ড. শেখ আবদুস সালাম
৭ মার্চ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অম্লান এবং অনন্য দিন। এখন থেকে ৪৭ বছর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে এই দিন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তাঁর এই ভাষণটি ছিল মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক। সেই ভাষণ সম্প্রতি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বঐতিহ্যের অন্যতম দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে এই ভাষণের মূল্য এবং মাত্রিকতা আজ বাংলাদেশ তথা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধির পরিলেখ ছাপিয়ে গোটা বিশ্ববাসীর কাছে আরও উজ্জ্বলভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সেদিন এই ভাষণটি দিয়েছিলেন এক সীমাহীন মানসিক চাপসৃষ্ট পরিস্থিতির মধ্য থেকে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে আগেই পাকিস্তান সম্পর্কে তিনি কলকাতায় বেকার হোস্টেলে তাঁর এক বক্তৃতায় এই দেশটির প্রতি তাঁর আস্থাহীনতার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সেদিন থেকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সংগ্রাম করে, সংগঠন গড়ে, জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করে ৭ মার্চ তিনি এক পাগলপারা উত্তুঙ্গ সময়ে এসে তাঁর এই ভাষণ প্রদান করেছিলেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার কথা, সেখানে পাকিস্তানের জেনারেল আর রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে গিয়ে তাঁকে এই ভাষণ প্রদান করতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ করে স্থগিত ঘোষণা করলেন, সেদিন সারা পূর্ব বাংলার মানুষ যেন বারুদে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি লাগানোর মতো জ্বলে এবং গর্জে উঠল। বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ তৈরি হলো সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার। তখনই ঠিক হলো, বঙ্গবন্ধু যা বলার তা ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে বলবেন।
বঙ্গবন্ধু সে মতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এসে তাঁর ভাষণ প্রদান করলেন। দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে এই ভাষণ নিয়ে নানাজনে নানা রকম বিশ্নেষণ দাঁড় করিয়েছেন। এই ভাষণের পর নিউজউইকের এক প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছে 'রাজনীতির কবি' বলে। আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর 'স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে কবি হিসেবে বর্ণনা করে লিখেছেন- তাঁর কবিতা (৭ মার্চের ভাষণ) শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল লাখ লাখ ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা। ৭ মার্চের ভাষণে 'আর দাবায় রাখতে পারবা না' এই বাক্যাংশ উল্লেখ করে আহমদ ছফা লিখেছেন- বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই বাক্যাংশ হলো 'বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য'। কবি মোহাম্মদ সামাদও বঙ্গবন্ধুকে 'অমর কাব্যের কবি' বলে উল্লেখ করেছেন। আনিসুল হক তাঁর একটি লেখায় জানাচ্ছেন- এই ভাষণকে কবিতা বলার কারণ এই যে, কবিতার সংজ্ঞা হচ্ছে 'সুন্দরতম শব্দের মহত্তম বিন্যাস' (বেস্ট ওয়ার্ডস ইন বেস্ট ওয়ার্ডারস)। একটি ভালো কবিতার মতো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণে একটি শব্দও অতিরিক্ত বা কম ব্যবহার করা হয়নি যে কারণে সেখানে কোনো ছন্দপতনও ঘটেনি। এই ভাষণের প্রতিটি শব্দই যেন হয়ে উঠেছিল অনিবার্য এবং ছন্দময়। সেখানে একটিও পলিটিক্যালি রঙ বা রাজনৈতিকভাবে ভুল কথা বলা হয়নি।
