প্রেরণাদায়ী মহীয়সী নারী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

মামুনুর রশীদ

শেখ মুজিব একটি অমর কবিতা। ফেরদৌসি যেমন ৩০ বছর ধরে শাহনামা মহাকাব্য লিখেছেন, তেমনি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রচনা করেছেন শেখ মুজিব নামে পৃথিবীর আরেক শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য; যার প্রতিটি লাইনে সৃষ্টি হয়েছে এক রাষ্ট্রনায়কের গল্প। যে মহাকাব্যের স্পৃহায় পিতা মুজিব পেয়েছিলেন দীপ্ত প্রয়াস। পাকিস্তানি দুঃশাসন ও এর নাগপাশ থেকে উদ্ধার করা স্বাধীন বাংলাদেশ— এর সবটাই সম্ভব হয়েছিল এক মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অনুপ্রেরণায়। সেই ‘শাহনামার’ প্রতিটি চরণ সম্মিলিতভাবে আজ এক স্বাধীন বাংলাদেশ। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন একাকী কিংবা দলীয় নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে। দলের অসময়ে দক্ষ নাবিকের আসনে আসীন ছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

এ মহীয়সী নারী ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়া জন্মগ্রহণ করেন। ফুলের মতো গায়ের রঙ দেখে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। সেই নামেই সবার কাছে তার পরিচিতি হয়ে গেল। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা শেখ জহুরুল হক মারা গেলে দাদা শেখ আবুল কাশেম চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রেণুর বিয়ে দেন। পাঁচ বছর বয়সে মা মারা গেলে শাশুড়ি মা সায়েরা খাতুন রেণুর চোখের পানি মাটিতে পড়তে দেননি। গভীর মমতায় নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ফজিলাতুন্নেছাই প্রেরণাদায়ী মহীয়সী নারী।

নারীদের ঘরের বাইরে যেখানে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে পড়ালেখা তো কল্পনাই করা যেত না। তবু তিনি দমে যাননি। সে সময়ে ঘরে বসেই পড়ালেখা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের বিদ্যা ছাড়াই তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা মুজিবের জীবনীতে ফজিলাতুন্নেছা এক প্রেরণার নাম। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছার। পিতা মুজিব তার আত্মজীবনীতে সেই অবদানের কথা স্মরণ করেছেন প্রথমেই।

জীবনসংগ্রামের সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেও তিনি পরিবার সামলেছেন বেশ গুছিয়ে। সবকিছুর পরও তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ছায়াসঙ্গী। স্বৈরশাসক আইয়ুব সরকারের সময় রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে বঙ্গবন্ধুকে কারাবরণ করতে হয়। এ সময়ে কাপড় সেলাই করে বাড়ি ভাড়া থেকে সংসার চালানো সবটাই তিনি করতেন। মাথা ঠাণ্ডা রেখে তিনি তা সামলাতেন। সন্তানদের লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের পিতার অভাবটা নিজের স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতেন। এর পরও কষ্ট করে টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখতেন স্বামী শেখ মুজিবের জন্য।

বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত যে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, সেই সংগ্রামে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধু মুজিবের পেছনে ছায়ার মতো ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম মুজিবের অনানুষ্ঠানিকভাবে যখন বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ছিল তিন বছর, আর বঙ্গবন্ধুর ১০ বছর। পৃথিবী তখনো বর্তমান সভ্যতার আলোকিত পর্বে উদ্ভাসিত হয়নি। তবু শৈশব থেকে চিরসংগ্রামী মুজিবকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত  যিনি আগলে রেখেছিলেন অপার মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে, সংগ্রামের সাহস দিয়ে, তিনি হচ্ছেন বেগম মুজিব। যার ছিল না কোনো লোভ, মোহ। যিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিবের আপসহীন দৃঢ়তায়, এক মহান জাতীয়তাবাদী নেতার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্যোদয়।

পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন। যারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্গী হয়েছিলেন, বেগম মুজিব ছিলেন তাদের সর্বাত্মক প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, নেতৃত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোনো সংকটের কালো ছায়া ঘনীভূত হয়েছে, বেগম মুজিব সেই কালো ছায়া দূর করার জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই ৩২ নম্বর বাড়ি ছেড়ে কখনো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামি আসবাব, এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করেননি। নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনো নিজে নিয়ে যেতেন। একজন আদর্শ নারীর উদাহরণ।

নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী এ নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাকে আমরা স্মরণ করি ছোট পরিসরে কিছু কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের যে কালরাতে স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, সে সময়েও অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে। বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বেগম মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রীর মাতা হিসেবে নয়, একজন নীরব  দক্ষ সংগঠক, যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

বাঙালির সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অর্জনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গমাতার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন এমন এক প্রেরণাদাত্রী, আপসহীন, দূরদর্শী, কষ্টসহিষ্ণু, প্রত্যয়ী, নিরহংকারী, বাঙালি আদর্শ বধূ এবং মায়ের প্রতিচ্ছবি, যিনি বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজের সব কষ্টকে জয় করেছেন কিন্তু নিজে কোনো দিন পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে চাননি। মার্টিন লুথার কিংয়ের স্ত্রী করেটা স্কট কিং, ফ্রাংকলিক রুজভেল্টের স্ত্রী ইলিয়ানর, জুয়ান পেরোনোর স্ত্রী ইভা পেরোন,  নেহরুপত্নী কমলা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের পত্নী বাসন্তী দেবী, নেলসন ম্যান্ডেলার পত্নী উইনি যেমন তাদের কর্মগুণে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন, ঠিক একইভাবে ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, যার ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রচেষ্টাই বঙ্গবন্ধুর ‘জাতির পিতা’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

উত্তাল মার্চে বাংলার মানুষের ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর বঙ্গমাতা হাসিমুখে সামাল দিয়েছিলেন সেই বিপুল জনতার খাওয়া-পরা। মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য  নিয়ে তিনি মোকাবেলা করেছেন বৈরী পরিস্থিতি। কাঙ্ক্ষিত সেই বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও বঙ্গমাতার অনিচ্ছার কারণে রাষ্ট্রীয় বাসভবনে উঠলেন না। তাদের ঠিকানা সেই ৩২ নম্বর বাড়ি। ক্ষমতা তাকে কক্ষচ্যুত, মোহাবিষ্ট করতে পারেনি। বঙ্গমাতা সেই বঙ্গমাতাই। তার ভেতরে আসেনি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন। আগেও যেমন মোটা পাড়ের শাড়ি পরতেন, ফার্স্ট লেডি হয়েও তা-ই। আগের মতোই সেই সাদাসিধে জীবনযাপন। বঙ্গবন্ধু কোনো অনুষ্ঠানে জোর করে নিয়ে গেলেও সেখানে যেতেন সাদামাটাভাবে। কোনো বিদেশী মেহমান এলেও তাকে দেখে অবাক হতেন। বিনয়ী, নির্লোভ ও নিরহংকারী মহীয়সীর এ জীবনধারাই তাকে আদর্শ বঙ্গমাতারূপে বাঙালির মনে আসীন করেছে।

ঝাঁপিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। বিশেষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত মা-বোনকে সহযোগিতা ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেয়া, সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করেছিলেন তিনি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাঙালির ইতিহাসে হয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্মরণীয় এক নাম। নির্লোভ, নির্মোহ এ মানুষটির জন্মদিনে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তার প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

SUMMARY

1181-1.jpg