জয় বাংলা যেভাবে বাংলাদেশ হলো


আলমগীর নিষাদ

‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে একটি ভুল ধারণার প্রচার আছে। মনে করা হচ্ছে, এই স্লোগানের উৎপত্তি নজরুলের কবিতা থেকে। কিন্তু স্লোগানটি এসেছে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে। ’৬৮-৬৯-এ দেশব্যাপী স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’র মতো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিও ছাত্রলীগের মিছিল থেকে উঠে আসা।  পাকিস্তান জিন্দাবাদের বিকল্প একটি ধ্বনির তাগিদ থেকে স্বাধীনতার ঈঙ্গিতবাহী এই সামরিক রণধ্বনির উদ্ভব হয়।  ভারত ও পাকিস্তানের নানা জাতিগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রাজপথ হলো এর উৎপত্তি আধার।  জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, বঙ্গবন্ধু উপাধিসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অধিকাংশ সাংস্কৃতিক ধারণা ও মিথ প্রত্যক্ষ ময়দান থেকে এসেছে। এর কোনো একক স্রষ্টা হয় না।  কখনো কখনো তা ব্যক্তি-উৎসারিত হলেও ইতিহাস বিজ্ঞানে এ ধরনের পঙক্তিকে বলে কালেকটিভ ওয়ার্কস বা যূথ-রচনা। এর উৎপত্তিস্থল সংগ্রামশীল মানুষের মন। তাই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের জন্য যদি কাউকে কৃতিত্ব দিতে হয়, তা দিতে হবে এককভাবে ছাত্রলীগকে।

তবে ইতিহাস এই স্লোগানের প্রথম উচ্চারণকারী ছাত্রলীগ নেতা আফতাব আহমাদকে এর উদগাতার কৃতিত্ব দেয়।  ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবসের প্রস্তুতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মিসভায় আফতাব আহমাদ এই স্লোগান প্রথম উচ্চারণ করেন। আফতাব আহমাদের সেদিনের সেই স্লোগানের প্রথম প্রতিউত্তর করেছিলেন চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীস্তর থেকে আকস্মিকভাবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।  ঘটনাস্থলে উপস্থিত যাদের নাম পাওয়া যায় পারস্পরিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সবাইকে সুনির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। তবে মোটামুটি নিশ্চিতদের মধ্যে আ ফ ম মাহবুবুল হক, গোলাম ফারুক, রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক, শামসুদ্দিন পেয়ারা, রায়হান ফিরদাউস মধু, ইউসুফ সালাহউদ্দিন, মোস্তফা জব্বার, বদিউল আলমের নাম উল্লেখযোগ্য। আফতাব আহমাদের ওই অংশটির নেতৃত্ব দিতেন আ ফ ম মাহবুবুল হক। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ‘নিউক্লিয়াস’ দলের স্বাধীন বাংলার আকাঙ্ক্ষা থেকে এই স্লোগানের উৎপত্তি। এই স্লোগানের উদ্ভব ও প্রচলনের ইতিহাস খুব প্রত্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্টদের অনেকে এখনো জীবিত আছেন, তাই বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই।

২০১১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের জয়বাংলা স্লোগান নজরুলের কবিতা থেকে নেয়া’ মন্তব্যের পর সম্ভবত দ্বিতীয় মতের উদ্ভব হয়। ২০১৫ সালে নজরুলের ১১৬তম জন্মবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী আবারো বলেন ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জয় বাংলা স্লোগান দিতাম সেটি কবি নজরুলের একটি কবিতা থেকে বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন।’ শেখ মুজিবুর রহমান জয়বাংলা স্লোগানটি গ্রহণ ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এ কথা সত্য, তবে তা নজরুলের কবিতা থেকে নয়, নিয়েছিলেন ছাত্রলীগের মিছিল থেকে। আর, ছাত্রলীগও নজরুলের কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্লোগানটি প্রণয়ন করেনি।  আমাদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মুজিবের নামে আমরা অনেক কিছু চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।  ইতিহাসের ধারা পরিবর্তনের এই প্রবণতা গণসংগ্রামে সৃষ্ট একটি জাতির জন্য আত্মঘাতী। কোনো ঘটনার সাথে নৈকট্য ও বিষয়ে শব্দ-সাদৃশ্য পেলে এভাবে ইতিহাস তৈরির চেষ্টার নামও ইতিহাস বিকৃতি। বাঙালির জাতি হয়ে ওঠার ইতিহাসের সম্মানে এই ধারণা অঙ্কুরে সমাপ্ত হওয়া দরকার।

