বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ 
বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সেই কাজের ছেলেটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

***
১৯৭১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার লিখেছিলেন, “দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পঙ্ক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা একটি অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব বাঙালি জাতির সমগ্র ইতিহাস।” 

***
বাংলাদেশে বহু মত থাকবে, বহু নেতা থাকবে এটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বির্তক থাকবে এটা কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আশা করেন না। একমাত্র অর্বাচীনরাই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করতে পারে। গোটা বিশ্ব জানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তাঁর জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখ-কে শুধু তাদের মানসে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহাঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মতো এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের সার্থকতা।

***
শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ এ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করা যায়? দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা শেখ মুজিবকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে পেরেছে; কিন্তু তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। তিনি আবার ফিরে এসেছেন ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়। কেননা শেখ মুজিব পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আর কলকাতার বেকার হোস্টেলে ‘বাংলাদেশ’ নিয়ে কথা বলছেন তারও কয়েক মাস আগে। যা জানা যায় শেখ মুজিবের লেখা আত্ম জীবনী থেকে। হাজার বছরের ইতিহাস শেখ মুজিবকে সৃষ্টি করেছে; আবার শেখ মুজিব হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাস নতুন করে সৃষ্টি করেছেন।

***
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক কবিতার পঙ্ক্তিমালা লিখেছেন। সারা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যা-কে চরম হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে দেখেছেন। কবি মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় লিখেছেন এভাবে, তাঁকে বার্লিনের এক ভায়োলিন বাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার পরিচয় কি? কবি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখিয়ে বলেছিলেন, এই আমার পরিচয়, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না।

***
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শব্দটি ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু বিশ্বের সকল বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সমগ্র বিশ্বের প্রগতিবাদী, শোষিত-বঞ্চিত মানুষ, নিপীড়িত মানুষ ঘাতকদের অভিশাপ দিয়েছিল। বিবিসি টেলিভিশনের দূরপ্রাচ্য সংবাদদাতা ব্রায়ন বারন বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েকদিন পর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে ঢাকা এসেছিলেন। তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তিন দিন আটক থাকার পর তাদের সবাইকে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত তাঁর সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়, 

"শেখ মুজিব সরকারীভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক চিহ্ন এবং কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে ।" (“দি লিসনার” লন্ডন, ২৮ আগস্ট, ১৯৭৫)।

***
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ এ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।কিন্তু সকলেরই স্মরণে থাকা দরকার, স্বাধীনতার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে যারা পরাজিত হয়েছিল, তারাই স্বাধীনতার পর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। কারোরই ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বঙ্গবন্ধুর পরাজয় মানে স্বাধীনতার মর্মসত্যের পরাজয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশকে পিছন দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যারা এখনো বলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মানুষ কাঁদেনি তারা হচ্ছেন জ্ঞানপাপী ও মতলববাজ। তারা ভাল করেই জানেন, এদেশের দুঃখী মানুষ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে।

***
কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন বাংলা একাডেমীতে ১৯৭৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতার লাইনগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তখন সমবেত সকলে প্রতিধ্বনি করেছিল। এই কবিতা আজ অনেকের কাছে হয়ত অতি পরিচিত, কিন্তু ওই সময়ে কবির কণ্ঠের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এক একটি শব্দব্রহ্মসম। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে উন্মুক্ত সভায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। সেই রকম একটি সময়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের সাহসী মশাল জ্বালিয়েছিলেন। ভাবা যায় না, সেসময় তিনি কি রকম সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন। 
“সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে, ভালবাসা আছে, 
শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, 
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। 
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।”

***
প্রয়াত লেখক আহমদ ছফার একটি বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থের নাম ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’।
এই গ্রন্থে তিনি উপস্থাপন করেছেন, 'বাহাত্তর সাল আর এখন এক নয়। বাহাত্তর সালে প্রতিক্রিয়ার শক্তি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মৌলবাদের অবস্থান ছিল তখন টলটলায়মান। এখন প্রতিক্রিয়ার শক্তি অনেক বেশি সংহত এবং সুসংহত এবং সংগঠিত। মৌলবাদ অক্টোপাসের মতো ক্রমাগতভাবে আমাদের সমাজকে চারপাশ থেকে বেষ্টন করে ফেলছে। যাঁরা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাঁদের কেউ কেউ দশভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।” 

