ড. এম. শাহ্ নওয়াজ আলি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে বলা হয়, ‘মহাকালের মহাকবিতা’। জাতির জনকের এই ভাষণকে ঘিরেই জন্মলাভ করেছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র; যে রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল উপজীব্য হয়েছে ‘রক্ত’ আর অসহায় মা-বোনের ‘সম্ভ্রম’। এত রক্ত দিয়ে সভ্যতা বিনির্মাণের উদাহরণ বিশ্বে আর কোথাও নেই। একাত্তরে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ...রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।’
একাত্তরের অগ্নিঝরা ৭ই মার্চ দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে গর্বের ও গৌরবের। সেই ভাষণ কানে এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করে, উদ্দীপ্ত করে, জাগ্রত করে নতুন চেতনায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাত্ক্ষণিকভাবে মানসপটে ভেসে ওঠে বিশেষ করে ১ থেকে ৬ মার্চের উত্তাল দিনগুলো। এই ছয় দিন ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি স্থানে, গ্রাম-গ্রামান্তরে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ কটি দিনে অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি দেশজুড়ে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল-মিটিংয়ে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গুলি চালালে অনেক বাঙালি শাহাদাত বরণ করেন এবং পরিস্থিতি আরো উত্তাল হয়ে ওঠে। বলা যায়, অঘোষিত স্বাধীনতায় বাঙালিরা স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে প্রতিটি মুক্তিকামী বাঙালি। ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা ঘটে এই দিনটিতেই। এই জনসভা ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ঘিরে তখন সারা দেশে চলছিল ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে আসলে কী বলবেন! স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? না অন্য কিছু?
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু জনসভাস্থলে এলেন। যদিও জনসভা হওয়ার কথা দুপুর ২টায়, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর তিনি সভাস্থলে উপস্থিত হন। এই দিনটি তাঁর জন্য ছিল মারাত্মক সমস্যাপূর্ণ। বলা যায় ত্রিশঙ্কু অবস্থা। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্য ভুল হলে তা হবে ভয়াবহ। অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আহৃত এই জনসভা থেকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন—এ রকম একটা সম্ভাবনা ছড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠী ভীত হয়ে পড়ে। এই ভীতির কারণেই ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তিনি যেন ৭ই মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা না করেন, এ জন্য শেখ মুজিবকে অনুরোধও করেন। তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা করা হলে রেসকোর্স ময়দানে কামান ও বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হবে। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না। যদি গোলাবর্ষণ করেন তবে আপনাদের পরিণতিও শুভ হবে না।’ এই দিন সকাল থেকে তাঁর ওপর নেমে আসে বিদেশি চাপ, স্থানীয় নেতাদের নানা ধরনের হুমকি। ৭ই মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় সাক্ষাৎ করেন। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের এই বৈঠকটি গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিষ্কার ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই মেনে নেবে না। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করলেন, প্রস্তাবিত বক্তৃতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন জনসভায় কী বলবেন। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রবল চাপ, অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণার বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি—এসব বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু তখনো ছিলেন অস্থির। এভাবে কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর জনসভা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। যেকোনো মূল্যে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা চাই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয় তীব্র উত্তেজনা নিয়ে; মাত্র ১৮ মিনিটের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সব বলে দিলেন তাঁর অগ্নিকণ্ঠে। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ একটু ব্যাখ্যা করলেই অনেক কিছু বের হয়ে আসে। ভাষণের শেষ দুটি তাত্পর্যপূর্ণ বাক্য সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে দেয়। সেখানে তিনি অত্যন্ত দৃপ্তভাবে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—প্রকৃত অর্থে এটিই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ‘সংগ্রাম’ শব্দটির বিশ্লেষণ আবশ্যক। আমরা সাধারণত জেনে এসেছি সংগ্রাম বলতে অধিকার আদায়ের লড়াই, আন্দোলন, এমনকি হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনকে বোঝায়। আবার সংগ্রামের অভিধানিক অর্থ ‘যুদ্ধ’। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অব্যাহত বিতর্ক সৃষ্টিকারীদের জবাবে আমার বলা, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতার এ ডাক দেওয়ার মধ্যে তাঁর ভাষণের দুটি লাইন অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ—‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন করা যায় ঘরে ঘরে দুর্গ তোলার প্রয়োজন কেন? দ্বিতীয়ত, কেন সেই শত্রুর মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে?
আজও যারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনে, এতকাল পরও কী যেন এক অজেয় শক্তি আমাদের মনকে দোলা দেয়, আন্দোলিত করে। ঐতিহাসিক এই ভাষণের দিকে আরো একটু নজর দিলে বোঝা যায়, প্রথমে তিনি অত্যন্ত ধীরগতিতে বক্তব্য শুরু করেন। একপর্যায়ে চরমে পৌঁছে বলেন, ‘দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’
এরপর ২৫ মার্চের রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি ইপিআরের ওয়্যারলেসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান, ‘...আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু যে মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হন তার আরো একটি জ্বলন্ত প্রমাণ মেলে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে, আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের একটি কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে—
‘মুজিবর রহমান ঐ নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারীবাণ বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে জ্বালায় জ্বলিয়ে মহাকালানল ঝঞ্ঝা অশনি বেয়ে...’
একজন মানুষ একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন। আর ইতিহাসও নিজের প্রয়োজনে একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটাতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মনে হয় তেমনি একজন মানুষ। ইতিহাসের প্রয়োজনেই তাঁর আবির্ভাব। আবার তিনি ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায় যোগ করে গেছেন।