বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : কালজয়ী মহাকাব্য


বহু বছরের শোষণ-বঞ্চনা-অবহেলার ফলে বাঙালি যখন পাকিস্তানিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে; সেই সময়ে একজন জীবন্ত রাজনৈতিক কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী ওদ্যান) জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। শোনালেন বহু কাঙ্ক্ষিত অমর বাণী।
তিনি সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি সমেত কোট গায়ে শোনালেন বাঙালির মুক্তির কিছু পঙক্তি। শিহরণ জাগালেন সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে। চূড়ান্ত লক্ষে এগুনোর শক্তি যোগালেন সমস্ত বাঙালিকে। দৃপ্ত পায়ে ভরাট কণ্ঠে তিনি বলে গেলেন, `ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ বাকিটা ইতিহাস।

বাঙালি যখন স্বাধীনতা-স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে দ্বিধান্বিত তখন শেখ মুজিব গেয়ে উঠলেন মূল পাঠ। সেই থেকেই স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের মানে বাঙালির। অথচ এ কালজয়ী মহাকাব্য লিখতে কবির ছিল না কোনো প্রস্তুতি। মনের কোনে যাবতীয় ক্ষোভ তিনি তৎনগদ উগড়ে দিলেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী ভাষণে পরবর্তী সব করণীয় ঠিক করে দিলেন। বাঙালি জাতি বুঝে গেল আর পেছনে ফিরে তাকানো যাবে না। পাকিস্তানিরাও বুঝে গেল আঙুল উচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঠিকই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন।

অথচ প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বসে আছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী দলটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করছে। তাদের উদ্দেশ্য, যেকোনোভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কুক্ষিগত রাখা। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। পরক্ষণেই অপ্রত্যাশিতভাবে ১ মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় জনতার জোয়ার নামে। পুরো ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। এমন ক্ষণে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ও অমর কবিতাখানি বলে যান।

ওই ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব হয়ে মরণপণ লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ার প্রেরণা যোগায়। তারা বুঝে যায় প্রিয় কবি স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দিয়েছেন। তারা রক্তে এক ধরণের নাচন অনুভব করেন। কেন হবে না। চরম ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন দেশের প্রিয় কোনো সারথি যখন এমন উচ্চারণ করেন; তখন স্বভাবতই আর দ্বিধা থাকে না। কবি যখন বলে যান, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ তখন বাংলার মানুষকে তা না চাইলেও চাইতে হয়!

কবি যখন বলেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল— প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু— আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না।  সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’

পাকিস্তানি আমাদের দাবায়ে রাখতে পারেনি। আর এর পেছনে সর্বাগ্রে অবদান কবির অমর কবিতাখানির। কবি চাননি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব। চাননি ক্ষমতা। চেয়েছেন ন্যায্য অধিকার। সম্পদের সুষম বণ্টন। কিন্তু তা কখনো হয়নি।

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় লিখেন, ‘‘একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল/প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?/শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে—জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী?/গণসূয্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। /সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’’

আঙুল উচিয়ে সেদিনের সেই অমর কবিতা গেয়ে বাংলার ভাণ্ডারে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন শেখ মুজিব। নিউজউইক ম্যাগাজিন যাকে বলেছে রাজনীতির কবি। এ কবির অলিখিত কবিতা পাঠের ফসল বাংলার মুক্তি ও স্বাধীনতা।

কবির ওইদিনের কবিতা পাঠকে ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর ইউনেস্কো ‘ডকুমেন্টারী হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

জীবিত শ্রেষ্ঠ দশ বাঙালির একজন, বিশিষ্ট লেখক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, গবেষক  এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর এমন স্বীকৃতিতে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নয় বরং ইউনেস্কোই এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়েছে। কারণ এখন তাদের কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি আছে, এমনটা তারা বলতে পারবে।’

আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ এই ভাষণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে চতুর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তী সময়ে দিয়েছেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ওই ঘটনা বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, আপনার কি ইচ্ছা ছিল, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন? জবাবে শেখ মুজিব বলেন, আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার। ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত? শেখ মুজিব উত্তর দেন, বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে পাকিস্তানিদের এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।

ওই ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার মাধ্যমে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

পরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাদীনতা শব্দটি বাঙালির হয়ে যায়।

৭ মার্চের ভাষণের রয়েছে অনেক বৈশিষ্ট্য। তার কতক—

১. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল নির্যাতিত একটি জাতির করণীয় ও নির্দেশনামূলক ভাষণ। এর দ্বারা একটি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উজ্জ্বীবিত হয়েছিল।

২. এক হাজার ১০৫টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত ও মাত্র ১৮ মিনিটের এই ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত।

৩. এই ভাষণে ছিল কাব্যিকতা। শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে তা হয়ে ওঠেছিল গীতিময়। শ্রবণে তা মধুর হয়ে ধরা দিয়েছিল।

৪. ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টার। ভাষণটি পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম।

৫. আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field, We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে অন্যদের মধ্যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), জোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লাদিমির লেনিন (রাশিয়া), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), উইড্রো উইলসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সেতুং (গণচীন), হো চি মিন (ভিয়েতনাম) প্রমুখ নেতার বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

৬. ২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রয়েছে।

৭. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়েছে।

৮. বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল কালোত্তীর্ণ। এ ভাষণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়। এটি সর্বকালের, সকল সময়ের। কেননা, যুগে যুগে এই ভাষণ পৃথিবীর যেকোনো স্থানের স্বাধীনতাকামীদের জন্য প্রেরণাদায়ী।

৭ মার্চের ভাষণ একটি মহাকাব্য। একটি ভাষণ কীভাবে একটি জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৭ মার্চের ভাষণ। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় এ এক কালজয়ী মহাকাব্য। এ ভাষণের দ্বারাই আঙুল উচিয়ে এক বাঙালি মহাকবির ইতিহাস হয়ে উঠা, বিশ্বের হয়ে উঠা। এবং বাংলার প্রান্তর ও স্বাধীনতা সমার্থক হয়ে উঠা। স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হয়ে উঠা।

SUMMARY

1240-4.jpg