ড. হারুন-অর-রশিদ
আগস্ট মাস বাঙালির শোকের মাস। পনেরোই আগস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে একদল ঘাতক-খুনি চক্রের হাতে অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঘাতক খুনিদের নির্মম বুলেটের হাত থেকে রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবারের উপস্থিত কোনো সদস্যই। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ, ১০ বছরের শিশু রাসেলও! সেখানে বয়ে যায় রক্তগঙ্গা। সৃষ্টি হয় গ্রিক ট্র্যাজেডির চেয়েও নির্মম, পৈশাচিক দৃশ্যের। কেন এ নিষ্ঠুরতা? কেন এ পৈশাচিকতা? পনেরোই আগস্ট নিছক ক্ষমতার পালাবদল ছিল না। সে দিন সংঘটিত হয় রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লব।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি (১৯৬৬), পাকিস্তানি শাসক জেনারেল আইয়ুবের দায়ের করা ‘আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা’-বিরোধী ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অস্বীকৃতি ও যড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মার্চ ১৯৭১ পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার প্রতিরোধের উদাত্ত আহ্বান, নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া, ছাব্বিশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনার এই পর্ব বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১ হিসেবে আখ্যাত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন এ বিপ্লবের মহানায়ক। ‘দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক, জাতি-নিপীড়নমূলক, পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর সর্বপ্রকার বন্ধন-নিয়ন্ত্রণ ছিন্ন করে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনই ছিল বাংলাদেশ বিপ্লবের মূল লক্ষ্য। বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও শোষণমুক্তি ছিল এর আদর্শিক ভিত্তি।
পনেরোই আগস্টের (১৯৭৫) প্রতিবিপ্লব বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১-এর মহান আদর্শকে ছুড়ে ফেলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় পুনরায় ফিরিয়ে নেয়, যা থেকে এখনো সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও আমাদের স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও আমরা পরাধীন থাকতাম। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার স্বপ্ন সামান্যতমও পূরণ তো করেইনি, বরং তাদের নতুন দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। বাঙালির স্বাধীনতা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রভাবনা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে যুক্তবাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজী সুভাস বোসের জ্যেষ্ঠভ্রাতা শরৎ বোস, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি দলের নেতা কিরণ শংকর রায়, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম, সত্য রঞ্জন বকশী এদের সঙ্গে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন অখ- বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে উদ্যোগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতির আন্দোলন নবতর পর্যায়ে শুরু হলে, বঙ্গবন্ধু তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দি (১১ মার্চ ১৯৪৮)। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে (১৯৫২) কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন পালন করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করলে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধান সভায় এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর বুঝতে বাকি ছিল না যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাঙালির জাতীয় মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। অপরদিকে, জাতীয় মুক্তির আন্দোলন সংগঠিত ও সফল করতে আবশ্যক গণভিত্তিসম্পন্ন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের।
একই উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৫৫ সালে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হলে কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক হন। একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় মাত্র ৯ মাস মন্ত্রিত্ব করার পর বঙ্গবন্ধু তা ত্যাগ করে আওয়ামী লীগকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে আত্মনিয়োগ করেন, যা এই উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ২৪ বছরের অর্ধেক সময় বা ১২ বছর কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। দুবার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তিসনদ আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচি জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হানেন। এই ৬-দফা কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংঘটিত হয় বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১।
বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর প্রশস্ত হৃদয়। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অপার ভালোবাসা। বাংলাদেশ ‘রাজনীতির কবি’ (চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং) বঙ্গবন্ধুর অমর মহাকাব্য। জীবনভর সাধনা আর অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে তিনি তার এ মহাকাব্য রচনা করেছেন। তাই তো, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এক সাক্ষাৎকারে (ধানমন্ডি, ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর কাছে যখন জানতে চাইলেন, আজ এই মুহূর্তে অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি কোন দিনটিকে আপনার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন বলে গণ্য করবেন? কোন মুহূর্ত আপনাকে সব চাইতে সুখী করেছিল? বঙ্গবন্ধু এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি যেদিন শুনলাম আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেদিনটি ছিল আমার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।’ ডেভিড ফ্রস্ট পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন? বঙ্গবন্ধু জবাব দিলেন, ‘সমগ্র জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।’ ডেভিড ফ্রস্টের আবার প্রশ্ন, এমন দিনটির স্বপ্ন আপনি কবে থেকে দেখতে শুরু করেন? বঙ্গবন্ধু, ‘বহুদিন ধরে আমি এই স্বপ্ন দেখে আসছি।’
বাংলাদেশ ও আমাদের স্বাধীনতার মতো বঙ্গবন্ধুর কোনো ক্ষয় বা মৃত্যু নেই।