উচ্চারণ, উৎপত্তি ও উৎস

২০০৭ সালে আফতাব আহমাদ স্মরণে শামসুদ্দিন পেয়ারা সম্পাদিত ‘নক্ষত্রের দিন শেষ হয়’ গ্রন্থের বিভিন্ন লেখায় আফতাব আহমাদকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের প্রবর্তক বলা হয়েছে। এই গ্রন্থের লেখকদের কয়েকজন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ মুহূর্তের প্রত্যক্ষদর্শী এবং আফতাব আহমাদের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ ছিলেন।  ‘জয়বাংলা স্লোগানে বেঁচে থাকবে আফতাব’ শিরোনামে গ্রন্থের ভূমিকায় শামসুদ্দিন পেয়ারা লিখেছেন, ‘জয়বাংলা স্লোগানটির একক উদগাতা ছিল আফতাব’।  ওই গ্রন্থের ‘তিন যুগের বন্ধু’ নিবন্ধে মুহাম্মদ জালাল স্লোগানটি প্রথম উচ্চারণ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘’(১৯৬৯-এর) সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখে মধুর ক্যান্টিনে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।  মধুর ক্যান্টিনের ভেতরে সভা চলছে।  বাইরে আফতাব ভাই অস্থিরভাবে পাঁয়চারী করছেন।  চিশতি হেলালুর রহমানকে ডেকে শলা পরামর্শ করলেন।  চিশতি ভাইকে মধুর ক্যান্টিনের এক প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিলেন।  নিজে অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুললেন ‘জয় বাংলা’। অপরপ্রান্ত থেকে চিশতি ভাই ‘জয় বাংলা’ বলে সাড়া দিলেন।  এভাবে আফতাব ভাইয়ের তৈরি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্লোগানে পরিণত হয়।  জয় বাংলা স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হওয়ার সময়, যতদূর মনে পড়ে, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। আবার নাও থাকতে পারি। হয়তো পরে এসে শুনেছি।  তখনকার মিছিল-মিটিংয়ে আমরা নেই- এমন খুব কমই ঘটেছে।  কাজেই, কোন ঘটনাটি আমাদের সামনে ঘটেছে, কোন ঘটনাটি পরে এসে শুনেছি- পরে সুনির্দিষ্ট করে মনে করতে পারিনি। এ ধরণের বিভ্রম সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।’’

জয় বাংলা স্লোগানের সৃষ্টি মুহূর্তের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী রায়হান ফিরদাউস মধু।  ‘জয় বাংলা স্লোগানের জন্মদিন’ স্বতন্ত্র নিবন্ধে তিনি এর প্রবর্তন ও উৎপত্তির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।  ‘’১৯৬৯ সালের শরৎকালের এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আয়োজনে একটি কর্মিসভা চলছিল।  ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির ঠিক মধ্যিখানে, এখন যেখানে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক সেখানে।  উদ্দেশ্য ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবসটি সুন্দর, সফল এবং ব্যাপকভাবে পালন করার প্রস্তুতি নেয়া। কর্মিসভাটি চলছিল স্বাভাবিক গতিতে।  উনসত্তরের সফল গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রলীগ তখন তরুণ ছাত্রকর্মীদের সব চাইতে নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  সুতরাং কর্মিসভাটির আকার হয়ে উঠেছিল বিরাট। নেতাদের বক্তৃতার মাঝে মাঝে চলছিল স্লোগান; সে স্লোগান ধ্বনিতে কেঁপে উঠছিল আশপাশ।  এরই এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের প্রতিভাবান জ্যেষ্ঠ সংগঠক আফতাব প্রায় সবাইকে চমকে দিয়ে স্লোগান দিলেন, ‘জয় বাংলা’।  আমরা জনা সাতেক কর্মী প্রতিধ্বনি দিলাম ‘জয় বাংলা’ বলে। এরপর আফতাব বেশ কয়েকবার এই স্লোগানটি দেন এবং শেষের দিকে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীরা এর প্রত্যুত্তর দেন।‘’

