মিজানুর রহমান খান
১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার ইঙ্গিত ছিল মাস পাঁচেক আগেই। সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের নানা উপাদান পাওয়া যায় মার্কিন নথিতে। জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের শেষ পর্ব।
অবমুক্ত করা মার্কিন দলিল ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ২০ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে তৈরি পাঁচটি কূটনৈতিক তারবার্তার শিরোনামেই বাংলাদেশে ‘অভ্যুত্থানের গুজব’ কথাটি ছিল। কিন্তু ২০ মার্চে মিসরের আসওয়ানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো তারবার্তাটি নানা কারণে ব্যতিক্রম। সেটির শিরোনামে ‘সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’ বলা হয়েছে। তবে এসব তারবার্তার বিবরণ অবমুক্ত করার আগেই মুছে গেছে বা মুছে দেওয়া হয়েছে। তাই ভেতরে কী লেখা ছিল, তা কখনো জানা যাবে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এই প্রতিবেদক ২০১২ সালে ম্যারিল্যান্ডের কলেজ পার্কে অবস্থিত মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা এবং সেখানকার সিআইএর মহাফেজখানায় রক্ষিত নথিপত্রে লক্ষ করেন যে বাংলাদেশে অভ্যুত্থান বিষয়ে বহু নথির বিবরণ সম্পূর্ণ বা আংশিক স্থগিত রাখা হয়েছে।
লাল বর্ডার দেওয়া একটি ফাইলের শিরোনাম ছিল: ‘পল ২৩.৯ মিলিটারি ক্যু,১৯৭৫। ’ এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তৈরি ৬ পৃষ্ঠার একটি নথি ‘প্রত্যাহার’ করে নেওয়ার তথ্য আছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশীয় ও নিকটপ্রাচ্যবিষয়ক সহকারী সচিব আলফ্রেড আথারটন এটি পাঠিয়েছিলেন কিসিঞ্জারের কাছে।
১৯৭৫ সালের ২২ মার্চে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ব্যুরো অব নিয়ার ইস্ট অ্যাফেয়ার্সের (এনইএ) পাঠানো নথির মূল বিবরণও প্রকাশ করা হয়নি। লক্ষণীয়, পাঁচটি কূটনৈতিক তারবার্তার মধ্যে শুধু এই নথিটির (সিআইএ অ্যান্ড আ পসিবল ক্যু ইন বাংলাদেশ) বিবরণ আর ‘পাওয়ার সম্ভাবনা নেই’ কথাটি লেখা নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২২ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে অভ্যুত্থান নিয়ে ঢাকা, দিল্লি ও ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে আরও যে তিনটি পৃথক তারবার্তার চালাচালি ঘটে, তার প্রতিটিতেই ২২ মার্চের ওই তারবার্তার উল্লেখ দেখা যায়।
২২ মার্চের নথিটির (এটি কূটনৈতিক তারবার্তা নয়) মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে যেসব শব্দবন্ধ উল্লেখ আছে তা হলো, ‘সশস্ত্র বাহিনী’, ‘সরকার উৎখাত’, ‘গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ’, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’। এই নথিটি ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বাইরে যাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, তার ক্রমিকটি এ রকম-ঢাকার মার্কিন দূতাবাস, সিআইএ, ভারত ও পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস।
২০০৬ সালের ৫ জুলাই অবমুক্ত করা ওই নথিটির অবস্থান মাইক্রোফিল্মে (ডিজিটাল কপি) নির্দেশ করা আছে। তবে ১৯৭৫ সালে এই নথি সিআইএ ছাড়াও ফোর্ড-কিসিঞ্জার প্রশাসনের রাজনৈতিক বিষয়ক ‘ইন্টেলিজেন্স’ এবং ইন্টারনাল পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্সে পাঠানো হয়েছে। তবে প্রতিটি নথির অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো, এর একটিও কনফিডেন্সিয়াল নয়, ‘সিক্রেট’। গোপনীয়তার মাত্রা বেশি হলে তা সিক্রেট। আরেকটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো: প্রতিটিতে ‘সরকার উৎখাত’ (মুজিব সরকার) কথাটি রয়েছে।
