রাকিব, শিক্ষার্থী চবি।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি একইসূত্রে গাঁথা।একটি ছাড়া আরেকটি মূল্যহীন। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনিই বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা।বাঙালির সম্মিলিত চেতনায় জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক মূল্যচেতনা, শোষণ-মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা-এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথা। জাতীয়তাবাদের এই মূলমন্ত্রকে তিনি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন বাঙালির চেতনায়। এভাবেই ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই অভিন্ন ও একাত্ম। বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। জনগণের স্বার্থের সঙ্গে, দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্মা করতে পেরেছিলেন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, দেশের স্বার্থের কাছে, জনগণের স্বার্থের কাছে তিনি নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। শোষক ও শোষিতের সংগ্রামে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা।
কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিই নয়, বাংলাদেশের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বস্তুত তাঁর সাধনার মধ্য দিয়েই ভাষা-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ভাষা-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয় ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের নিম্নোক্ত অংশ–
“যাঁরা সাহিত্য সাধনা করছেন, শিল্পের চর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাঁদের দেশের জনগণের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। দেশের জনগণের চিন্তা-ভাবনা, আনন্দ-বেদনা ও সামগ্রিক তথ্যে তাঁদের জীবনপ্রবাহ আমাদের সাহিত্যে ও শিল্পে অবশ্যই ফুটিয়ে তুলতে হবে। সাহিত্য-শিল্পে ফুটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা। সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাঁদের কল্যাণে। …জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।”
বঙ্গবন্ধু ছিলেন “রাজনীতির কবি” আর তাঁর জীবনটাই একটি অমীমাংসিত কবিতা। এই জীবন্ত কবিতা বিশ্লেষণে ব্যস্ততা আজ বিশ্বময়। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের weekly Newsweek এ বলা হয়, ” রাজনীতির প্রকৌশলী নন মুজিব, মুজিব হলেন রাজনীতির কবি, বাঙালির স্বাভাবিক প্রবণতা প্রয়োগিক নয়,শৈল্পিক। তাই মনে হয়, বাংলাদেশের সকল মানুষ,শ্রেণি ও মতাদর্শকে এক সূত্রে গাঁথা হয়ত মুজিবের মতো রাজনৈতিক কবির পক্ষেই সম্ভব। “
বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন, তেমনি যুদ্ধোত্তরকালে জাতীয় পুনর্গঠনে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনিই ছিলেন প্রধান চালিকাশক্তি। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনিই প্রধানতম শক্তি ও অনুষঙ্গ। রাজনীতির মতো সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ কথা সমান প্রযোজ্য। জীবিতকালে যেমন, তেমনি মৃত্যুর পরে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সাধনা নিয়ে, তাঁর মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক রচনা। এসব রচনার মধ্যে আছে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, ছড়া-আছে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। এ কথা আজ গভীরভাবে সত্য, বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সৃষ্টিশীলতার এক অফুরান উৎস বঙ্গবন্ধু। কেবল বাঙালি সাহিত্যিকই নন, অন্য ভাষার লেখকরাও তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন, লিখেছেন সৃষ্টিশীল অনেক রচনা। বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সাহিত্যের পরিমাণ বিপুল, একটি প্রবন্ধে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জরিপ অসম্ভব কাজ। বর্তমান আলোচনায় একটা সংক্ষিপ্ত খসড়া উপস্থাপিত হয়েছে মাত্র।
বাংলা কবিতায় কিংবা বলি গোটা বাংলা সাহিত্যে শেখ মুজিবকে শিল্প-উপাদান হিসেবে প্রথম গ্রহণ করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপনের পরে সমগ্র দেশে যে আলোড়ন ওঠে, তাতে উদ্বেলিত হয়ে সেদিনের তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণ লেখেন ‘প্রচ্ছদের জন্য’ শীর্ষক কবিতা। উত্তরকালে জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদসহ বাংলাদেশের কবিরা নানা দৃষ্টিকোণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। জসীমউদ্দীন ১৯৭১ সালের অগ্নিগর্ভ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন এই প্রত্যয়দীপ্ত শব্দগুচ্ছে :
মুজিবুর রহমান
