‘জয় বাংলা’ অবিনাশী স্লোগান

হাশেম খান 


মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছিলাম তার চুয়াল্লিশ বছর হয়ে গেল। স্বাধীনতার সুফলকে যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। কারণ আমাদের শত্র“রা পরাজিত হওয়ার পর থেকেই যেভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তি অর্জন করেছিল পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য-
আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এবং সে সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। শুধু তাই নয়, এমনকি অনেক সময় তাদের অপরাধকেও পরোক্ষ আস্কারা দেয়া হয়েছে। ফলে বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে তারা হত্যা করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে আমরা যে কত পিছিয়ে গেছি সেটা তখন তথাকথিত সচেতন অনেকেই উপলব্ধি পর্যন্ত করতে পারেননি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে বাংলাদেশ বেতারে যখন ডালিমের গলায় শুনলাম-‘রেডিও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ তখনই আমার মনে হয়েছিল- সর্বনাশ! এই খুনিরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, তার পরিবারের সদস্যদেরকেই হত্যা করেনি- পুরো বাংলাদেশকে এরা হত্যা করেছে!! তা না হলে ‘জয় বাংলা’ সেদিন উঠে যেত না, এই হত্যার সঙ্গে সঙ্গে। আমরা যাদের গুণীজ্ঞানী বলি এ ঘটনার পর তারাও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি মুখে আনতেন না। আমি আমার কাজের জায়গাতে সবসময় ‘জয় বাংলা’কে স্থান দিয়েছি। আমার ছবি, আমার বক্তব্যে ‘জয় বাংলা’কে তুলে ধরার জন্য আমার বন্ধুদের অনেকেই আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন। তারা ‘জয় বাংলা’ বলতে ভয় পেতেন। আমি ‘জয় বাংলা’ একদিনের জন্যও ছেড়ে দেইনি। তারা বলত, সময় বুঝে কথা বলবেন না? আমি তাদের এই ভর্ৎসনার বিরুদ্ধে বলেছি, কেন ভয়, কিসের সময় যার অজুহাত তুলে মুক্তিযুদ্ধের এই গৌরবময় স্লোগানকে বিসর্জন দেব?
এই যুদ্ধাপরাধী আলবদর, রাজাকাররা, যারা বাংলাদেশকে স্বীকারই করেনি তারা একটা মিথ্যাকে অপপ্রচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে যে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন- এটা সত্য নয়।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় এই যুদ্ধাপরাধীরা ধীরে ধীরে এদেশের মানুষের চিন্তার জগতে ঢুকে বাংলাদেশের মানুষকে বিপথে পরিচালিত এবং ইতিহাস বিকৃতি থেকে শুরু করে বহু অপরাধ ঘটিয়েছে। সামরিক শাসকরা করেছে, পরে নব্বইয়ের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত একজোট হয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে অপমানিত ও কলঙ্কিত করেছে। এটা আমাদের একটা বিশাল পরাজয়। আর এই পরাজয়কে পরাভূত করেছেন অত্যন্ত সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর কেউ নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছিল যেন এক অসম্ভব কাজ- এমন ধারণা ছিল সবার। আমেরিকা রেগে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য অসন্তুষ্ট হবে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আমাদের শ্রমিকদের সেনব দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে- এমন হাজারও আশঙ্কার কথা বলা হতো কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের পায়ের তলায় মাটি আছে। এই মাটিই আমাদের ভরসা। আমরা আমাদের সম্পদ দিয়ে আমাদের সমস্যা সমাধান করব। গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরকার সশস্ত্র রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল- কার না আপত্তি ছিল- কিন্তু অটল থেকে প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। আমি বলব নতুন করে একটি মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছে তার নেতৃত্বে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে চলেছি।
আজ চুয়াল্লিশ বছর পর আমি বলব, অনেক দেরিতে হলেও আমাদের তরুণ প্রজন্ম বুঝেছেন, জেগেছেন। তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে উদীপ্ত-উজ্জীবিত হয়ে পথে নেমেছেন। ৩০ লাখ শহীদ, ৪ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগে সম্মিলিত মানুষের সাহসের অবিনাশী আওয়াজ ‘জয় বাংলা’কে তারা আবার ফিরিয়ে এনেছেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

SUMMARY

1235-1.jpg