অন্য চারটিতে যা আছে
পঁচাত্তরের ২১ মার্চের তারবার্তাটির নং ১৯৭৫ নিউডিই ০৩৯২২। প্রেরক: দিল্লির মার্কিন দূতাবাস। প্রাপক: ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। প্রস্তুত করার সময়: ২১ মার্চ বেলা ১ টা। এই বার্তারও মূল পাঠ ‘পাওয়া যায় না’ বলেই উল্লেখ আছে। দলিলে বিষয়বস্তু লেখা আছে: ‘বৈদেশিক সম্পর্ক, সরকার উৎখাত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’।
২২ মার্চের ইলেকট্রনিক তারবার্তাটির নং ১৯৭৫ ঢাকা ০১৪৫৬। সময় বেলা ১ টা, শনিবার। প্রেরক: ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। প্রাপক: পররাষ্ট্র দপ্তর, ওয়াশিংটন। এতে বিষয়বস্তু আগেরটির মতোই। কেবল ‘রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ’ কথাটি বাড়তি আছে। এই বার্তারও মূল বিষয়বস্তু মাইক্রোফিল্মে এবং তা ‘পাওয়া যায় না’ উল্লেখ আছে।
লক্ষণীয় যে ২২ মার্চে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো বার্তাটির ট্যাগে ব্র্যাকেটের মধ্যে ‘রহমান, মুজিবুর’ কথাটির উল্লেখ দেখা যায়।
২৪ মার্চের ইলেকট্রনিক তারবার্তাটির নং ১৯৭৫ নিউডিই ০৩৯৮৮। সময়: বেলা ১ টা। এটির মূল মুদ্রিত পাঠও ‘পাওয়া যায় না’ উল্লেখ আছে। এই তারবার্তার প্রেরক: দিল্লির মার্কিন দূতাবাস। প্রাপক: ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
তবে উল্লিখিত পাঁচটি (২০ মার্চ ওয়াশিংটন থেকে মিসরের আসওয়ানে, ২১ মার্চ দিল্লি থেকে ঢাকা, ২২ মার্চ এনইএ থেকে পররাষ্ট্র দপ্তরে, ২২ মার্চ ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে ও ২৪ মার্চে দিল্লি থেকে ঢাকা) ইলেকট্রনিক তারবার্তার মধ্যে ভারতের মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো ২৪ মার্চের তারবার্তাটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়।
এর কারণ এটির ট্যাগে মুজিবের পাশাপাশি [গান্ধী, ইন্দিরা] কথাটি মুদ্রিত আছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে কী বলা ছিল, তা উদ্ধার করা যায়নি। উপরন্তু ইন্দিরা গান্ধীর উল্লেখসংবলিত এই তারবার্তাটিতে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের মধ্যে চালাচালি হওয়া আরও তিনটি পৃথক তারবার্তার উল্লেখ আছে।
এটি ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অভ্যুত্থান নিয়ে ওয়াশিংটন এবং দিল্লি ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাসগুলোর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে তারবার্তা চালাচালি হয়েছে।
এ ছাড়া একাধিক তারবার্তা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান নিয়ে মার্কিন ও ভারতীয় কূটনীতিকেরা সময়ে সময়ে মতবিনিময় করেছেন।
অবমুক্ত করা মার্কিন বিভিন্ন নথি থেকে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের প্রতি হুমকির বিষয়টি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে কোনো রাখঢাকের ব্যাপার ছিল না।
১৫ মে,১৯৭৪-এ এক তারবার্তায় খুনি সৈয়দ ফারুক রহমানের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা প্রকাশ করে তৎকালীন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টার বলেছিলেন, ‘এই প্রথম নয়, দুই বছর ধরে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ এবং অভ্যুত্থান নিয়ে কর্মকর্তারা দূতাবাসে পৌঁছেছেন। এর আগের প্রতিবেদনগুলোতে দেওয়া পূর্বাভাস কোনো ফল দেয়নি। কোনো সামরিক পদক্ষেপ আসন্ন বলেও আমরা মনে করি না।’
আরও কিছু অপ্রকাশিত বার্তা
শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন অনেক তারবার্তা ও প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করেনি এবং এগুলো অদূর ভবিষ্যতেও অবমুক্ত করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেমন ১৯৭৪ সালের ২ আগস্ট ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো ‘সিক্রেট’ তারবার্তার শিরোনাম ছিল, ‘সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে আরও বিস্তারিত’। বিষয়বস্তুর ধারণা: ‘কেন্দ্রীয় সরকার, সরকারের ধরন, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক পরিস্থিতি’।
১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো আরেকটি তারবার্তার শিরোনাম, ‘অস্থিরতার সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন’।
১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাইয়ের একটি দলিলের শিরোনাম ‘মিসেস গান্ধী এবং সিআইএ’।
সন্ত্রস্ত প্রিয়দর্শিনী
ইন্দিরা গান্ধীর বান্ধবী পপুল জয়াকারের লেখা ইন্দিরা গান্ধী: আ বায়োগ্রাফি শীর্ষক বইয়ে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান নিয়ে ইন্দিরা ও ‘র’-এর সাবেক প্রধান আর এন কাওয়ের আলোচনার বিবরণ দিয়েছেন। পপুল লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের তথ্য ১৯৭৪ সাল থেকেই ‘র’-এর কাছে ছিল। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ যে দানা বাঁধছে, সে তথ্য আর এন কাও গোপন সূত্রে পেয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করেন।
পপুল লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের মার্চেও ‘অভ্যুত্থানের পূর্বাভাস’ মি. কাওয়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি এটা যে আর্টিলারিতে, সেটাও ‘র’-এর প্রধান জানতে পেরেছিলেন। ইন্দিরা সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের এ খবর পেয়েই দ্রুত মুজিবকে অবহিত করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানান।
পপুল জয়াকারকে তৎকালীন ‘র’ প্রধান বলেছিলেন, তাদের কাছে এমন তথ্য ছিল যে ১৯৭৪ সালেই দেশের বাইরের শক্তিসমূহ মুজিব সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করছে। পপুল লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সন্ধ্যায় আমি ইন্দিরার বাসভবনে যাই। দেখলাম, একটা বিরাট ভীতি তাঁকে গ্রাস করেছে। তাঁর নিরাপত্তা নাজুক হয়ে পড়েছে। ১৫ আগস্টে তিনি যখন জনসভায় ভাষণ দিতে রেড ফোর্টে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি মুজিব হত্যার খবর পান। তিনি (ইন্দিরা) আমাকে বলেছিলেন, উপমহাদেশকে ডোবানোর ষড়যন্ত্রে মুজিব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে প্রথম ঘটনা। মুজিব হলেন সেই ব্যক্তি, যাকে প্রথম যেতে হলো।’
মার্কিন নথির আরেকটি তথ্য
স্থান: ওভাল অফিস, হোয়াইট হাউস। ৯ অক্টোবর ১৯৭৫। বেলা ১১ টা। উপস্থিত প্রেসিডেন্ট ফোর্ড, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইয়াকুব খান। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
ফোর্ড: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি কী?
আজিজ: অত্যন্ত ফলপ্রসূ অগ্রগতি। তাঁরা (মোশতাক সরকার) বার্তা পাঠিয়েছেন যে তাঁরা আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চান। আমরা তাঁদের বলেছি, সতর্ক থাকুন। আমরা ভারত বা সোভিয়েতকে বিচলিত করতে চাই না। আবার কোনো সমস্যাও নেই। ঘটনা এগিয়ে যাবে। অস্ত্রনীতি বদলের (দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন অস্ত্রনীতি) পর ভারতীয়রা অনেক হইচই করেছে।
হেনরি কিসিঞ্জার এ সময় রসিকতা করেন। সম্ভবত অভ্যুত্থান সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ না করার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমরা সৌভাগ্যবান যে ভারতীয়রা শান্তিবাদী (হাসি)।’