স্লোগানটির উৎপত্তি ও উৎস সম্পর্কে রায়হান ফিরদাউস মধু আরো লিখেছেন, ‘’ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার ফলে জাতীয় বীর হিসেবে শেখ মুজিবের উজ্জ্বল উত্থান তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।  বাংলার জনগণমন অধিনায়ক বঙ্গবন্ধু এর পরই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যান বাইশ সদস্যের এক বিরাট দল নিয়ে। সেই সফরে তার সঙ্গী হয়েছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ। তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার প্রয়াস নেন।  বিশেষ করে সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচিতে বসবাসকারী বাঙালি ছাত্রদের নিয়ে ছাত্রলীগের কমিটিও করেন।  নির্বাচন করে দেন বেশ কয়েকটি স্লোগান। তারমধ্যে অন্যতম ছিলো- ‘তোমার আমার ঠিকানা, সিন্ধু মেঘনা যমুনা’। সেখানে পাকিস্তানের অনেক নেতার সঙ্গে ছাত্রনেতা রউফের সাক্ষাৎ হয়।  তবে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত হন তখনকার সিন্ধি নেতা জি এম সাইদের সাথে পরিচিত হয়ে। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা সিন্ধি জনসাধারণের সবচাইতে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘জিয়ে সিন্ধ’।  ঢাকায় ফিরে এসে ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ তার পশ্চিম পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন নেতৃস্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে।  কীভাবে এক ইউনিটের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষ, বিশেষ করে বেলুচিস্তান এবং সিন্ধের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করছে, ।বিশেষ করে সিন্ধি জনগণের প্রাণপ্রিয় স্লোগান জিয়ে সিন্ধের কথাও তিনি আবেগ দিয়ে বর্ণনা করেন।  উপস্থিত ছাত্রনেতা কর্মীদের মধ্যে হাজির ছিলেন জিন্নাহ হলের (সূর্য সেন হল) ছাত্র আফতাব। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব রাখার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, রউফ ভাই সিন্ধিরা যদি জিয়ে সিন্ধ স্লোগান দিতে পারে, তাহলে আমরা বাঙালিরা জয় বাংলা স্লোগান দিতেই পারি।  সেই থেকেই শুরু তার একক অভিযান ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মুখ্য স্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার।  তারই ফলশ্রুতি ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালের এই দিনে আফতাবের কণ্ঠেই সর্বপ্রথম উত্থিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধ্বনি।  তাই প্রকৃতপ্রস্তাবে তিনিই জয় বাংলা স্লোগানের উদগাতা।’’

শামসুদ্দিন পেয়ারা এই অংশের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘ওইদিন মধুর ক্যান্টিনে আবদুর রউফ পশ্চিম পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা শেষে চলে যাওয়ার পর আফতাব, আমি এবং আরো দুজন মধুর ক্যান্টিনের ওই টেবিলে বসে ছিলাম। আলোচনার রেশ তখনো ছিল, সেই সময় আফতাব জয় বাংলাকে স্লোগান করার কথা তোলেন।  এবং পরে তার কণ্ঠেই তা বাস্তবায়িত হয়।’

জয় বাংলা স্লোগান সৃষ্টির আরেক সাক্ষী মোস্তফা জব্বারও তার ‘একাত্তর ও আমার যুদ্ধ’ বইয়ে এসব মতের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘জয় বাংলা স্লোগান প্রথম উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে আফতাব আহমাদের নামটি তৎকালীন ছাত্রলীগ মহলে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ঘটনাটি যেহেতু আমার এবং আমার আরো অনেক জীবিত বন্ধুর চোখের সামনেই ঘটেছে, সেহেতু জয় বাংলা স্লোগান দেবার সাথে আফতাবের সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার করার বিষয়টি মেনে নিতে পারি না। ’

তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৬৮-‘৬৯ থেকে একাত্তর পর্যন্ত মিছিলে স্লোগান দেয়ার কাজে লিড নিতেন এই আফতাব। সে সময় আ ফ ম মাহবুবুল হক, গোলাম ফারুক, আফতাব আহমাদ, চিশতি শাহ হেলালুর রহমানকে বলা হতো স্লোগান মাস্টার।  নতুন নতুন স্লোগান উদ্ভাবনেও তাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার নামও ভেবেছিলেন আফতাব, স্বাধীনতার পর যা জাসদের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়।

জয় বাংলার উৎপত্তি সম্পর্কে হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যও স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘’তৎকালীন ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রনেতারা জয় বাংলা স্লোগানের আবিষ্কারক। এর সাথে নজরুলের কবিতার কোনো সম্পর্ক নেই। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বিপরীতে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে এই রণধ্বনিটি তৈরি করা হয়।  এটি ছাত্রলীগের সম্মিলিত রচনা। ‘’উৎস সম্পর্কেও ইনুর প্রত্যয় পরিষ্কার, ‘’এর পেছনে পাকিস্তানের করাচির জনপ্রিয় ‘জিয়ে সিন্ধ’ স্লোগানের প্রভাব রয়েছে।’’

মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইয়ে জয় বাংলা স্লোগানের ইতিহাস ও উৎপত্তি সম্পর্কে একই বয়ান পাওয়া যায়। তার ভাষ্য, ‘’১৯৬৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে তিন  দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে।  প্রথম দিন, অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে একটা সাধারণ ছাত্রসভা ডাকা হয়।  সভা শুরু হলে জিন্নাহ হলের (পরবর্তী নাম সূর্য সেন হল) ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমাদ সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘জয় বাংলা’। ইকবাল হলের (পরবর্তী নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দেন ‘জয় বাংলা’ বলে।  এভাবে তারা কয়েকবার স্লোগানটা দেন।  ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে ঘটে যায়।’’ উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি ইঙ্গিত করেন, ‘এর আগে জিয়ে সিন্ধ স্লোগানটি দিয়ে সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা জি এম সৈয়দ পাকিস্তানি শাসকদের কোপানলে পড়েছিলেন।’

আবু সাঈদ খানের ‘স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি’ গবেষণা গ্রন্থেও ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের প্রবর্তক হিসেবে ছাত্রলীগকে একক কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘৬৯ সালের গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি গ্রুপটি এই ধ্বনি তোলে।’

আফতাব আহমাদের জয় বাংলা স্লোগান চালু করার বিষয়টি কারো অজানা ছিল না- তা  বশির আহাম্মেদের কাছ থেকেও জানা যায়। ‘নক্ষত্রের দিন শেষ হয়’ বইয়ের ‘একজন আধুনিক সফিস্টের মর্মান্তিক প্রয়াণ’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘’জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে একবার (১৯৯৬ সালে) সারাদেশে হৈ চৈ সৃষ্টি করা হয়েছিল। আফতাব স্যারের বক্তব্য অনুধাবন না করেই কিছু পণ্ডিতমূর্খ হৈ চৈ সৃষ্টিতে ইন্ধন দিয়েছিল।  অবস্থা এমন হয়েছিল যে স্যারের কক্ষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিয়েছিল কিছু বিপথগামী ছাত্র, যার ইন্ধনদাতা ছিল এই পণ্ডিত মূর্খরা। স্যারের কক্ষে আগুন জ্বালানোর পর শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ডেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রফেসর আফতাবকে নিয়ে যেন আর বাড়াবাড়ি না করা হয়।  ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন কেন? শেখ হাসিনা তখন ছাত্রলীগ নেতাদের জানিয়ে দেন আফতাব স্যার কর্তৃক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান প্রবর্তনের কথা। অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীই তা জানত না। এই তথ্য আমাকে দিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক, যিনি বর্তমানে এলডিপি-এর একজন প্রথম সারির নেতা।’’