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান।
বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে
জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞ্ঝা অশনি যেয়ে।
… …
বাঙলা দেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রসূর্ত রাজ,
প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত তাজ।
(জসীমউদ্দীন/’বঙ্গবন্ধু)
১৯৭৭ সালে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও ছিল যখন ভয়ংকর এক অপরাধ, সে সময়ে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সবাইকে চমকে দিয়ে নির্মলেন্দু গুণ আবৃত্তি করেন ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শীর্ষক এক ঐতিহাসিক কবিতা। ওই কবিতায় তিনি বলেন :
‘সমবেত সকলের মতো আজিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই দিন গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল/আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। /আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। /শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। /আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। ‘
১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে ৩২ নম্বর বাড়ির যে সিঁড়িতে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ, সেই সিঁড়ি নিয়ে এক অসামান্য কবিতা লিখেছেন কবি রফিক আজাদ। সেই সিঁড়ির রক্তধারাতেই যেন পবিত্র হয়েছে সমগ্র স্বদেশ, পবিত্র হয়েছে স্বদেশের মানচিত্র। রফিক আজাদের ভাষায় :
এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙ্গে রক্ত নেমে গেছে-/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে। …/স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর।
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের সমার্থক। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য/অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উম্মুক্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকত কখন আসবে কবি ? কখন আসবে কবি?”
জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। তিনি নিজে সারা জীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। এই জনগণ কেবল শহরে থাকে না, গ্রামে এক বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের বিষয়েও তিনি মনোযোগ দিতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণ সচেতন শিল্পী-সাহিত্যিককে উদ্বেলিত করেছিল নিশ্চয়। আর তিনি নিজে নিবিড় জনসংযোগের মধ্য দিয়ে ‘রাজনীতির কবি’ হয়েছিলেন বলেই তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য আলোড়িত হয়েছে। জীবদ্দশায় যেমন, তেমনি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার পর তিনিই হয়ে ওঠেন শিল্প-সাহিত্যের অনুপ্রেরণার উৎস। কারণ তিনি নিজেই সেই সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন।
কবিতার মতো উপন্যাস ও ছোটগল্পও লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল কর্মকাণ্ড নিয়ে। আনিসুল হকের ‘যাঁরা ভোর এনেছিল’, সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের এক রাত’-এসব উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ করতে হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আবুল ফজল লিখেছেন ‘মৃতের আত্মহত্যা’ শীর্ষক অসামান্য এক ছোটগল্প। উত্তরকালে সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ হায়দার, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আনোয়ারা সৈয়দ হক, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, জাকির তালুকদারসহ অনেক ছোটগাল্পিক বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বিশেষ বিশেষ অনুষঙ্গ নিয়ে ছোটগল্প রচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক নাটক।
এর মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ মঞ্চনাটকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এই নাটকের একটি সংলাপ এখানে উল্লেখ করা জরুরি :
তাজউদ্দীন : এবারের যুদ্ধ অনেক বেশি কঠিন লিডার। /একাত্তরের যুদ্ধ ছিল একটা বিদেশি হানাদার/বাহিনীর বিরুদ্ধে। এবারের যুদ্ধ একসঙ্গে অনেক/শত্রুর বিরুদ্ধে। এই শত্রুরা আপনার/প্রশাসনের মধ্যেও ঘাঁটি গেড়েছে। /বঙ্গবন্ধু : আমি কি তা বুঝি না? সরকারি আমলা, /পুলিশ-এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও /এরা ঢুকে গেছে। তা না হলে দেশময় /সন্ত্রাস চলছে, পুলিশ তাদের ধরতে/পারে না? দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায় মানুষের /জন্য বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে খাদ্য, /বস্ত্র, ওষুধ আনি, সেগুলো গরিব /দুঃখীকে না দিয়ে নদীর পানিতে/ভাসিয়ে দেওয়া হয়?
