পাভেল রহমান
মহান সেই মানুষটিকে চোখের সামনে পেয়ে গেলাম একাত্তরে। পল্টন ময়দানে মানচিত্র-খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর জয় বাংলা বাহিনীর খুদে সদস্য হিসেবে দলের সঙ্গে কুচকাওয়াজ করে চলে এলাম ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে। বঙ্গবন্ধু লোহার গেট ধরে দাঁড়িয়ে। আমাদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন। সেই তাঁকে প্রথম দেখা।
১৯৭৩-এ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের আলোকচিত্রী। সেখানে বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু ছবি তুললাম।
১৭ মার্চ ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে কেন্দ্রীয় খেলাঘরের ছবি তুলতে এলাম ধানমণ্ডির বাড়িতে। জন্মদিনের আয়োজন বলতে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আর কচিকাঁচার আসরের খুদে বন্ধুদের গান। খেলাঘরের শিশুরা বঙ্গবন্ধুর গলায় পরিয়ে দিল লাল স্কার্ফ। বাড়ির নিচতলার বসার ঘরে শুরু হলো শিশুদের গান। বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে গান উপভোগ করছেন। বাইরে কিছু নেতাকর্মীদের সমাবেশ। জন্মদিনে কেক আর ফুল নিয়ে এসেছেন উপহার দিতে।
গাড়িবারান্দায় বঙ্গবন্ধুর সরকারি গাড়ি প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ছুটবেন গণভবনে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী আমাকে ছোট্ট একটা কেক তুলে দিলেন। কামাল ভাই বললেন, ‘আজ বিকেলে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের সবাই মিলে গণভবনে যাব বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে। তুমি চলে এসো ক্যামেরা নিয়ে।’
আবারও বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার সুযোগ হবে, এই উত্তেজনায় আমার আর দিন কাটে না। বিকেলের অনেক আগেই পৌঁছে গেলাম জাফরাবাদে। আবাহনীর ক্লাব তখন সেখানে। কয়েকটা গাড়ি ভর্তি করে আমরা ছুটলাম গণভবনে।
গণভবনের সবুজ লনে সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবিপরা বঙ্গবন্ধু। বসে আছেন একা। গোধূলির আলো তাঁর গালে। ঠোঁটে হাসি। ফুটবলার অমলেশদা, সালাউদ্দিন, নান্নু, চুন্নু, অলিউল, মামুন, হারুণ ভাই, তান্না ভাইকে সামনে পেয়ে বঙ্গবন্ধু যেন তাঁর বয়স ছাড়িয়ে নেমে এলেন খেলোয়াড়দের মাঝখানে। প্রোটোকল বলে কিছু আর তখন নেই। এক এক করে সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে শুরু করেছেন। খেলোয়াড়েরাও ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকে। কখন যেন তোফায়েল (আহমেদ) ভাই এসেও হাজির।
আমার তখন যেন ছবি তোলার শেষ নেই। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে সবুজ লনে। হঠাৎ কানে এল আমার নিজেরই নাম। কামাল ভাই বললেন, ‘আব্বা, ও আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার। নাম পাভেল।’
বিস্মিত বঙ্গবন্ধু কামাল ভাইকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবাহনীতে আবার ফটোগ্রাফারও আছে নাকি?’ আমার তখন হৃৎস্পন্দন তুঙ্গে। পা আটকে গেছে সবুজ লনে। মোটেই হাঁটতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিলেন কাছে। বললেন, ‘পাভেল। কী চমৎকার নাম তোমার!’ ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল। কী দিয়ে শুভেচ্ছা জানাব বুঝতে পারছি না। আমার হাতে ফুল নেই, শুধু ক্যামেরা। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের পুরোটাই কেটে গেল সাদামাটাভাবে। সেই ছিল তাঁর শেষ জন্মদিন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকালবেলা খবরটা শুনলাম রেডিওতে। বারবার মেজর ডালিমের গলা থেকে উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘোষণা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কিছুই বুঝতে পারছি না, কী বলছে এসব রেডিওতে? ফোন তুলে তিন তলায় কামাল ভাইয়ের কামরায় ফোন করছি। রিং বেজে চলল একটানা। ফোন করলাম রিসেপশনে।
কোথাও কোনো উত্তর নেই। নিস্তব্ধ হয়ে আছে পুরো পৃথিবী।