১৯৯১ সালের ৩মার্চ ফ্রিডম পার্টির নেতা আত্মস্বীকৃত মুজিব হত্যাকারী কর্নেল রশীদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন জিয়াউর রহমান ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পরিকল্পনা জানতেন । পটপরিবর্তনের পর তিনি সামরিক বাহিনীর লোক হিসাবে প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমরা বাঁধা দিই । আমরা চাই বেসামরিক লোক দেসেরর প্রেসিডেন্ট হোক । ফলে আমাদের দেশ হতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । তিনি বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪ নেতা হত্যাকাণ্ডের নেতা ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং খালেদ মোশারফ । আসলেই কি জিয়াউর রহমান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন? তিনি কি সত্যি সত্যি ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পরিকল্পনা জানতেন? এ সকল প্রশ্নের উত্তরের জন্যই এ লেখা ।
জিয়া কি সত্যিই মুজিব হত্যার সাথে জড়িত ??
জিয়া কি সত্যিই মুজিব হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন? ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিহত হন তৎকালীন সময়ে জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ । ’৭৫ এর ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর ১৬ই আগস্ট সকালের বর্ণনা অধ্যাপক আবু সাইদ তার ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস পুস্তকে দিয়েছেন এই ভাবেঃ
সাতটা পনের মিনিট । ডেপুটি চীফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অফিসে এল । স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি । এতটুকু পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া নেই । এর পরপরই সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ এল । তার সামনে পেছনে ল্যান্সার এবং আর্টিলারী গার্ড । হেড কোয়ার্টার অফিসে তখন কৌতূহলের আর উৎসুকের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে । এর পনের মিনিট পর মেজর ডালিম এল-মেজর রশিদ এল । দুটো এম, জি জীপ স্কট নিয়ে তারা হেড কোয়ার্টারে এল । সোজা ঢুকে গেল শফিউল্লার রুমে । পাঁচ মিনিট পরে শফিউল্লার রুম থেকে তারা বেরুল । শফিউল্লাহ বেরুল – পিছনে জিয়াউর রহমান । জিয়াউর রহমান একটু এগিয়ে এসে ডালিমকে ব্ললঃ কাম হিয়ার, আবেগের কণ্ঠে জিয়া ডাক দিলোঃ য়্যু হ্যাভ দান্ সাস্-এ গ্রেট জব! কিস মি! কিস মি!
জিয়া ডালিমকে জড়িয়ে ধরল পরম উষ্ণতায় ।
ঃ নো স্যার থ্যাঙ্ক য়্যু ভেরি মাচ্ । য়্যু আর মেজর জেনারেল এন্ড আই য়্যাম এ সিম্পল মেজর, আদার ওয়াইজ য়্যু আর দ্য হিরো অফ ইন্টায়ার শো । সো প্লীজ য়্যালাউ মি টু মাই জীপ ।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান স্টাফ কারে উঠল । মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে মেজর রশিদ ও মেজর ডালিম গার্ড করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গেল । (সুত্রঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস পৃঃ১৩৬-১৩৭)
এর পরের দিন ১৬ আগস্টের বর্ণনা ঐ বইতে দেওয়া আছে এভাবেঃ
পরের দিন সকালে আর্মি হেড কোয়ার্টারে মিটিং ।
সেনাবাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান, ব্রিঃ খালেদ মোশারফ, ব্রিঃ সিআর দত্ত, ব্রিঃ মীর শওকত আলী, কর্নেল শাফায়াৎ জামিল, কর্নেল নাসিম, কর্নেল হুদা, কর্নেল আমজাদ হোসেন চৌধুরী, কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ।
