৭ই মার্চ ১৯৭১, একটি ভাষণ, একটি তর্জনীর গর্জন, রচিত হলো ‘বাংলাদেশ’ নামক এক মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ নাড়া দিয়েছিলো বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও সকল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে। ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিতে চলেছেন তা টের পেয়েছিলো বিশ্ব গণমাধ্যম মার্চে এর শুরু থেকেই। ১৯৭১ সালের ৫ই মার্চ লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘সানডে টাইমস, ‘দি অবজারভার’ এবং ৬ই মার্চ ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ৭ই মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ই মার্চ ’৭১ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হয় “শেখ মুজিবুর রহমান আগামিকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।” বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমে এ ভাষণকে একটি যুগান্তকারী দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ১) সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল।’ ২) কিউবার মহান বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ ৩) যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট যোশেফ মার্শাল টিটো বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোন রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’ (৪) ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে অন্যতম প্রেরণা হয়ে থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’ (৫) পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম-পরিকল্পনা।’ (৬) ঢাকাস্থ তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড লিখেছেন, “৭ই মার্চ মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কী বলেননি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি জানালেন।” (৭) শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি ও বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থক। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ই মার্চের ভাষণে।’ বিশ্ব নেতৃত্বের পাশাপাশি বিশ্ব গণমাধ্যমের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিলো ভৌগলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষের মুক্তির দলিলও। ১) নিউজ উইক, পত্রিকার নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’ এ বলা হয়েছে, ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’ ২) ১৯৭১ সালে দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ ৩) বিবিসি উল্লেখ করা হয়েছিলো, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’ ৪) রয়টার্স এর বিশ্বখ্যাত প্রতিনিধি মন্তব্য করেছেন-“বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথে দেশ পরিচালনার দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।’ ৫) ১৯৭১ সালেই এএফপি বলেছে, ‘৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’ ৬) ১৯৭২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’ ৭) টাইম ম্যাগাজিনে এই ভাষণ নিয়ে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঐ ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব এবং বিশ্ব গণমাধ্যমের উপলব্ধির পর ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত এই ভাষণটি প্রচণ্ড মাত্রায় উদ্দীপনার ও প্রেরণাদায়ক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। … রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অলিখিত এবং কোনো ধরণের পূর্ব প্রস্তুতিবিহীন। সামনে ছিল ১০ লাখ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে মরিয়া ১০ লাখ বাঙালি। বজ্রকঠিন শব্দে তৈরি প্রায় ১৮ মিনিটের ভাষণটি সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।