তৎকালীন ও পরবর্তী ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও রাজনীতি গবেষকদের রচনা ও বক্তব্যে জয় বাংলা স্লোগানের উৎপত্তির ভাষ্য মূলগতভাবে একই। তাদের বয়ানে, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের জিয়ে সিন্ধ বা জ্যায় সিন্ধ স্লোগানের ভাবধারা থেকে জয় বাংলা স্লোগানটি সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘জয় হিন্দ’ ‘ভারত মাতা কি জয়’ ‘মহাত্মাজী কি জয়’ ‘নেতাজী কি জয়’ প্রভৃতি স্লোগানের প্রচলন থাকলেও  জয় বাংলা স্লোগানের আগমন ঘটেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তাদের বক্তব্য,  স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা নজরুলের কবিতা দ্বারা উদ্দীপ্ত ছিলেন, কিন্তু জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে নজরুলের কবিতার কোনো সংশ্রব নেই। কোনো সম্পর্কের কথাও তাদের জানা ছিল না। সেদিন আফতাব আহমাদের মুখে উচ্চারিত স্লোগানটি ধীরে ধীরে সবার হয়ে ওঠে। একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাতে তারা ‘জয়বাংলা’ বলতে শুরু করেন। এভাবেই ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়।

মুজিবের স্বীকৃতি

১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জয় বাংলা ধ্বনি থেকে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ দেশব্যাপী পতাকা উত্তোলন- জয়বাংলার এই ক্রমবিকাশ হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্র অভ্যুদ্যয়ের ইতিহাস।  স্লোগানটি যেমন নজরুলের কবিতা থেকে চয়ন করা হয়নি, তেমনি এর প্রতিষ্ঠার পথও মসৃণ নয়। ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস গ্রুপের উদ্ভাবিত এই স্লোগানটির ব্যাপারে প্রথম দিকে আপত্তি ছিল খোদ আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের একাংশের।  ছাত্র ইউনিয়নও স্লোগানটির বিরোধিতা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর স্লোগানটি ওই গ্রুপের কর্মীদের মুখে মুখে রাজপথে প্রচারিত হয়। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটি প্রথম জনসম্মুখে ধ্বনিত হয়। ওই সভামঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে দেবদারু পাতা দিয়ে ‘জয়বাংলা’ লেখা ছিল।  কিন্তু ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারির আগে আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে জয়বাংলা স্লোগান দেয়া সম্ভব হয়নি। ওইদিন আওয়ামী লীগের প্রবল বাধা অতিক্রম করে ছাত্রলীগ সভামঞ্চের চূড়ায় ‘জয়বাংলা’ লেখা বোর্ড ঝুলিয়েছিল। ১১ জানুয়ারি পল্টনের সমাবেশে শেখ মুজিব মঞ্চে এলে কে এম ওবায়দুর রহমান মাইক ছেড়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলে সিরাজুল আলম খান মাইকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।  পরে এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চরম মতবিরোধ হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজুল আলম খানের ওই সম্ভাষণ গ্রহণ করেন।  শেখ মুজিবের এই সম্মতিই ছিল জয় বাংলা স্লোগানের স্বীকৃতির গ্রিন সিগন্যাল।  এই স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে স্লোগানটির অবিসংবাদি হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। অনেকের মতে, ওই মঞ্চেই শেখ মুজিব প্রথম জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেন।  তবে অধিকাংশের মত, শেখ মুজিব প্রথম জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেন ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে।