সত্যি সত্যি আজকের বাংলাদেশে মৌলবাদীরা চারদিকে ফেলছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। সেরকম সময়ে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ অনেক মানুষ দরকার। প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী বেশ কিছু নেতা, যাদের নানান প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করার দৃঢ়তা থাকবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এ রকম বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। চার জাতীয় নেতা আপোস করেননি বলে তাঁদেরকে জেলখানার ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর সুগভীর চক্রান্ত থেকে মূলত বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা করা হয়েছিল।

***
মনে রাখা দরকার বাঙালী জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই অপশক্তি বাঙালী জাতিকে উল্টোরথের যাত্রী বানিয়েছে। স্বাধীনতার মর্মসত্য অবগাহন করতে হলে বঙ্গবন্ধুর চেতনার সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে হবে। বাঙালী জাতিসত্তা এই মহানামের মধ্যে প্রোথিত হয়ে আছে। তাই তো কবি মোহাম্মদ রফিক বাঙালী জাতির যথার্থ পরিচয়ের কথা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কাব্যময় মাধুর্যে ব্যক্ত করেছেন, 
‘বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’।

***
কবি অন্নদা শঙ্কর রায়ের ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ’ গ্রন্থ থেকে- 
"সাক্ষাৎকারের জন্য সেবার বঙ্গবন্ধুর দ্বারস্থ হই। তিনি আমাদের পরম আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন ও আমাদের বিচিত্র প্রশ্নে সহাস্য উত্তর দেন। কথায় কথায় বলেন, “আমার কাজ সারা হয়েছে। আমি আর থাকতে চাইনে। গ্রামে গ্রামে ঘুুরে বেড়াবো। দু’লাখ লোক আমার সঙ্গে ঘুরবে। কিন্তু আমাকে যেতে দিচ্ছে কে? আমাকে আটকে রেখেছে ওই যাদের দেখছেন ওরাই।” আঙ্গুল দিয়ে দেখান তাঁর দলের চাঁইদের কয়েকজনকে। হেসে হেসে ওঁদের দু’কথা শোনান। কোন নেতাই স্বয়ংসিদ্ধ নন। প্রত্যেকেরই একটা দল থাকে, দলের চাঁই থাকে। তাঁদের তিনি নাচান। তাঁকেও তারা নাচায়। সেদিন আমার সত্যি বিশ্বাস হলো যে, 'কাজের জন্যে মুজিব এসেছিলেন সে কাজ সারা হয়েছে। দেশকে তিনি মুক্ত করে দিয়েছেন। তাকে শাসন করবেন অন্য কেউ? তাঁর ধারে কাছে দাঁড়াতে পারেন এমন একজনও কি আছেন।' ইতিমধ্যে একদিন আমাদের নিজেদের একজন ডিপ্লোমাটের ভবনে আমার ভোজন। তিনি বলেন, ‘মুজিবুর রহমান যে কোনদিন নিহত হতে পারেন। ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনার বিষয়। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন এমন একজনকেও দেখছিনে?”
----------------------------------------------------------------

*** *** ***
"আমার এক জীবনে মুজিব সম্পর্কে সব কিছু জানতে পারবো কিনা আমি জানিনা। তবে এতটুকু বলতে পারবো যা জানি বা পড়ি তা জানাতে পারবো। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে একজন মহা মানবই আছে যার কথা যতবার বলি ও লিখি ততবারই শরীরের প্রতিটা রক্ত কনিকা শিহরিত হয় বিনম্র শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায়। এক মাত্র মুজিবকে নিয়েই বাঙালি বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে বলতে পারবে, 'আমি মুজিবের দেশের লোক, আমাকে চিনতে পেরেছ?' একমাত্র মুজিবকে নিয়েই অহংকার করে বাঙালি হাজার বছর পরও বলতে পারবে, আমাদের দেশে এক মহা মানব ছিল যার নাম মুজিব। যে ছিল বাংলাদেশ গড়ার কারিগর।"

SUMMARY

1244-B3.jpg