যেভাবে হলো জাতীয় শিশুদিবস


জাকির হোসাইন

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন আজ। এই দিবসটি সরকারিভাবে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯২০ সালের এইদিনে তিনি তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

পরবর্তী সময়ে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ। বিশ্বে পরিচিত হয় লালসবুজের বাংলাদেশ। তাই তাঁর জন্মদিন বাঙালি জাতির কাছে গুরুত্ব বহন করে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এ দু’টিকে আলাদাভাবা অসম্ভব। কারণ তিনি না হলে বাংলাদেশ হতো না। এ জন্যই ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করে বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতির পিতাকে স্মরণ করে দেশের মানুষ।

বঙ্গবন্ধু সাহসী ও আপোসহীন নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়েই পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি। তাঁর জন্য আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, স্বাধীন জাতি হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়েছি।

একটি স্বাধীন দেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন; তাই এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। আনন্দময় দিন। কিন্তু এ দিনটি কেনো জাতীয় শিশুদিবস হলো? কেন এ দিনটিকে শুধু শিশুদের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? কারণ, বঙ্গবন্ধু সোনামণি শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। শিশুদের নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিলো। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। আগামিতে দেশগড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরকেই।


সেই মহান মানুষ, মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি আমাদের জাতীয় শিশুদিবস। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শিশুদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।


বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মাতা সায়রা খাতুন। শেখ মুজিব ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। তিনি স্থানীয় গীমাডাঙ্গা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। তবে পড়াশুনা শেষ করতে পারেন নি। কারণ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওদাসিনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।

জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৪৯) যুগ্ম সম্পাদকের তিনটি পদের মধ্যে একটিতে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন আরো বেগবান হয়। অপর দুই যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ.কে রফিকুল হোসেন। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬৬ সালেই তিনি দলের সভাপতি হন। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় এই অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।


তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন।

 ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সাতটি আসন সহ) জয়লাভ করে। কিন্তু বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা দিতে গড়িমসি করে পাকিস্তানী শাসকরা।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের বিশাল জমায়েতে তিনি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে যুগ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।  শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আনেন।

২৫ মার্চ কালরাত্রে পাকবাহিনীর একদিকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা করে, অপরদিকে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে নিয়ে যায় পাকিস্তানের কারাগারে। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় পাকিস্তানি জান্তা সরকার।


১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদারী থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্তি দেয়া হয় এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে বিজয়ীর বেশে স্বদেশে আসেন। সারা দেশে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়।

১৯৩৮ সনে আঠারো বছর বয়সে তার সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বাসঘাত ও কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে শহীদ হন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিন পুত্রই এই রাতে ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। সেই দিন বিদেশে ছিলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সব সময়ই শ্রদ্ধার সঙ্গে এই মহান নেতাকে স্মরণ করবে।

SUMMARY

1227-B2.jpg