৭ জুনের সমাবেশে শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার দিতে ছাত্রলীগ গঠন করে ‘জয়বাংলা বাহিনী’। বাহিনীর জন্য তৈরি করা হয় লাল-সবুজের একটি পতাকা। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে ও যৌথ পরিকল্পনায় পতাকা তৈরি করেন আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনি ও হাসানুল হক ইনু।  বাহিনীর অধিনায়ক করা হয় আ স ম আবদুর রবকে, উপপ্রধান হন কামরুল আলম খান খসরু ও হাসানুল হক ইনু।  সমাবেশে ‘জয়বাংলা বাহিনী’র কুচকাওয়াজ ও গার্ড অব অনার শেষে রব শেখ মুজিবের হাতে পতাকা তুলে দেন।  এর পর ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের আরেক জনসভায় শেখ মুজিব জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তার ভাষণ সমাপ্ত করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি জহুর দিবসে এই পতাকা নিয়ে রাজপথে কুচকাওয়াজ করে জয়বাংলা বাহিনী। জয়বাংলা বাহিনীর এ পতাকাই জাতীয় পতাকা হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে প্রথম উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। একইদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত স্থির করেন সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি।  পরের দিন ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে শাজাহান সিরাজ পাঠ করেন জয়বাংলার ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ (সূত্র: জয় বাংলা, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা ও কর্মসূচি)। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ওই ইশতেহারে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করা হয়।  ২৩ মার্চ সারাদেশে উত্তোলিত হয় ‘জয়বাংলার পতাকা’ (পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের বিপরীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিরোধ দিবস)। ইতোমধ্যে যা অবিসংবাদি হয়ে উঠেছে জাতীয় পতাকা হিসেবে।  ওইদিন পল্টনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতা আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখনকে সামরিক অভিবাদন জানায় জয়বাংলা বাহিনী।  ময়দানে পিস্তল থেকে গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করেন হাসানুল হক ইনু ও কামরুল আলম খান খসরু। এরপর ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার দিয়ে পুনরায় তার হাতে পতাকা তুলে দেন আ স ম আবদুর রব।  ওইদিন শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে প্রথম পতাকা উত্তোলিত হয়, সংসদের নিরঙ্কুশ বিজয়ী দলের প্রধান হিসেবে গাড়িতে রবের বেঁধে দেয়া জয়বাংলার পতাকা উড়িয়ে তিনি গণভবনে যান।

জয়বাংলার স্বীকৃতির এই ক্রমবিকাশ সম্পর্কে মোস্তফা জব্বার ‘একাত্তর ও আমার যুদ্ধ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, বঙ্গবন্ধু প্রথম জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণ করেননি। বরং জয় বাংলা স্লোগান প্রবলভাবে জনপ্রিয় হবার পর বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এই স্লোগানটির অনুমোদন নেয়া হয়। সেই কাহিনীগুলোও আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে।’

হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘’বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির পর ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের একাংশের প্রবল বিরোধিতা পরেও আমরা সমাবেশ মঞ্চের চূড়ায় ‘জয়বাংলা’ লেখা বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম।  বাধার মুখে প্রথমে আমরা বোর্ডটি ঝুলাতে পারিনি, বিষয়টি সিরাজুল আলম খানকে জানাই।  সম্ভবত তিনি বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিলেন, কেননা পরে বোর্ড ঝুলাতে গেলে আমাদের আর বাধার মুখে পড়তে হয়নি।’’  তিনি জানান, ‘ওই সমাবেশেই শেখ মুজিব জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন।  এতে প্রতিষ্ঠিত হয়, বঙ্গবন্ধুর এতে আপত্তি নেই। শেখ মুজিবের স্বীকৃতির মাধ্যমে ছাত্রলীগের রণধ্বনি থেকে জয় বাংলা বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়। সেই দিনের পর জয় বাংলা স্লোগানকে আর প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়নি।‘

রায়হান ফিরদাউস মধু ‘জয় বাংলা স্লোগানের জন্মদিন’ নিবন্ধের শেষ অংশে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার বিষয়টি উল্লেখ করেন, ’এটি নতুন স্লোগান এবং ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটি ধারার ধারাবাহিক মতবাদিক সংগ্রাম চলছিল, তাই এই জয়বাংলা স্লোগান নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্কও চলে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে। এবং সব শেষে জয় হয় জয় বাংলা স্লোগানের।’ শামসুদ্দিন পেয়ারাও জানান, ‘স্লোগানটি প্রথমে আওয়ামী লীগের বাধার মুখে পড়েছিল, পরে বঙ্গবন্ধু এটি গ্রহণ করলে সব বাধা দূর হয়।’

মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বই থেকে জানা যায়, ‘সত্তরের ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ জনসভার আয়োজন করেছিল। প্রধান বক্তা ছিলেন শেখ মুজিব। মঞ্চের সামনের দিকে ‘জয় বাংলা’ লেখা একটা ব্যানার ঝোলানো ছিল। ‘বিজ্ঞাপনী’র কর্ণধার কামাল আহমেদ এটা ডিজাইন করে দিয়েছিলেন।  মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকবার এই স্লোগান দেন। এই প্রথম ঢাকার একটি জনসভায় প্রকাশ্যে জয় বাংলা উচ্চারিত হলো এবং উপস্থিত জনতা তাৎক্ষণিকভাবে তাতে সাড়া দিল।  তবে মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা জয় বাংলা স্লোগান দেননি। ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জয় বাংলা স্লোগান জনপ্রিয় হতে থাকে।  ছাত্রলীগের সিরাজপন্থী কর্মীরা একে অপরকে সম্ভাষণ জানাতে শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। ৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদগুলোর নির্বাচনের সময় এ স্লোগানের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। ৭ জুন রেসকোর্স মাঠে আওয়ামী লীগ একটা জনসভা করে। ওই সভায় শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো জয় বাংলা স্লোগানটি দেন। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো জানান, ‘ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা এই সময় জয় বাংলার পাল্টা হিসেবে জয় এগারো দফা ও জয় সর্বহারা স্লোগান দিলেও জয় বাংলার জোয়ারে সব ভেসে যায়। ’

১৯৬৯ সালের স্বাধিকার আন্দোলনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে আওয়ামী লীগের অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রুপের দ্বারা যখন জয়বাংলা স্লোগানটি উত্থাপিত হয়।  তখন শেখ মুজিব ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিশাল অংশই এর বিরোধিতা করেছে। এই বাধা-দ্বিধা ও গ্রহণের মধ্যে সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিকাশের ইতিবৃত্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কোনো একপেশে সহজিয়া সাধনা ছিল না।  ভারত-পাকিস্তান-বামপন্থা স্বার্থের জটিল পথ এবং নিজেদের বহুমত ও কৌশল পরিক্রমণের মধ্যদিয়ে এই চেতনার বিকাশ ঘটেছে। আর এই চেতনা যে বিন্দুতে এসে সমগ্রের মিলন ঘটায় তা হলো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। ‘জয় বাংলা’র সর্বসম্মতির মধ্যদিয়ে বাঙালি তার স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।  জয় বাংলা ধ্বনি সৃষ্টির আগে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষাও মূর্ত হতে পারেনি। অর্থাৎ জয়বাংলার ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমানবয়সী। জয় বাংলা স্লোগান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে বাঙালি তার আত্মপরিচয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক নির্মাণ করে।                                                

.............

রচনা সূত্র:

নক্ষত্রের দিন শেষ হয়/ শামসুদ্দিন পেয়ারা (সম্পাদিত)

জয় বাংলা স্লোগানের জন্মদিন/ রায়হান ফিরদাউস মধু

একাত্তর ও আমার আমার যুদ্ধ/ মোস্তফা জব্বার

জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের কথা/ মোস্তফা জব্বার

জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি/ মহিউদ্দিন আহমদ

মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস/ আ স ম আবদুর রব (মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত আমার একাত্তর গ্রন্থে সংকলিত)

অগ্নিঝরা মার্চ ও পতাকা উত্তোলন/ আ স ম আবদুর রব

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র/ মার্শাল মনিরুল ইসলাম

স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি/ আবু সাঈদ খান

স্বাধীনতা যুদ্ধের অপর নায়কেরা/ নুরুজ্জামান মানিক

জয়বাংলা স্লোগান এসেছে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে/ আলমগীর নিষাদ/ দৈনিক আমাদের সময় (২ জুলাই, ২০১১)

‘জয় বাংলা’ স্লোগান বঙ্গবন্ধু নজরুলের একটি কবিতা থেকে নেন/ দৈনিক জনকণ্ঠ (২৬ মে ২০১৫)

আলাপ:

আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক, মোস্তফা জব্বার, শামসুদ্দিন পেয়ারা, রায়হান ফিরদাউস মধু, মহিউদ্দিন আহমদ

SUMMARY

1231-1.jpg