কামাল হোসাইন
পৃথিবীতে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো এত কবিতা লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর সময়কার তো বটেই, তার পরেও অনেক কবি তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, যত দিন যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু কবি-সাহিত্যিক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও গভীর আবেদন তৈরি করে চলেছেন।
তিনি একটি জাতির প্রতিষ্ঠাতা। এরকম আরও বেশ কিছু নেতা পৃথিবীতে এসেছিলেন- যারা জাতির পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠ, কিন্তু শেখ মুজিবই ব্যতিক্রম, যিনি ১৬ কোটি মানুষের মাঝে এখনও নতুন নতুন রূপে আবিষ্কৃত হচ্ছেন।
তার মহানুভবতা, মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং ভালোবাসা তার নেতৃত্বের মাঝে ভিন্ন এক মহীরূহ হিসেবে স্পষ্ট হয়ে আছে। মানুষের এত ভালোবাসা পাওয়া নেতা পৃথিবীতে বিরলই বলা যায়। তার উত্থানের সময় থেকে ঘাতকের গুলিতে শহীদ হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি মানুষের কাছে সমান ভালোবাসার পাত্র হিসেবেই থেকেছেন।
তার উত্থানকালে যেমন কবিদের কবিতায় নন্দিত হয়েছেন, ঠিক তেমনি তার প্রয়াণেও কবিদের কলমে ঝরেছে কালির অশ্রু।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেন-
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরী যমুনা বহমান/ ততোদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান।’
শেখ মুজিবকে নিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর মতো বিপ্লবী নেতাকেও বলতে হয়েছে ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি’ জননেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন- ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’
অন্নদাশংকর রায়ের কবিতাটি এতটাই জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য ছিল যে, কিশোর যুবক বৃদ্ধ পর্যন্ত তা মুখস্থ বলতে পারতেন। এক সময় এটা স্লোগানেও পরিণত হল।
বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী গানের গীতিকবি গৌরী প্রসন্ন মজুমদারকেও ছুঁয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলো।
গৌরী প্রসন্ন লিখেছেন-
শোন একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাশে উঠে রণি/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
প্রকৃত অর্থেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের প্রতিশব্দ। কোটি বাঙালির কণ্ঠস্বর। মানুষের আবেগের নাম।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন তার ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন-
‘মুজিবুর রহমান!/ ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান।/ বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,/ জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞ্ঝা-অশনি বেয়ে।/ বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার,/ হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যের অঙ্গার;/ দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,/ দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে;/ তাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি/ ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।’
কবি জসীমউদ্দীন শেখ মুজিবের আগমনকে বিসুভিয়াসের অগ্নির সঙ্গে তুলনা করেছেন। হাজার বছরের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত নির্যাতিত এই ভূখণ্ডের মানুষের হুংকার হয়ে আবির্ভাব দেখছেন শেখ মুজিবকে। জসীমউদ্দীনের এই উচ্ছ্বাস মিথ্যে ছিল না। শেখ মুজিব নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষগুলোকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করে দিয়েছেন। হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে তিনি স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু সাহচর্য পাওয়া ওই সময়ের কবি উপন্যাসিক নাট্যকার এবং এ সময়ের কিংবদন্তি কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন-
‘তোমার বিজয় পতাকা এখন মাটির ধুলায় নমিত/ তোমার দীপ্ত আদর্শ আজ শকুনির পায়ে দলিত।/ আকাশে উড়ালে সূর্য-পতাকা/ তাতে আজ শুধু রক্তই মাখা’
শেখ মুজিব বাংলার মানুষকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করে আনলেন। পৃথিবীর মানচিত্রে উদিত হল স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশের পতাকা। সেই পতাকাকে আজ কবি দেখছেন বিষণ্ণ চোখে। যে আদর্শে আকাশে স্বাধীন পতাকা উড়েছিল আজ তা শকুনের পায়ে দলিত। আর পতাকায় দেখছেন প্রিয় মুজিবের রক্তেরই দাগ।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যখন শেখ মুজিবের মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলার আকাশের অন্ধকারের কালো ছায়া নেমে এসেছিল। যখন সিঁড়িতে পড়ে থাকা মুজিবের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল, তখন কবি রফিক আজাদ সেই দৃশ্য কল্পনা করে লিখেছেন-
‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/ সিঁড়ি ভেঙ্গে রক্ত নেমে গেছে-/ বত্রিশ নম্বর থেকে/ সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/ অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।’
কবি এতটাই ব্যথিত ছিলেন যে, এই রক্ত তার কাছে মনে হয়েছে একটি জাতি গোষ্ঠীর রক্ত। এই রক্ত চলে যাচ্ছে সব জাতিকে মৃত করে দিয়ে। চলে যেতে যেতে দেখাচ্ছে তার সবুজ শ্যামল ফসলের মাঠ। কবি একটি জাতির অপূরণীয় ক্ষতির কথাই তুলে ধরেছেন গভীর মমতায় তার কবিতায়। শেখ মুজিবের অপরিহার্যতার ওজন উঠে এসেছে রফিক আজাদের কবিতায় বঙ্গোপসাগর আর সবুজ শ্যামল শস্যের উপমা থেকে।
শেখ মুজিবের মতো নেতা পৃথিবীতে আর এসেছিল কিনা এই নিয়ে যেমন তর্ক থাকতে পারে, তেমনি তাকে নিয়ে যে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে তার মধ্যে কোনটি সেরা কবিতা তা নিয়েও তর্ক থাকতে পারে। তবে নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা- এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামের কবিতাটি যে বাংলার মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন তৈরি করতে পেরেছে- সে বিষয়ে বোধ করি কারো দ্বিমত থাকবে না।
গুণ লিখেছেন-
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে:/ ‘কখন আসবে কবি’? /এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,/ এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,/ এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।/ তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?/ তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? ...
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে/ এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,/ লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,/ পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।/ হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,/ নিু মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে/ আর তোমাদের মত শিশু পাতা কুড়ানীরা দল বেঁধে।/ একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল/ প্রতীক্ষা মানুষের: কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতা খানি : / এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
শেখ মুজিবকে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণের সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে কোনো কবিই কবিতার ঐশ্বর্যে ঐতিহ্যমণ্ডিত করে তুলতে পারেনি, যেমন করে পেরেছেন নির্মলেন্দু গুণ। গুণের এ কবিতায় একই সঙ্গে শেখ মুজিবকে পাওয়া যায় তার বিশালতায় আবার পাওয়া যায় সেই রুদ্রকঠিন পরিস্থতি এবং সব পেশার মানুষের উপস্থিতির বর্ণনার মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতার কামনাকেও।
শেখ মুজিবকে নিয়ে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। আগামী দিনেও হবে। মানুষ কবিদের লেখনীর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হবেন এই মহান নেতার দেশপ্রেমের আদর্শকে ধারণ করতে।