বিশ্ব কাঁপানো সেই স্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’

মোহাম্মদ এবাদুল করিম বুলবুল


ব্রিটিশদের উপনিবেশ বিভাজনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই মূলত ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত ও জাতিগত অস্তিত্বকে অস্বীকার করে পশ্চিমা মুসলিম লীগের শাসকগোষ্ঠী শুধু ধর্মকে পুঁজি করে পূর্বাঞ্চলের জনগণকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও দৈনন্দিন জীবনমানসহ সব ক্ষেত্রে শোষণ-নির্যাতন ও জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি করে দাবিয়ে রেখে অস্তিত্বহীন এক জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল। দীর্ঘ ২৩ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ, নির্যাতন, নিষ্ঠুর অত্যাচার, অবহেলা, বঞ্চনাসহ নানা বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতি তাদের বিনাশী শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে প্রতিবাদে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির মুক্তির দিশারি হয়ে কল্যাণকারী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সব ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠীর নেতাকর্মী ও জনসাধারণকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলমন্ত্রের এক রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করে। ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন। সর্বোপরি জাতির জনকের ৭ই মার্চের ভাষণ। এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় এক কাতারে দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটা বাঙালি জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আর এসব ঘটনার ভেতর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, যা ধাপে ধাপে রূপ নেয় স্বাধীনতাসংগ্রামে।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চরমপত্র ঘোষণা করে জগত্বাসীর কাছে প্রতিবাদ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের এই ভাষণে এত কুশলী শব্দচয়ন, এত অনন্যসাধারণ প্রত্যয়দৃঢ় উচ্চারণ স্বাধীনতা ও গেরিলা যুদ্ধের এমন স্পষ্ট দিকনির্দেশনা—এটিই ছিল মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য প্রদর্শিত রণকৌশল। তিনি সুনিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তাঁর প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লা।’ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জয় বাংলা। ৭ই মার্চের এই ভাষণ ছিল একটি গেরিলাযুদ্ধের রূপরেখা।

৫৫ হাজার বর্গমাইলের এ বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে মুক্ত করতে; যাদের হাতে ছিল না কোনো আধুনিক অস্ত্র। পুঁজি বলতে শুধুই ছিল দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার তীব্র বাসনা। তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটা বাঙালি জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান জনগণকে মুক্তিসংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল, বাঙালি জাতির হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়েছিল। বীর বাঙালির রক্তে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। অমিততেজী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠত পুরো বাংলা। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বিশ্ব কাঁপানো এক স্লোগান। এর আগে বাঙালি জাতি কখনো এত তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি। জীবিত প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার কাছে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে সব গোলাবারুদের চেয়েও হাজার গুণ শক্তি জুগিয়েছে ৭ই মার্চের ভাষণ এবং তার সঙ্গে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান। এ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান বাংলার জাগ্রত জনতার উদ্বেলিত চিত্তকেই শুধু তুলে ধরেনি—এ স্লোগানই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার চেতনা শাণিত করেছে।

পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধে এ বাংলার শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে যে ভয়ংকর নিষ্ঠুর অত্যাচার, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও ধষর্ণের মতো বীভৎস খেলায় মত্ত হয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সেই পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে যখন মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে বাঙালি জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার সেনাবাহিনী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নিজের রিভলবার জমা দেয়, তখন এ দেশের লাখো শহীদের আত্মাও যেন বলে উঠেছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা—একই সূত্রে গাঁথা তিনটি শব্দ। বাঙালির মুক্তি আর গৌরবময় পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ৭ই মার্চ ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ৯ মাস জনযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধের পথ অনুসরণ করে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ আর চার লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করে স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকাকে ছিনিয়ে এনেছিল এ বাংলার সূর্যসন্তানরা। সবুজের বুকে লাল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান থাকবে চিরকাল। সেই থেকে ‘বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু’ ইতিহাসে সমার্থক শব্দ হয়ে আছে। এ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশপ্রেম প্রকাশের ঐক্যের প্রতীক। এ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান কোনোভাবে কোনো একটি দলের স্লোগান হতে পারে না। এ স্লোগান সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্লোগান, আপামর জনসাধারণের স্লোগান, রাষ্ট্রীয় স্লোগান। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ু্ল’ স্লোগানকে সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি শুরু করতে হবে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে।

লেখক : আওয়ামী কৃষক লীগ নেতা, সংসদ সদস্য ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

SUMMARY

1232-1.jpg