মিজানুর রহমান খান
আজ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শোকাবহ সেই ঘটনার স্মরণে আয়োজন
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সে সময় নাকি তাদের ২০ জন এজেন্ট সক্রিয়; দুজন রীতিমতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায়। সেই কেজিবি ১৯৭৫ সালে বলেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএ সরাসরি জড়িত নয়। সম্প্রতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা র-এর সাবেক কর্মকর্তা আর কে যাদব তাঁর বই মিশন আর অ্যান্ড আ ডব্লিউতে লিখেছেন, ‘তারা সরাসরি জড়িত না থাকলেও অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া কারও কারও ওপর ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ কর্তাদের আশীর্বাদ ছিল।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায় কেবল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএরই।
বঙ্গবন্ধুর জীবনযাপন ছিল সহজ সাধারণ; কিন্তু তাঁর নিরাপত্তা–ব্যবস্থাও ছিল ঢিেলঢালা। তারই প্রমাণ ১৯৭৩ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে তোলা এই ছবি। ছবিতে দুজন পথশিশু উঁকি দিয়ে দেখছে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ছবি: পাভেল রহমান
পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কাও সিআইএ ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোশাদের ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন র। কাও যাদবের চোখে মহানায়ক; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তার নেপথ্যে অন্যতম মস্তিষ্ক। কাওর একাত্তরের ভূমিকার স্বীকৃতি অবশ্য ভারত দেয়নি। বাংলাদেশও দেয়নি বলে যাদব দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
১৯৭৫-এ সিআইএর পরিচালক ছিলেন উইলিয়াম কলবি, কেজিবির চেয়ারম্যান ইউরি আন্দ্রোপভ। ১৫ আগস্ট সম্পর্কে তাঁদের তেমন কোনো ভাষ্য জানা যায় না। মার্কিনিরা অবশ্য শেখ মুজিবকে সতর্ক করেছিল। সেদিক থেকে কাও ব্যতিক্রম। সানডের ২৩-২৯ এপ্রিল ১৯৮৯ সংখ্যায় তিনি এ সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। কাও লিখেছেন, ডিসেম্বর ১৯৭৪-এ তিনি নিজে ঢাকায় এসে মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের খবর দেন। কিন্তু মুজিব সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’
কাও আরও লিখেছেন, ‘প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে মার্চ ১৯৭৫-এ আমি ঢাকায় পাঠাই। শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তিনি জানান যে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ অংশের দুটি ইউনিটে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এসব সতর্কবার্তায় তিনি কান দেননি।’
ছেলেমেয়ে ও নাতি–নাতনির সঙ্গে একান্তে: বঙ্গবন্ধুর বাঁয়ে বড় মেয়ে শেখ হাসিনা, দুপাশে শেখ হাসিনার সন্তান পুতুল ও জয়, পেছনে শেখ রাসেল, একেবারে ডানে ফজিলাতুন নেসা মুজিব। ছবি: সংগৃহীত
অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের খবর কাও কীভাবে পেয়েছিলেন? মুজিবের খুব ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘এসব তথ্য পাওয়া গেছে নাজুকভাবে রোপণ করা এক সূত্র থেকে। যেকোনো মূল্যে তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।’
কেজিবির এক সপক্ষত্যাগী কর্মকর্তা ছিলেন ভাসিলি মিত্রোখিন। অতি গোপনীয় মহাফেজখানা থেকে হাতে নথি লিখে, জুতার ভেতরে করে এনে, রাত জেগে পরিত্যক্ত দুধের কার্টনে টাইপ করে, বাগানের মাটিতে তিনি পুঁতে রেখেছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সের সাহায্যে ১৯৯২ সালে সেসব ব্রিটেনে আনেন। গত ৭ জুলাই নথির সেই রত্নসম্ভার উন্মুক্ত করা হয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্চিল আর্কাইভস সেন্টারে মিত্রোখিনের নথিগুলো ৩৩টি বাক্সে সংরক্ষিত। দেখা যাবে তার মধ্য থেকে ১৯টি। কেমব্রিজের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু ও মিত্রোখিন যৌথভাবে একটি বই লিখেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পনেরোই আগস্ট সম্পর্কে তাতে পাওয়া যাচ্ছে সামান্য তথ্য: ‘মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরই কেজিবি সিআইএর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমে পড়ে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিদেশের গণমাধ্যকেও তারা ব্যবহার করে।’
সিআইএর বেশ কিছু নথিপত্র আমার ঘাঁটার সুযোগ হয়েছে। নথিপত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা কালিতে ঢেকে দিয়েছে। বহু নথি এখনো অপ্রকাশিত। ১৯৭৫-এর ১৫ ও ১৬ আগস্টে প্রস্তুত সিআইএর দুটি নথি পাওয়া গেল সিআইএর মেরিল্যান্ড মহাফেজখানায়। অভ্যুত্থানের বিবরণ সেখানে মামুলি। তবু সেখানেও কিছু অংশ অপ্রকাশিত। ১৫ আগস্ট সিআইএ বলেছে, ‘সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করেছে।’ ২১ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালেই তারা বলেছিল, মুজিব সরকারের পরিবর্তন হবে এক আকস্মিক আঘাতে। তাঁর উত্তরসূরি আসবে তাঁরই দল থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের মিত্র: ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
২০ মার্চ, ১৯৭৫-এ কর্নেল ফারুক জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছিলেন। ‘সিআইএ ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য অভ্যুত্থান’ শিরোনামে সেদিনই ওয়াশিংটনে একটি নথি প্রস্তুত হয়। সে দলিলের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে র-এর প্রধান আর এন কাও তো মার্চে বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয়বারের মতো সতর্ক করতেই তাঁর সহকর্মীকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন৷
রঙে রঙিন: শেখ কামালের বিয়েতে রং মেখেছেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব। ছবি: পাভেল রহমান
ওদের ক্ষমা নেই
সাংবাদিকের প্রশ্ন: ‘শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার জন্য আপনি কি অনুতপ্ত?’
সৈয়দ ফারুক রহমান: ‘না। তাঁর জন্য অনুতপ্ত নই।...ওঁদের (নিহত প্রেসিডেন্ট ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী) সরিয়ে দেওয়াই প্রয়োজন ছিল।’
—রয়টার্স, ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড, ৫ নভেম্বর ১৯৭৫
‘আমিই শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলাম। কারণ, এটাই ছিল একমাত্র পথ।’
—লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, বাংলাদেশ থেকে পলাতক সামরিক অফিসার গ্রুপের দলপতি (দ্য ভয়েস অব দ্য ন্যাশন, ব্যাংকক, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫)
‘ফারুক রহমান জানান, ব্যাংককে পৌঁছানোর পরেই তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান দূতাবাসে তাঁদের উপস্থিতির খবর জানিয়ে দিয়েছেন এবং ওই দুটি দেশে তাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।’
—ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫
শেখ জামালের বিয়েতে: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুলতানা কামাল, পারভীন জামাল, শেখ জামাল ও শেখ কামাল। ছবি: পাভেল রহমান
‘জনৈক মার্কিন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ফারুক আজ (৬ নভেম্বর) মার্কিন কনস্যুলেটে আসেন এবং তাঁর ও আরও ১৬ জন অফিসারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন।’
—ব্যাংকক পোস্ট, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫
‘খন্দকার মোশতাক পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।’
—ফারুক রহমান (দ্য ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, হংকং, ১৪ নভেম্বর ১৯৭৫)
‘ফারুক আরও জানান ব্যাংককে অবস্থানকালে তাঁরা ঢাকায় খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দূরপাল্লার টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন।’
— ব্যাংকক পোস্ট, ১৮ নভেম্বর ১৯৭৫
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারপত্র (১৯৭৫) অনুসরণে