আলোচনা শুরু হল । কর্নেল শাফায়াৎ জামিল সরাসরি ক্ষোভের কণ্ঠে বলেলনঃ এটা আর্মি ক্যু হলে আমরা জানিনা কেন? আর একটা টোটাল আর্মি ক্যু না হয়ে থাকলে আমি মনে করি যারা এ জঘন্য কাজ করেছেন তারা খুনি এবং দে শুড বই পানিশড । ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং কর্নেল হুদা এ বক্তব্য সমর্থন করে তাদের মতামত দিল ।
শাফায়াৎ জামিল বলে চললঃ য়্যাজ য়্যু আর দি আর্মি চীফ, আই ওয়ান্ট অর্ডার ফ্রম য়ু- আই উইল ওয়াশর্ড আউট অফ অল মার্ডারার্স উইথ ইন হাফ আওয়ার । শফিউল্লাহ নীরব নিশ্চুপ ।
ঃ মাই ব্রিগেড ইজ রেডি এন্ড ইফ ইউ আর আনএবল টু পাস দ্যা অর্ডার দেন লিভ দ্যা চেয়ার এন্ড আসক ডালিম টু সীট ইন ইওর চেয়ার এজ আর্মি চীফ ।
শাফায়াত জামিলের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ আর তীব্র আক্রোশের ভাষায় তার গলা আক্রমণাত্মক । রুমের ভেতরে তার কথা সবার মন চিড়ে যাচ্ছে । সবাই চুপ । থমথমে ভাব । জিয়াউর রহমানের খসখসে আওয়াজ । শব্দ করে সিগারেট ধরাল । একটা দীর্ঘ টানে এক মুখ ধুম্র উদগীরণ করে ঠাণ্ডা গলায় বললঃ লুক শাফায়াত জামিল । ইট ইজ নট এ ম্যাটার অফ সেন্টীমেন্ট- এটি এখন জাতীয় সমস্যা । ইফ ইউ গো টু ওয়াশ আউট আর্টিলারি এন্ড সেকেন্ড ফিল্ড ব্যাটালিয়ান ফ্রম ঢাকা সিটি দেন দেয়ার উইলবি কনফ্লিউ ইন্সাইড দ্যা আর্মি । শুধু তাই নয় এটা একটা গৃহযুদ্ধে পরিণত হবে এন্ড দ্যাট টাইম ইন্ডিয়ান আর্মি উইল কাম এন্ড উই উইল লুজ আওয়ার সভরেন্টি এন্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ।
জিয়ার বক্তব্যকে মীর শওকত আলী খান আর আমজাদ হোসেন সমর্থন করে ব্রিগেডিয়ার দস্তগীর নিশ্চুপ থেকে মেজর জেনারেল পদে প্রমোশন পান । (পৃঃ ১৪১-১৪২)
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ মেজর জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের ৫মাস পূর্বেই জেনেছিলেন । হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর ফারুক একথা তাকে জানিয়েছিলেন । কিন্তু জিয়া কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি । অথবা চলতি চক্রান্তের আসন্ন পরিকল্পনা রাষ্ট্রপতিকে জানাননি । যদিও সেনাবাহিনীর চাকুরীর শর্তে এই ধরণের পরকল্পনার বিষয় অবগত থাকা সত্ত্বেও তা না জানানো গুরুতর অপরাধ । জিয়া যে মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন এ সম্পর্কে এন্থনী ম্যাস্কারেনহাসের বলেছেনঃ
আমিই ফারুক রশিদ সাক্ষাৎকার নিই । এ সময়ে ফারুক আমাকে বলে সে জেনারেল জিয়াকে ১৯৭৫ সালের ২০শে মার্চ জানিয়েছিলেন আমরা সরকার পরিবর্তন করতে চাই । জিয়া তাদের বলেন, দুঃখিত আমি জংলী কিছু করতে পারব না । তোমরা ইয়ং অফিসার যা খুশি কর গিয়ে ।
“কোরান ছুঁয়ে ফারুক আমাকে বলেছে, জুলাই মাসে ঢাকা এসে আমি জেনারেল জিয়াকে একথা ঠিক কিনা জিজ্ঞাসা করি । তিনি বলেছিলেন, ভেবে দেখবেন আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন কিনা ।“(ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস)
এছাড়াও মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকাণ্ডের নিয়ে এন্থনী ম্যাস্কারেনহাস কর্নেল ফেরুকের একটি সাক্ষাৎকার নেন । সাক্ষাৎকারে কর্নেল ফারুক মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়ার জড়িত থাকার কথা বলেন । নিচে সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হলঃ
ফারুকঃ আমাদের প্রথম পছন্দ ছিল জেনারেল জিয়া । কারণ সে কলঙ্কিত ছিল না । বহু চেষ্টা করে ১৯৭৫ সালে ২০ মার্চ । সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আম্মি সাক্ষাত করি । জেঃ জিয়া বললেন আমি একজন সিনিয়ার অফিসার আমি এভাবে জাড়াতে পারি না, যদি তোমরা জুনিয়র অফিসাররা এটা করতে চাও এগিয়ে যাও ।
এন্থনীঃ জেনারেল জিয়াকে কি আপনি বিশেষভাবে বলেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করা আপনাদের একান্ত ইচ্ছা?
ফারুকঃ দেখুন, আমি সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফের সাথে কথা বলেছিলাম । আমি সরাসরি প্রেসিডেন্টকে উৎখাতের কথা বললে হয়ত তিনি আমাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠাতেন । সেজন্য আমি কথাটি ঘুরপথে শুরু করেছিলাম । দুর্নীতি, সবকিছুই বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কথা তুলে বলেছিলাম দেশে পরিবর্তন চাই । একথা শুনে তিনি বললেন, চলুন লনে কথা বলা যাক ।
এন্থনীঃ জিয়া এরকম বললেন ?
ফারুকঃ হ্যাঁ, আমরা লনে আসলাম । তাকে বললাম, আমরা পেশাগত সৈনিক । আমরা দেশকে সেবা করব, কোন ব্যক্তিকে নয় । সেনাবাহিনী, সিভিল সার্ভিস, সরকার সবকিছুই ধবংস হয়ে যাচ্ছে । আমাদের এগুলো পরিবর্তন করতে হবে । আমরা জুনিয়র অফিসাররা অগ্রসর হয়েছি । এখন প্রয়োজন আপনার সমর্থন এবং নেতৃত্ব।
জিয়া বললেন, আমি দুঃখিত । আমি এসব ব্যাপারে জড়াতে চাই না । যদি তোমরা কিছু করতে চাও তাহলে এটা জুনিয়রদেরই করা উচিৎ ।
জিয়ার শাসনঃ খুনিরা নিরাপদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থানের নায়কের ক্ষমতায় বসেন। তখন দেশে এক অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছিল । জনগণ সেনাবাহিনীর ভিতরের বা রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের কোন খবরাখবর পেত না । মুজিব হত্যাকাণ্ডের ৩ মাসের মাথায় খালেদ পাল্টা ক্যু করে বসেন । খালেদ মোশারফের ক্যুর সময় হত্যাকারীরা বিদেশে পাড়ি জমায় । প্রথমে তারা ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় চায় । কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকার জানায় । ের ফলে হত্যাকারীরা লিবিয়ায় গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করে । লিবিয়ার সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় । এদিকে দেশে খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের ৩ দিনের মাথায় কর্নেল তাহের পাল্টা অভ্যুত্থান করেন । সেই অভ্যুত্থানে খালেদ নিহত হন এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন । ক্ষমতা দখল করেই তিনি অভ্যুত্থানের নায়ক তাহেরের ফাঁসি দেন । তিনি বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ১২ জনকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী দূতাবাসে চাকরী দেন ।
প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেপুটেশানে এবং পরে বিসিএস ফ্রেন সার্ভিস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ফারুক ও রশিদ ঐ সময় চাকুরী গ্রহণ না করে লিবিয়ায় অবস্থান করে । জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে হত্যাকারীদের এই রকম পুনর্বাসিত ও সুযোগ সুবিধা দিয়েই শেষ করেননি সংসদে মুজিব হত্যার বিচার করা যাবে না বলে ৫ম সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে নেন । জিয়াউর রহমানের হত্যাকারীদের প্রতি এরুপ ব্যবহার কি এ প্রশ্নের জন্ম দেয় না পরোক্ষভাবে নিজেকে বাঁচাবার জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন? জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন হত্যাকারীদের প্রতি আচার আচরণে মনে হয় তিনি সবসময় চেয়েছেন যাতে মুজিব হত্যার বিচার না হয় । হয়তো মুজিব হত্যার বিচার হলে এবং সত্য উদঘাটিত হলে বিচারে তারও শাস্তি অস্বাভাবিক কিছু নয় ।