করতেছি। আশা করি সেদিকেই হবে।
ছাত্রদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু
সর্বশেষ বাকশাল সম্পর্কিত ব্যাপারে ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্থপতি কিছু পরম নির্দেশনামূলক কথা বলেন। এ কথাগুলো ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তাও ছিল। বঙ্গবন্ধু বলেন,“ আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর উপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটাকে একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। একটু পায়জামা ছাইড়্যা (একটু) লুঙ্গি পরতে হবে।
আর গ্রামে গ্রামে যাইয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করতে হবে। যুবকও চাই, ছাত্রও চাই। সকলকে চাই।” এই ছিল বাকশাল ও বঙ্গবন্ধু। যারা আজ বাকশালের সমালোচনা কওে থাকে পশ্চিমা মানদন্ডের কথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে এরা আসলে কৃষক-শ্রমিক-গরীবের শত্রু। এরা বঙ্গবন্ধুর বুদ্ধিবৃত্তিক হত্যাকারী।
সদ্য স্বাধীন হওয়া কোন রাষ্ট্র পৃথিবীতে নেই যেখানে বহুদলের কোলাহলপূর্ণ রাজনীতি আছে। বহুদলের রাজনীতির আমি বিরোধী নই। কিন্তু যে পশ্চিমারা আমাদেও জাতীয় ঐক্য নষ্ট করতে এই বহুদলীয় ঐক্যের রাজনীতির ছবক দিয়েছে তাদের দেশে কেন মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল?
কেন চীন একটি দল নিয়ে উন্নত হচ্ছে? কেন ভ্লাদিমির পুতিন তৃতীয় বারের মত প্রেসিডেন্ট? কেন আমেরিকার মানুষের ডেমোক্রেট ও রিপাবলিক এই দুই মতের একটাতে যেতেই হয়? তখন কোথায় থাকে বহুদলের বয়ান? সেই মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে চীন কিংবা ইরান থেকে রাশিয়া যেটার উদাহরণ টানেন তারা বাকশালের মতই একটি দলের, একটি নীতির আলোকে আজ উন্নত। বাকশালের সমালোচনা কওে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদীদের দেশীয় এজেন্টদের ঘৃণ্য অপকর্ম জাস্টিফাইডের অপচেষ্টা কেন করা হয় এখনো ?
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের উপর মানব ইতিহাসের ভয়াবহ যে হত্যাকান্ড চালানো হয়েছিল তাতে ১৯৭৫ সালের পনের আগস্টের ধানমন্ডিকে কারবালার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আরবের ইয়াজিদ বাহিনী যেন ভর করেছিল বাংলার ইয়াজিদ বাহিনীর মাঝে।
তা না হলে নারী ও শিশুদের প্রতি এমন বর্বর আচরণ কে করতে পারে? দেশে একাত্তরের পর সিরাজ শিকদারের বিপথগামীতা এবং জাসদের সশস্ত্র রক্তখেলা মুজিব সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। এই সময়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে বিশ্ব বেঈমান খন্দকার মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর প্রিয় তাজউদ্দিন, মনি ও সিরাজুল আলমের মধ্যে সম্পর্ক ভাঙনের সুযোগ নেয়।
মার্কিন পুতুল মোস্তাক ডালিম-ফারুক-রশীদ গংদের সাথে মিলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এক হয় নিরব ক্ষমতালোভী সব সেনা অফিসার। খালেদ মোশাররফ ছাড়া তাদের সকলের ভিত্তি ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।
মৌলবাদী থেকে শুরু করে প্রগতিশীল নামধারী প্রতিটি বাংলাদেশবিরোধী শক্তি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এর মধ্যে জাসদের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। আজ যে কর্ণেল তাহেরের স্তুতি করি আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্লট তৈরিতে তার ভূমিকা ছিল কি না এটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে কি? তাহের জিয়াকে মুক্ত করেছে। তাদের যতোটা না আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল ক্ষমতার। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যেতে তাদের একজনকে মরতেই হতো।
এখন ভাবুন তো, জাসদের নেতৃত্ত্বে ঘটা কথিত বিপ্লব ও সংহতি দিবসে যদি জিয়া মরতো এবং তাহের বেঁচে থাকতো তবে কে হতো ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক প্রেসিডেন্ট? নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে এটুকু ভাবা দরকার। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর পরিবারসহ তাঁকে হত্যায় জড়িত প্রতিটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যক্তি ও সংগঠনকে জাতির কাছে উন্মোচন করতে হবে। এটি ইতিহাসের দায়। সে হোক জিয়া, হোক তাহের, হোক জাসদ কিংবা ভাষানীর ন্যাপ কিংবা বিএনপি কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত কিংবা আওয়ামী লীগের মোশতাক বা তাহের ঠাকুর। জাতির পিতার জীবননাশের সঙ্গে জড়িত কারো ক্ষমা পাওয়ার অধিকার নেই।
লেখক: মঈনুল ইসলাম
গবেষক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর. সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা