আলী আজম মুকুল
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনলেই মনের মধ্যে একটি সার্বভৌমত্বের ছবি ভেসে ওঠে, যা শুধু একটি বিশেষ ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বই নয়, এই সার্বভৌমত্ব সব ক্ষেত্রের, সব বিষয়ের। তিনি একটি দেশের স্থপতি। একজন মহান জননেতার এর চেয়ে মহৎ কৃতি আর হতে পারে না। পৃথিবীতে খুব কম রাজনীতিবিদেরই এই বিরল কৃতিত্ব রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে ওই একটি জায়গায়ই আটকে রাখেননি; তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার আলো ছড়িয়েছেন সব ক্ষেত্রে। একজন মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শুধু একজন মহান নেতা হিসেবেই দেখবেন না, বরং তাঁর মধ্যে খুঁজে পাবেন একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, একজন কবি, একজন দার্শনিককে। সর্বোপরি সার্বিক গুণাবলির একজন মহান মানবের প্রতিচ্ছবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবিতার মতো করে বলতে ইচ্ছা করে- তুমি জন্মেছিলে বলে/জন্ম নিয়েছিল দেশ/মুজিব তোমার আরেকটি নাম/স্বাধীন বাংলাদেশ। তাঁর গুণের যেমন অভাব নেই, তেমনি বাঙালি জাতির জন্য তাঁর অবদানেরও কমতি নেই; যার যথার্থ ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো যোগ্য আমি হয়ে উঠিনি।
একজন তরুণ জনসেবক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যুবসমাজ নিয়ে ভাবনাটি আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। তাঁর বক্তৃতায় নানা সময়ে যুবসমাজের কথা উঠে এসেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স খুব একটা বেশি নয়। সে তুলনায় আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। তবু সত্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুবসমাজ নিয়ে যে ভাবনা ছিল, তা যদি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে আজ হয়তো এই বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবেই বিশ্বের বুকে পদচারণ করত।
তরুণ ছাত্রসমাজের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ বন্ধের সময় তোমরা তোমাদের মা-বাবার কাছে চলে যাও, যে যেখানে আছেন তাঁদের কাজে সাহায্য করো, অন্তত একটি গাছ লাগিয়ে হলেও তাঁদের পাশে দাঁড়াও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেকার সমস্যা নিয়ে বলেছেন। বলেছেন, আমার দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে বেকার সমস্যা দূর করতে হবে। একটি দেশের সমস্যা এবং সম্ভাবনা দুটিই দেশের যুবসমাজের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। যুবসমাজ বেকার থাকলে তারা বিপদগ্রস্ত হয়, দেশের জন্য ক্ষতিকর বোঝায় পরিণত হয়। আর কোনো দেশের যুবসমাজ যদি কর্মঠ হয় এবং তারা তাদের কাজের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, তাহলে ওই দেশের দ্রুত উন্নতি কেউ আটকাতে পারে না। যুবসমাজের দীপ্ত মেধা এবং সতেজ জ্ঞানের গতি এই সবুজ-শ্যামল বাংলাকে প্রকৃত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে পারে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের যে বড় বড় সমস্যার সমাধান শুরু করেছিলেন, যুবসমাজের কর্ম সমস্যা তারই একটি। তাঁর সৃষ্টিশীল মেধা যুবকদের অল্প পুঁজি থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, অন্তত একটি গাছ লাগিয়ে হলেও তোমরা তোমাদের মা-বাবাকে সাহায্য করো। এর অর্থ হলো, তোমার কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত না থাকলেও বসে থেকো না। তোমাদের যা আছে তা দিয়েই শুরু করো। তোমরা কাজের মধ্যে থাকো।
মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী। সে কিছু না করে থাকতে পারে না। তার ভালো কাজের সুযোগ না থাকলে সে খারাপ কাজ হলেও করবে। অতএব, অলস বসে থাকা যাবে না। এটাই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ। এই আদর্শ বাস্তবায়িত হলে যেকোনো দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। আমরাও আজ উন্নত জাতি হিসেবেই বিশ্বে মাথা উঁচু করে থাকতে পারতাম, যদি ১৫ আগস্টের ওই নির্মম ঘটনার জন্ম না হতো।
বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে শিখিয়েছেন জাতিকে। একটি দেশের মানুষ একত্র হয় জাতীয়তায় এবং সংঘবদ্ধ থাকে তাদের জাতিগত সাংস্কৃতিক চেতনায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেটা জানতেন। তাই তিনি পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে বিমান থেকে নেমে প্রথমেই বলেছিলেন, 'আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।' তাঁর এই কথার গভীর অর্থ আছে। আছে গভীর দূরদর্শিতাও। আমরা ভাষাভিত্তিক জাতি। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, 'আমি বাঙালি।' এই বাঙালি শব্দটিতেই আমরা একত্র। এই শব্দটিতেই আমরা সব কিছুর ঊর্ধ্বে এসে সংঘবদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে সবার মধ্যে যে ঐক্য চেয়েছিলেন, তিনি এই শব্দটির মধ্য দিয়ে সেই কথারই জানান দিয়েছেন। মানুষ সমাজ দ্বারা ঐক্যবদ্ধ। একটি সভ্য জীবনপ্রণালীর জন্য মানুষের ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প নেই, বঙ্গবন্ধু এ কথা জানতেন। সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশকে পিতার আসন থেকে যোগ্য অভিভাবকের মতোই তিনি বলেছিলেন, 'আমি বাঙালি।' এর পরই তিনি বলেছেন, 'আমি মানুষ।' এই কথারও গভীর অর্থ রয়েছে। তিনি বুঝিয়েছেন, আমরা মানুষ। আমরা মানবিক। আমরা মনুষ্যত্ব ধারণ করা প্রাণী, যা ১৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানুষের মধ্যেই প্রবল এবং প্রধান হিসেবে প্রবহমান। এই ঘোষণায় তিনি মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ না করারই কথা বলেছেন। তিনি এই ঘোষণার মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্যকেও দূর করতে চেয়েছেন। মানুষ শব্দটির মাধ্যমে সবাইকে একটি মানবিক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছেন। এবং শেষ করেছেন এই বলে যে, 'আমি মুসলমান।' জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এ কথাগুলো বলেছেন, যাতে ধর্মের সঙ্গে জাতিগত সংস্কৃতির কোনো সাংঘর্ষিকতা তৈরি না হয়।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা থাকার সুযোগ নেই। তাঁর আদর্শে চলার পথে অতীতে অনেক বাধা এসেছিল; কিন্তু সত্যকে সেই বাধা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এই বাধা শুধু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা হয়ে ওঠার গতি কমিয়েছে মাত্র; কিন্তু শত্রুরা সফল হয়নি, কখনো তারা সফল হবেও না। বাংলাকে সোনার বাংলা করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি তাঁর সুযোগ্য কন্যাই আজ দেশকে যখন সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে এগিয়ে চলেছেন- তাঁর সামনেও এসেছে অনেক বাধা, অনেক প্রতিকূলতা; কিন্তু কোনো কিছুই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার উন্নয়ন ঠেকাতে পারেনি এবং পারবেও না কোনো দিন। যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যার রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ়তায় গভীর ষড়যন্ত্র আর প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশবাসীর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভিন্নভাবে প্রশংসার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু বলতে পারি, পিতার হাতে স্বাধীনতা, কন্যার হাতে দেশ/বিশ্বমঞ্চে আলোকিত প্রিয় বাংলাদেশ।
আগস্ট মাস এলেই আমরা শোকার্ত হই। পুরো জাতি ভেঙে পড়ে বেদনায়। যেন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা শুধু শোকে কাতর হয়ে থাকলে জাতির জনকের আত্মার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে না। তাঁর আত্মার শান্তির জন্য তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হবে। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। তিনি বেকার সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন, দেশ থেকে বেকার সমস্যা দূর করতে হবে। তিনি মানুষের মধ্যে ঐক্য চেয়েছেন, শান্তি চেয়েছেন, তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের অবিচল থাকতে হবে, তা করতে পারলেই মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখানো হবে। একজন তরুণ জনসেবক হিসেবে জাতির কাছে এই আহ্বানের মাধ্যমেই জাতির জনকের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।