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রায় ৫০টি গল্প রচিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আবুল ফজল : মৃতের আত্মহত্যা, নিহত মুখ, ইতিহাসের কণ্ঠস্বর, কান্না; সৈয়দ শামসুল হক : নেয়ামতকে নিয়ে গল্প নয়; ইমদাদুল হক মিলন : রাজার চিঠি, মানুষ কাঁদছে, নেতা যে রাতে নিহত হলেন, মানুষ বড় কাঁদছে; রশীদ হায়দার : এ নহে পতন; সৈয়দ ইকবাল : একদিন বঙ্গবন্ধু, স্পর্শ; আবু ইসহাক : স্বপ্ন-সংবাদ; হুমায়ুন আজাদ : যাদুকরের মৃত্যু; অসীম সাহা : ভ্রূণ; আহমাদ মাযহার : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প (রাজা), মোসাদ্দেক আহমেদ : শেখ মুজিবের সাইকেল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর সাহিত্য সাময়িকী ‘সমকালে’ জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর।
‘মৃতের আত্মহত্যা’ গল্প লেখার মাধ্যমে আবুল ফজল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম সাহিত্য-প্রতিবা
দের সূচনা করেন।
‘মৃতের আত্মহত্যা’র কেন্দ্রীয় চরিত্র সোহেলি বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত এক খুনি মেজরের স্ত্রী। পঁচাত্তর-পরবর্ত
ী খুনিদের বিদেশি দূতাবাসসমূহে চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়েছিল। গল্পে ঠিক সেই পটভূমি ব্যবহৃত হয়েছে। দূর মরুভূমিতে দেশ ও পরিজন ছেড়ে নির্বাসিত জীবনের গ্লানি বহন করছে সোহেলি। উপরন্তু ‘খুনির বৌ’ ও তার সন্তান বকুল ‘খুনির ছেলে’ বলেই অনুশোচনা তার আরো তীব্র। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে তার স্বামী য়ূনুসের সঙ্গে তৈরি হয় দূরত্ব; সংসারের আনন্দ যায় উধাও হয়ে। য়ূনুসের অন্যায় খুনের সংশ্লিষ্টতা সোহেলিকে জীবনের প্রতি অনাগ্রহী করে তোলে। নিজেকে মৃত ভাবতে থাকে সে। অবশেষে বাংলাদেশে তার বাবার কাছে ছেলে বকুলকে পাঠিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। এই বিবেকতাড়িত নারীর গল্প সেই সময়ে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল।
ইমদাদুল হক মিলন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন একাধিক গল্প। তার মধ্যে ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’, ‘রাজার চিঠি’ ও ‘মানুষ কাঁদছে’ উল্লেখযোগ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তারিখের বিকেলে সূচনা হয়েছে ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পটির কাহিনী। এ গল্পের উপস্থাপনরীতি কৌতুককর হলেও মর্মবিদারক। বর্গাচাষি রতন গ্রাম থেকে এসেছে নেতাকে দেখার জন্য। তাঁর বাসভবনের আশপাশে ঘুরতে থাকলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। পুলিশ অফিসার ও তার অধস্তন দুই সহকারী রতনের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে হাস্যকর করে তোলে এবং সন্দেহপরায়ণ রতনকে হাজতে আটকে রাখে। কাহিনীতে রঙ্গ-রসিক পরিস্থিতি পাল্টে যায় ভোরে রতনকে ছেড়ে দিলে। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন- এ সংবাদ জানার পর রতনের ভেতর অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। তাকে আটকে রাখতে বলে সে। কারণ সে থানা থেকে বের হলে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের মর্মান্তিক ঘটনাকে লঘু ঢঙে ও ছোট পরিসরে অনিবার্য পরিণতির দিকে কাহিনীকে টেনে নেওয়ার দক্ষতা সত্যিই অভিনব। ‘রাজার চিঠি’ আটাত্তরের শুরুর দিকে সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হয়। লেখক রূপকথার আঙ্গিকে প্রজাপ্রিয় মহান এক রাজার আদলে তৈরি করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। ইমদাদুল হক মিলন দেশের সাধারণ মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন এ গল্পে। ‘মানুষ কাঁদছে’ সাতাত্তর সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পের নামটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরিফের মতো কৃষকের সন্তান আর ম্যাট্রিক পাস করা ব্যক্তি চৈতন্যের গহিনে বঙ্গবন্ধু কিভাবে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন, তারই বর্ণনাত্মক উপস্থাপনা রয়েছে এ গল্পে।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই মহান নেতাকে নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত হয়েছে পাঁচটি উপন্যাস। ঐতিহাসিক বিষয়ের সঙ্গে কাল্পনিক প্রেমকাহিনী বুনে দিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘দুধের গেলাশে নীল মাছি’ (১৯৯৫) উপন্যাসে। ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তে ব্যক্তি মাহতাব অনন্য হয়ে উঠেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু কালের গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বকালীন হয়ে উঠেছেন। এ ক্ষেত্রে খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ (২০১৩) উপন্যাসে। যদিও নির্মাণকুশলতায় ঐতিহাসিক বিষয় ও চরিত্রসমূহের কাঠামোটিকে লেখক উপন্যাসের প্রাণস্পন্দনে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের ক্ষেত্রে সেলিনা হোসেন ‘আগস্টের একরাত’ (২০১৩)-এ একটি যুগের সমগ্র ইতিহাস পরিবেশন ও পর্যালোচনা করতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর শক্তিমান, তীক্ষ্নধী, কূটনৈতিক ও সাহসী ভূমিকা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও জাতির জীবনে মুক্তি-অন্বেষী মুজিবকে ঐতিহাসিক করে তুলেছেন তিনি।
উপন্যাসের প্রধান ঘটনা ও তার পটভূমি ঐতিহাসিক। আনিসুল হকের ‘যারা ভোর এনেছিল’ (২০১২) ও ‘ঊষার দুয়ারে’ (২০১৩) দুটি উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। ঐতিহাসিক চরিত্র অনেক সময় ইতিহাসসম্মত আচরণ না-ও করতে পারে। কারণ ঔপন্যাসিক গল্প লিখতে বসেছেন। তাঁর উপন্যাসে ইতিহাসের ঘনঘটার পাশে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির কথোপকথন, ব্যক্তিগত জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। মোস্তফা কামালের ‘জনক জননীর গল্প’ উপন্যাসের স্লোগানে জাতির পিতার সরব উপস্থিতি।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আত্মত্যাগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের কবিরা। এই মহামানবকে নিয়ে কবিতা রচিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। মানব-মানবতা ও মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিককে উৎসাহী করেছেন স্বাভাবিকভাবে। কারণ মানবমুক্তির গান কবি-সাহিত্যিকদের প্রধান অবলম্বন। এ জন্য মহামানবের মধ্যে প্রেরণা অন্বেষণ করে জাতি ও জনতাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে কবিতা ও ছড়ায় বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের মাধ্যমে। শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়ার আগেই তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখা শুরু হয়।
নির্মলেন্দু গুণ ও জসীমউদ্দীন ষাট-সত্তর দশকে তাঁকে কাব্যের ভেতর দিয়ে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে পরিস্ফুট করেছেন। কবিদের কাছে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক হয়ে গিয়েছিল। ষাট ও সত্তরের দশক ধরে বিশ্বব্যাপী মুক্তিপাগল মানুষের তেজোদীপ্ত প্রতীক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশের বৈরী পরিবেশে কবিরা স্মরণ করেছেন তাঁকে। পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক পট পাল্টে গেলেও মুজিবের অনুপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মেনে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিরা। কবি বলেছেন, ‘বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’। আমাদের গৌরব ইতিহাস লুণ্ঠিত করার প্রতিবাদই উচ্চারিত হয়েছে কবিতায়। সেই সময়ের সমাজ-সংস্কৃতিতে স্বৈরশাসকের অনিবার্য প্রভাব থাকলেও প্রতিবাদী কবিতার ধারার শক্তিশালী বিকাশ বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই বিস্তৃত হয়েছে।
কবিতায় বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথম উচ্চারিত হয় নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। তাঁর একাধিক কবিতা কিংবা বলা চলে সবচেয়ে বেশি কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে। কবির ‘মুজিবমঙ্গল’ কাব্যে সংকলিত উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো, ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদণ্ড’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ প্রভৃতি। মুজিবকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর প্রথম তিনি কবিতা লেখেন ‘প্রচ্ছদের জন্য’, তখন শেখ মুজিব কারাবন্দি। ১৯৬৯ সালে রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে নায়কের আসন দান করেন। কামাল চৌধুরী ১৯৭৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রচনা করেন ‘জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু’ কবিতাটি। পঁচাত্তরের পৈশাচিক ঘটনা নিন্দার শৈল্পিক অভিব্যক্তি এ কবিতা। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম কবিতা রচনা করেন নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যতরুণ গোষ্ঠীর একুশের স্মরণিকা ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এটি ছিল প্রথম প্রতিবাদী কবিতার সংকলন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কাজটি ছিল দুঃসাহসিক।
এ সংকলনটি ছিল ৩০টি ছড়া ও কবিতার সমাবেশে সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অসাধারণ নিদর্শন। সেখানে ভীষ্মদেব চৌধুরীর ‘পিতা : তোমার জন্যে’ শিরোনামে একটি অনন্য কবিতা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন- কবীর চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মযহারুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুল হোসেন, রোকনুজ্জামান খান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, কায়সুল হক, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নুরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রুবী রহমান, মাহবুুব সাদিক মনজুরে মওলা, নাসির আহমেদ, অসীম সাহা, মহীবুল আজিজ, মুহাম্মদ সামাদ, খালেদ হোসাইন, শামীম রেজা, আমিনুর রহমান সুলতান, সৌরভ জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
ছড়াকাররা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করেছেন। জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে গভীর উপলব্ধিতে তুলে ধরেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত রচনা ‘যতদিন রবে’ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বেবী মওদুদ, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, আহমদ মাযহার, সুজন বড়ুয়া, আখতার হুসেন, ফারুক নওয়াজ, সুকুমার বড়ুয়া, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাসের মাহমুদ, আলী হাবিব, আসলাম সানী, তপন বাগচী, প্রমুখ ছড়া রচয়িতা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চরণে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-ছড়া ছাড়াও অজস্র সংখ্যক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’সহ আরো কয়েকজন নাট্যকারের নাটকে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যকর্ম।
বস্তুত জাতির পিতার দীর্ঘ সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে শিল্প-সাহিত্য পরিবেশিত ও রচিত হয়েছে। তাঁর দেশপ্রেম ছিল তর্কাতীত। ঐকান্তিকতায় পূর্ণ ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ তাঁকে জেল থেকে বের করে এনেছে। এমনকি ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্র করে সরাতে না পেরে সশস্ত্রবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাঙালি আবার তাঁকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনে। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে দেশের উন্নয়নে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছেন। তাঁর শাসনকালে সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৭৫ সালের দুঃসময়-পরবর্তী সময়ে তবু মানুষের ভালোবাসা প্রদর্শন থেমে থাকেনি। মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে তাঁর নামে। সেই পাশবিক নৃশংসতায় প্রাণপুরুষকে হারিয়েছি আমরা; শোষিত জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের সাহিত্যের মাধ্যমে সেই জনতারই আপনজন হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিশ্ব ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টান্ত বিরল। তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি জাতীয় পুঁজির আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা ও বাঙালির সম্মিলিত মুক্তির বাসনাকে একটি বিন্দুতে মেলাতে পেরেছেন। এ কারণেই তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, এ কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ কারণেই তিনি আমাদের জাতির পিতা।