এই কবিতায় যেন যোগাযোগের সব উপাদান ঠাঁই পেয়েছিল। সব মিলিয়ে আসলে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি কবিতা, একটি রাজনৈতিক যোগাযোগের কবিতা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি কেন রাজনৈতিক যোগাযোগের একটি কবিতা ছিল তা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক তাঁর 'সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ' শীর্ষক একটি লেখায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ১৮ থেকে ১৯ মিনিটের। ভাষণের প্রতিটি মিনিটে তিনি ৫০ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। ভাষণটি শুনলে কিংবা পড়লে বোঝা যায় এই ভাষণে কোনো বাহুল্য নেই, পুনরাবৃত্তি নেই; ছিল শুধু সারকথা। ভাষণটিতে শব্দের দু'একটি পুনরাবৃত্তি যা ঘটেছিল তা ছিল তাঁর বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করার জন্য এবং তা ছিল সাবলীল, ছন্দময় ও সামঞ্জম্যপূর্ণ। যোগাযোগের তত্ত্ব বা মডেল অনুযায়ী বক্তব্যের সূচনায় শ্রোতার মানসিক অবস্থানের সঙ্গে ঘটনার সামঞ্জস্যের বিচ্ছুরণ থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে 'ভায়েরা আমার' শব্দদ্বয় দিয়ে টোটাল অডিয়েন্স অ্যাটেনশন ঘটিয়ে তিনি সেদিন সারা পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সেই সভায় উপস্থিত সব শ্রোতা এবং বাংলার মানুষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ভাষণের ইনট্রো হিসেবে প্রথম এই বাক্যটি ছিল আবেগী, গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং নিজে শ্রোতা-দর্শকের সঙ্গে একীভূত হয়ে তাঁর প্রতি তাদের মনোযোগী করে ফেলার এক অনন্য কৌশল।
তাত্ত্বিকভাবে জনযোগাযোগে speech idiom থাকা আবশ্যক। এই কবি যোগাযোগবিদ সেদিন তাঁর বক্তব্যে অন্তত ৫টি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন : কী অন্যায় করেছিলাম? কী পেলাম আমরা? কার সঙ্গে বসব? ইত্যাদি। এর মধ্য দিয়ে তিনি সেদিন নিজেই প্রশ্ন করে আবার নিজেই তার উত্তর দিয়ে চমৎকার এক বুননে বক্তার সঙ্গে শ্রোতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। যোগাযোগতত্ত্বের ধারায় তাঁর বক্তব্যে তিনি সেদিন সংক্ষিপ্তভাবে ঘোষণামূলক বাক্যও ব্যবহার করেছিলেন- আমি যা বলি তা মানতে হবে; খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো, কেউ দেবে না ইত্যাদি। যোগাযোগতত্ত্ব অনুযায়ী বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে গেলে put up the attribution first-র নিয়মনীতিও বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সেদিন যথার্থভাবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি সেদিন গণমাধ্যমে agenda setting function-এর অনুসরণে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। বক্তৃতার নির্দিষ্ট অংশে তিনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলে তিনি তাঁর বক্তব্যে চ্যালেঞ্জও উত্থাপন করেছিলেন। গণমাধ্যম ও যোগাযোগতত্ত্বের ধারণায় কোনো বক্তব্য-বিবৃতিতে এগুলো থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এগুলো সবই ছিল। অধ্যাপক সিদ্দিক পূর্বে উল্লিখিত তাঁর ওই লেখায় এই বিষয়গুলো আরও বিস্তৃত করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন একজন রাজনীতিক। কবিরা তাঁর ৭ মার্চের ভাষণকে উল্লেখ করেছেন কবিতা হিসেবে। যোগাযোগবিদরা জনযোগাযোগের তাত্ত্বিক কাঠামোয় ফেলে এই ভাষণকে বিশ্নেষণ করলেন যোগাযোগ শাস্ত্রের স্বীয় ফ্রেমে ফেলে। এসব বিশ্নেষণ একেবারেই যুক্তিপূর্ণ এবং খাঁটি। সে কারণে আমরা ৭ মার্চের ভাষণকে 'এক রাজনীতির কবির একটি যোগাযোগ কবিতা'- এই অভিধায় অভিহিত করতে চাই।
লেখকঃ অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল