শাফিকুর রাহী:
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেশপ্রেম মানবপ্রেম আর ধর্মচেতনার নাক্ষত্রীয় আভায় উদ্ভাসিত মনোলোক ধারণ করেছিল বাঙালির মহিমান্বিত বীরত্বের বিরল অমরগাথা। তিনি কীভাবে বীর বাঙালির অকল্পনীয় অলোকসুন্দরের আরাধনায় বারবার উচ্চারণ করেছেন, বাঙালির মতো অমন বীরের জাতি দুনিয়াতে খুব একটা নেই। কেবলমাত্র বাঙালিই পারে সমগ্র বিশ্বকে বিস্মিত করে জয়ের বরমাল্য গলে পরতে। তিনি বাঙালির শৌর্যবীর্যের গৌরবগাথা তার মননে ধ্যানে জ্ঞানে লালন করে জানান দিলেন বাঙালির মুক্তি ও বিজয় অনিবার্য। বাঙালির আছে তাবৎ বিশ্বকে শাসন করার শক্তি সাহস এবং গর্বিত গরিমা। আমাদের কি নেই! জল-মাটি-বায়ু মুক্ত আকাশ-পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র হাজারও নদ-নদী, খনিজ সম্পদে ভরপুর বাঙালির নৈসর্গিক অরণ্যভূমি। কালে কালে এ শ্যামল কোমল ভূমিতে জন্ম নিয়েছে কত ধ্যানী, মুনি, ঋষী, জ্ঞানীগুণী, প-িত আর বীরত্বের অগ্নিপুরুষ, সূর্য তাপস।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রবল প্রজ্ঞা পরম মানবিকতা মহত্তম উদারতার ফলে আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবির সর্বোচ্চ সম্মানিত আসন অলঙ্কৃত করেছেন নজরুল। যা সমগ্র জাতির কাছে অতীব গৌরবের বিষয়। নজরুলের কবিতা আজ বাংলাদেশের রণসংগীত আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আমাদের জাতীয় সংগীত, এসবই হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম আর মানবপ্রেমের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের শুভলগ্নেÑ সুনির্দিষ্ট নির্দেশে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান কবিতায় যেভাবে মুগ্ধ হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান কবিতায়ও দারুণভাবে উজ্জীবিত অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিধায় মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথে অমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম কিংবা এর আগের অনেক লোকজনও এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না বলেই হয়তো কেউ জানতেও চায় না যে, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়ার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেও বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেন কীভাবে; সত্যিকার অর্থেই এ তথ্য অনেকেরই না জানার কথা। কারণ পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মূল ইতিহাসটাই বিকৃতির মাধ্যমে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। শুধু কি তাই; বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানকেও এক ভয়ঙ্কর সামরিক হন্তারক তছনছ করে ফেলেছিল তার নিজের মসনদকে পাকাপোক্ত করার অশুভ অপপ্রয়াসে ভয়ঙ্কর মিথ্যাচারের অপকৌশলে।
এ জঘন্য অমার্জনীয় অপরাধটি করেছিল যা কিনা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের এবং কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। আজ সময় এসেছে দেশের স্বার্থে ও ইতিহাস ঐতিহ্যের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে বাঙালি জাতির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সবার সামনে তুলে ধরার। আর সমগ্র জনগোষ্ঠীর কাছে বিশ্বাসঘাতকদের স্বরূপ উন্মোচন করার। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম আর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের আত্মদান আর দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে প্রিয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বড় বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘মাইডিয়ার সিস্টার আপনার কাছে আমার একটি আবদার আছে আপনি যদি রাখেন তা হলে বলতে পারি।’ ‘নিশ্চয়ই বলবেনÑ আমি অবশ্যই তা রাখব।’ সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বিদ্রোহী কবিকে আমাকে দিতে হবে।’ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও সাথে সাথে বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি চাইলে তা-ই হবে, কবে কীভাবে আনতে চান সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ওপর বিশ্বাস রেখে বঙ্গবন্ধু সেভাবেই বাংলাদেশ থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তাফা সারওয়ারকে প্রধান করে একটি কমিটি ভারতে পাঠিয়ে দিলেন ১৯৭২ সালের মে মাসে।
ভারতে গিয়ে কমিটির লোকজন সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত বলার পর ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে কবিকে বাংলাদেশে আনার প্রস্তুতি চলছেÑ ইতোমধ্যে ভারতের নজরুলভক্তরা বিষয়টি জানতে পেরে তাতে বাধা দিতে চাইল। বাংলাদেশে কবিকে নেওয়া যাবে না বলে তারা সেখানে মিটিং-মিছিল ও প্রতিবাদ শুরু করলে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে সময়সূচিও বদলানো হলো, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতের বেলায় গোপনে বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় কবিকে। সেই রাতেই ২৪ মে কবির ৭৩তম জন্মদিনে বাংলাদেশে এসে পৌঁছলে বঙ্গবন্ধু কবিকে জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কবির সম্মুখে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। বাকরুদ্ধ কবির অসুস্থতা দেখে বঙ্গবন্ধুর অনেক খারাপ লেগেছিল। কবিও তখন দীর্ঘসময় ধরে অবাক দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়েছিলেন। অনেক রাজনৈতিক নেতা, জ্ঞানী-গুণীরা বলে থাকেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ কখনও এভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না। আমার কথা হলো বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এবং বঙ্গবন্ধু না থাকলে কবি নজরুল কখনও বাংলাদেশের জাতীয় কবি হতে পারতেন? না, অবশ্যই না। আজ সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো মহান স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রায় ৪৪ বছর গত হতে চলল, অথচ আজও আমরা দল মত নির্বিশেষে জাতির পিতাকে যথাযথ তার প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করতে শিখিনি।
যারা পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টের নির্মম হত্যাকা- সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে, জাতির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিভাজনের বিষবাষ্প, সে কারণেই রাতারাতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলে হয়ে যায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এসব ঘৃণ্য চক্রান্ত হয়েছিল পাক-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠীর দ্বারা। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন রাজনৈতিক প্রবল প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করার অশুভ অপকৌশল। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকদের মাঝে এমন সব জঘন্য মিথ্যাচারের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্তির শেষ সীমান্তে নিক্ষেপ করার কারণে আজও আমাদের জাতির পিতাকে খাটো করার, তার অমূল্য অবদানকে অস্বীকার করার দেশীয় আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী গোষ্ঠী অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য বঙ্গবন্ধু যে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন তা কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। অনন্তকাল বাঙালি জাতির ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এদেশের মাটি মানুষের গণদুশমনরা আজও ইতিহাস বিকৃতির ঘৃণ্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যাদের কোনো অতীত ইতিহাস নেই, রাজনৈতিক আদর্শ নেই। যারা এদেশের কল্যাণ চায় না, এদেশের উন্নয়নে বিশ্বাস করে না। তারা শুধু ধ্বংস করে দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় সারাক্ষণ সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে চায়। জাতির পিতা আর জাতীয় কবির সুদীর্ঘ অহিংস রক্তপাতহীন মানবিক আন্দোলন সংগ্রামের মূল সুরই ছিল অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সাম্য-শান্তি আর প্রগতির চিন্তা-চেতনায় কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন। এই আকাক্সক্ষায় সারাটি কাল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তির লড়াইয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। গণমানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে তারা অনেক নির্যাতিত হয়েছেন। তৎকালীন শাসকদের হাতে গ্রেফতার হয়ে দুজনই কিন্তু বহুবার কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে বহুবার। শারীরিক মানসিকভাবে অনেক নির্যাতন নিপীড়ন করেও তাদের কখনও দমাতে পারেনি কোনো স্বৈরশাসক গোষ্ঠী।
একজন হলেন বিদ্রোহী ও মানবতার কবি, আরেকজন হলেন দেশপ্রেমী ও রাজনীতির কবি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি নজরুলের সৃজনশীল মানসকে ধারণ করেছিলেন আর মনে-প্রাণে ভালোবেসেছিলেন বলেই তো আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল। কোনো সভ্য মানুষ কি কখনও অমন জঘন্য অপরাধ করতে পারে! যে তালকে স্বীকার করেন কিন্তু তালগাছকে অস্বীকার করেন! সারাবিশ্বে কোথাও এমন অমানবিক নজির আছে বলে আমার জানা নেই। এখানে একটি বিষয়কে সমগ্র জাতির কাছে স্পষ্ট করতে হবে যে, কখন কোথাও যদি বঙ্গবন্ধুর নাম আসে সেখানে নজরুলের নাম আসতে হবে তেমন কোনো কারণ নেই; কিন্তু জাতীয় কবি নজরুলের নাম এলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম অবশ্যই আসতে হবে। না হয় বিষয়টি হবে একেবারেই অসম্পূর্ণ এবং অগ্রহণযোগ্য। কারণ বঙ্গবন্ধুর বিশাল উদার দৃষ্টিভঙ্গি, প্রবল প্রজ্ঞা আর পরম মানবিক গুণাবলী ও মহতি উদ্যোগের ফলেই কবি নজরুল আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি। এ চরম সত্যকে যে বা যারা অস্বীকার করবে তারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশকেই অস্বীকার করবে। তাই রাষ্ট্রকেও অবশ্যই এসব অমীমাংসিত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি যে-ই হোন না কেন; যদি এ দেশের শ্যামল-কোমল এক সাগর রক্তে রাঙা পবিত্র মানচিত্রকে মানতে আপনার কষ্ট হয়, আপনি যদি এ পবিত্র ভূমিকে অস্বীকার করেন তবে এদেশে আপনার থাকা-খাওয়া আর মুক্ত জলবায়ু সেবনের অধিকার আপনার নেই। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভিনদেশি দালাল, গুপ্তঘাতক ধ্বংসের অপচেষ্টাকারী ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী গণদুশমনদের এদেশে কোনো স্থান নেই।