ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মহাভাষণের মর্ম বাণী


মোঃ হাশিম প্রধানীয়া
সংগ্রামী বাংলা বিক্ষোভে উত্তাল লাগাতার হরতালে অচল গোটা দেশ। স্বাধীনতাকামী বাঙালি শৃঙ্খল মুক্তির অগণিত অগণিত মিছিল ঢাকা নগরী পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। সব মিছিলে অভিন্ন শ্লোগান 'জয় বাংলা', বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, যেনো উত্তাল সমুদ্রের ক্ষুব্ধগর্জন। পদ্মা-মেঘনা, যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবন, পল্টনসহ সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে মানুষের ঢল ছুটে চলেছে রেসকোর্স ময়দানে। আওয়ামী লীগের জনসভায় মহাকবির ভাষণ শোনার জন্য। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের শাসন শোষণ থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। রমনার রেসকোর্সের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জানিয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান। দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এক অমূল্য গাথা বাংলার অভিসংবাদিত নেতা তাঁর ভাষণে তুলে ধরেছেন বাঙালির উপর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের চিত্র।

একাত্তরের এই দিনে লাখো বাঙালি সমবেত হয়েছিলো স্বাধীনতার ডাক শুনতে। মনে হয়েছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাস্তা এসে মিলিত হয়েছিলো রেসকোর্স ময়দানে। সেদিন সেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দশ লক্ষাধিক মুক্তি পাগল বাঙালিকে ''জয় বাংলা'' রণমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই ডাকের উম্মাদ স্বাধীনতা পাগল জনতা দীক্ষা নিলেন।

মার্চ মাস বাঙালি জাতীয় জীবনে একটি মহান গর্বের মাস। এ মাসটিতে রয়েছৈ বাঙালির অহঙ্কার। বাঙালির চেতনা ও গর্ব। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ২২ মিনিটের ভাষণে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। এই ভাষণে গন্তব্য নির্ধারিত হয় একটি স্বাধীনতা। এই ভাষণটিকে বিভিন্ন কবি আখ্যা দিয়েছিলেন ''মহাকাব্য'' হিসেবে। নিউজউইক ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধুকে poet of politics হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি রাজনীতির কবি।

এই ভাষণে ছিলো তদানিন্তন শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত বাঙালির প্রাণের কথা, মনের কথা, সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার অমোঘ বাণী। সাধারণ মানুষের মনের ভাষায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ভাষণে ছিলো আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। জনতার আস্থা বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু ভঙ্গ করেননি। হাটে-ঘাটে, মাঠে, ক্ষেত খামারে, কলকারখানায় মানুষ যে ভাষায় কথা বলে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সেই ভাষায় কথা বলেছিলেন। এই নিবন্ধে সেই শব্দেরই উল্লেখ করে ভাষণটির মর্মবাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এ কারণেই এই ভাষণ সাধারণ মানুষের প্রাণে গিয়ে আঘাত করেছে।

জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দুগুন বলেছেন, প্রতিষ্ঠিত কবি না হলেও বঙ্গবন্ধুকে একজন স্বাভাবিক কবি বলা চলে। এই প্রেক্ষিতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে কবিতার পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন অনেকই। এই ভাষণের প্রতিটি শব্দ সাজিয়ে বিশ্লেষণ করলে এক অপূর্ব কবিতার সমারোহ চোখের সামনে ভেসে উঠে। এই কবিতায় লুকিয়ে আছে বাঙালি জাতির জ্বালাময়ী জীবন, প্রতিটি ছন্দে সাধারণ মানুষের অন্তরের কথা, জাতিকে সংগ্রামে প্রস্তুত করার আহ্বান, শত্রুকে মোকাবিলা করার উদ্দীপনা, নুতন সৃষ্টির আহ্বান। এতে আশার আলো খুঁজে পাওয়া যায়।

৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলো ফৌজিসেনা জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এর আগেই বঙ্গবন্ধু এ জানুয়ারি রেসকোর্সের মাঠে জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের হাত তুলে শপথগ্রহণ করালেন। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে প্রতিটি সদস্য ৬ দফার উপর ভিত্তি করে সংবিধান রচনা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। বিশ্বাস ঘাতকতা করলে জনগণ এদের শাস্তি দেবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, এমনিক আমাকেও আপনারা ক্ষমা করবেন না। ২৭ জানুয়ারি ভুট্টো সাহেব ঢাকায় এলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকে মিলিত হলেন। তিনদিন লাগাতার আলোচনা করার পর ব্যর্থ হলো। এরপর পরই ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বাতিল করলেন। এ ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে তারা আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেননি। পহেলা মার্চ আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশন বাতিল করলেন। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ হরতালের ডাক দিলেন। হরতালে জনগণ সারা দিলো। সফল হলো। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান, আওয়ামী লীগের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। এরপর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনগণকে ইঙ্গিত দিয়ে প্রস্তুত করলেন আগামী দিনের সৈরাচারী ফৌজি শাসকদের মোকাবেলার জন্য। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা সবই হলো মার্চে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার ১৬৩তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫) গেটিসবার্গ যুদ্ধে শহীদদের সমাধি ভূমি উদ্বোধনকালে মাত্র তিন মিনিটের ভাষণ দেন। এই তিন মিনিটের ভাষণ ''গেটিসবার্গ অ্যড্রেখ'' নামে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মার্টিন লুথার কিং এর (জুনিয়র) ''আই হ্যাভ এ ড্রিম'' শীর্ষক ঐতিহাসিক ভাষণের সাথে ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা চলে। মার্টিন লুথার কিং এর সেদিনকার কণ্ঠের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নেলসন মেন্ডেলার ভাষণ এবং তাঁর জীবনের সঙ্গে শেখ মুজিবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ম্যাল কম এক্স, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চেগুয়েভার, কর্নেল নাসের এসব মানবদরদী ও জাতীয়তাবাদী নেতার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণের সালে ৭ মার্চের ভাষণের সামঞ্জস্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাদেরই মতো বিশ্ব পর্যায়ের নেতা। 

আমেরিকায় বাস করেন সাইফুল আলম চৌধুরী। সমাজ ও সাংস্কৃতি সেবক। ৭ মার্চের ভাষণের বিম্লেষণ করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ভাষণে যুক্তি-সংলাপ সঠিক শব্দচয়ন ও উপযুক্ত স্থানে প্রয়োগের প্রমাণ মিলেছে। এ ভাষণে সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানুষের মনের কথার আভাস মিলে। ৭ মার্চের ভাষণের সময় ছিলো বিকেল তিনটা কুড়ি মিনিট। স্থান ঢাকা রেসকোর্স ময়দান রোববার। শেষ ফাল্গুনের হালকা গরম। সকাল ছিলো উজ্জ্বল রোদে ভরা। তবে দুপুরের আগে আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন। এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিলো। বক্তা ছিলেন এক জনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রোদ আর মেঘের ছায়ায় রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনসমুদ্র। অপেক্ষা করে ধৈর্য ধরে বসে আছে কখন কবি আসবেন। শোনাবেন মুক্তির মর্ম বাণী। শত্রুরা আতঙ্কগ্রস্ত। প্রস্তুতি চলছে বাঙালিদের ধ্বংস করার।

আসলেন কবি, সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ধাপ পেরিয়ে মঞ্চে উঠলেন বীর কবি। অলিখিত কবিতা শোনাবেন। এ কবিতা মনের কবিতা, এ মনের কথা কাগজে লিখে বলা যায় না। মঞ্চে দাড়ালেন বীর দর্পে কবি। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের সমবেত দশ লক্ষাধিক বাঙালি বাংলাদেশের পতাকা হাতে গগনবিদারী শ্লোগান দিয়ে উঠলেন, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা। শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোললেন, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, আপোষ না সংগ্রাম, সংগ্রাম-সংগ্রাম, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। ৭ মার্চের ভাষণে আমরা শব্দের কারুকার্য, ধ্বনি ও শব্দের ব্যবহার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ও অর্থের মাত্রিকতা লক্ষ্য করি। পাঠকবৃন্দ আসুন এবার দেখা যাক ওই ভাষণের বিশেষ বিশেষ দিকগুলো বঙ্গবন্ধুর বাষণে জাতির নিজেরও বিবেকের প্রশ্ন, কি অন্যায় করেছিলাম? কি পেলাম আমরা? কিসের আরটিসি, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? (জাতির জন্য প্রশ্ন) ভাষণে উচ্চারিত ব্যক্তি বর্গের নাম : আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, শেখ মুজিবুর রহমান। যে সকল স্থানের নাম উচ্চারণ হয়েছে সেগুলো হলো- ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, পেশোয়ার, করাচি। 

ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন প্রসঙ্গে পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান, বাংলা, পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বের কথাও তাঁর ভাষণে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ ও মেয়াদ উর্ত্তীনের পূর্বেই ক্ষমতাচ্যুতি, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন, ১৯৬৬ এর ৬ দফা প্রস্তাব, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, ১৯৭০ এর নির্বাচনও নতুন ষড়যন্ত্র। ভাষণের উচ্চারিত শব্দ চয়নও আবেগ, চ্যালেঞ্জ, আমার ভাই এর রক্তে রাজপথ রঞ্জিত, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। উপরের বাক্য শব্দগুলোর মধ্যে আমার 'র' এর 'ন' অনুপ প্রভাব দেখতে পাই। ৭ মার্চের ভাষণে সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রবাদ এবং সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত উপমাও উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ভাতে মারবো, পানিতে মারবো, অর্থাৎ আঘাত দিয়ে নয় উপবাসে রেখে কিংবা অন্য কৌশলে শত্রুকে কাবু কিংবা বশ করা হবে। এই অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ব্যবহৃত প্রবাদ বাস্তবেও রূপ লাভ করেছিলো অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। 

ভাষণে বিভিন্ন পর্যায়ে শব্দগুলো কাব্যে রূপ নিয়েছে। যেমন জীবনের তরে, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। তেইশ বছরের ইতিহাস। বাংলার অত্যাচারের ইতিহাস। বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আত্মনাদের ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। আমরা আরো খুঁজে পাই সমতট দক্ষিণ বাংলার ভাটির অঞ্চলের সাধারণ মানুষের চলতি ভাষা। তো, ভায়েরা আমার, সবই, বচ্ছর (বছর) সাততই (সাতই) বোন্ধ (বন্ধ), শুখায় (শুকনো), যদ্দুর দমাতে, দাবায়ে, দেবার, বায়নাপত্র, পয়সা, পারবা (পারবে) পাড়া পৌঁছায়ে, রাখবা (রাখবে) যাতে (গিয়ে) পানারো (পনের) ষোল ইত্যাদি।

শব্দ ও বাক্যাংশের অর্থের সম্প্রসারণ ঘটেছে কোন কোন অংশে। সেই বাক্য সমূহ সেই সময়কার বৈরী পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ছিলো। আমি যা বলি তা মানতে হবে। (নির্দেশ অর্থে অথোরিটিসহ) তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। (সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার আভাস ও মনোবল যোগানো) আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি জোড়া সমার্থক শব্দের বহুল ব্যবহার ও ভাষণে বিশেষভাবে নাপত্র, হিন্দু-মুসলমান, সামরিক আইন মার্শাল ও ফৌজদারী, বাঙালি নান বাঙালি, হাইকোট-সুপ্রিম কোর্ট ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সর্বাধিক উচ্চারিত বাক্যাংশ। বঙ্গবন্ধুর স্বভাবগতও হৃদয় থেকে অকৃত্রিম ভালবাসা আর আবেগ ভরা। বঙ্গবন্ধুর মনের কথা আমরা, আমরা গরিব, আমার বাংলা, আমার মায়ের, ভায়েরা আমার, আমার দাবি, আমার দেশের, আমার অনুরোধ, আমার মানুষ, আমার রিলিফ কিমিট, আমার সঙ্গে, বাংলার পূর্ব বাংলার, বাঙালির ইতিহাস, বাংলার মানুষ, বাংলার অত্যাচার, বাংলার মানুষকে। বাংলার মানুষকে বঙ্গবন্ধু এতো ভালো বাসতেন, তাই হৃদয়ের গভীরে এতে টেনে নিয়েছেন। আত্মবিশ্বাসে, সমগ্র বাঙালি জাতিকে তিনি এক আত্মায় মিশিয়ে নিয়েছেন যে, বাঙালিকে তুমি বলে সম্বোধন, নির্দেশে আলিঙ্গন করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা অনন্য ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভষণে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালি জাতিকে তুমি বলে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বই ইনশাল্লাহ। ঘড়ে ঘড়ে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু কোন কোন জায়গায় জোর বা টেস দিয়েছেন। যেমন আজ, আমি, মানুষ, সম্পূর্ণভাবে। মানুষও দেশের মাটির জন্যে বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালবাসার প্রতিস্ফুরণ ঘটেছে ভাষণে। তিনি বলেছেন, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিতে চাই, যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, শহীদের রক্তে উপর পাড়া দিয়ে আর টিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। 

এখানে দাবায়ে, বলে দেবার, আমার লোককে, রক্ত পাড় ইত্যাদি শব্দ বা শব্দ বৃন্দের সাহায্যে ৭ মার্চের ভাষণ অর্জন করেছে বাংলার প্রকৃত লোকায়ত চরিত্র। ভাষণে তৎসম, তদ্ভব, দেশী, আরবি, ফারসি, ইংরেজিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শব্দের আশ্চর্য অভতূপূর্ব সমন্বয়ে সুন্দর প্রয়োগ ও ব্যবহার ভাষণটিকে ব্যাপক ভাবে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য কোনো নেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মতো সাধারণ মানুষের ভাষা এতো সাবলীল ও স্পষ্টভাবে পাওয়ার নজির বিরল। শব্দগুলো হলো আজাদ, গোলাম, হরতাল, গুলি, দরজা, কসাইখানা, খাজনা, কাচারি, ফৌজদারী, লুটতরাজ, রিক্সা, হুকুম, খতম, দোকান, অক্ষর, পরিষ্কার, পয়সা, বৈঠক,অস্ত্র, বদনাম, মোকাবেলা, সংগ্রাম, দোষ, হাজির, দুর্গ, হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জজকোর্ট, ব্যাপক, রেল, লঞ্চ, স্টেশন, রেডিও, টেবিল, ট্যাক্স, ব্যারাক, মেজোরিটি, সেক্রেটারিয়েট, কনফারেন্স, অ্যাসেম্বলি, মার্চ, সেক্রেটারী, প্রেসিডেন্ট, ঢাকা, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, রাউন্ড টেবিল, ওয়াপদা, রিলিফ কমিটি, সেমি গভর্নমেন্ট, নিউজ, আওয়ামী লীগ, কোটি, জোর, কলকারখানা ইত্যাদি।

৭ মার্চের ভাষণে শব্দের সংমিশ্রণে সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন ধরুন- দুঃখভরাক্রান্ত মন, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, বুঝে শুনে কাজ, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আমুন, ফেলুন, বিচার করুন। এ ছাড়াও এ ভাষণে বাক্যের ব্যবহার হয়েছে যেমন- আমি বললাম, তিনি বললেন, প্রভৃতি বাক্যের ব্যবহার ভাষণকে আরো প্রাণবন্ত ও জোরদার করে তুলেছে। ভাষণে প্রথম পর্বে সংগ্রাম-আন্দোলন ও অত্যাচারের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ ও ষড়যন্ত্র, আইয়ুব খান কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন, ঐতিহাসিক দফা প্রণয়ন ও গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। 

দ্বিতীয় পর্বে সমসাময়িক ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ষড়যন্ত্র, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক আর বিভিন্ন শর্ত আরোপের বিবরণ।

তৃতীয় পর্বে সার্বিক পরিস্থিতির উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা তথা সারা বাংলাদেশের উপর শেখ মুজিবুর রহমানের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই তৃতীয় পর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা। 

জনগণকে সংগ্রামের জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। ধীরে ধীরে জনগণকে মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের শর্তাবলি- সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, সকল হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে জনগণের প্রতিনিধির কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের শর্তাবলি- সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, সকল হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে, জনগণের প্রতিনিধির কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে হবে।

ভাষণের নির্দেশাবলি (পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা হয়েছে) কোর্ট-কাচারি আদালত ফৌজদারী, শিল্প প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গবর্ণমেন্ট দপ্তর সমূহ ওয়াপদা বন্ধ থাকবে। রিক্সা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল, লঞ্চ চলবে। মাসের ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নেবেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা যারা শহীদ বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের সাহার্যার্থে রিলিফ কমিটিতে অর্থ সাহায্য দানের আহ্বান। হরতালে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের বেতন দানের জন্য শিল্প মালিকদের প্রতি নির্দেশনাবলি তা মানতে হবে। (আত্মবিশ্বাসের প্রতিফল) অর্থাৎ দেশের সার্বিক মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা, ট্যাক্স প্রদান না করা। রেডিও টেলিভিশনে অসহযোগ বাঙালিদের সংবাদ প্রচারের নির্দেশ ব্যাংকের কর্মচারীদের প্রতি আদেশ, টেলিফোন বিভাগের প্রতি নির্দেশ সর্বোপরি স্বাধীনতার পক্ষের সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ।

একাত্তরের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যেনো বাঙালি জাতির জন্য একটি উপহার। এই উপহারের জন্য হাজার বছর ধরে বাঙালি অপেক্ষা করেছিলো। বিগত দশকের পুঞ্জিভূত আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটলো একাত্তর সালের ৭ মার্চে রেসকোর্সে রাজনৈতিক কবি শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ দিয়ে। কবি শামসুর রহমানের ''ধন্য সেই পুরুষ'' ধন্য বাঙালি জাতির নয়ন মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ধন্য ঐতিহাসিক মার্চের ৭ মার্চ।

মোঃ হাশিম প্রধানীয়া

লেখক পরিচিতি : একাত্তরের মহান সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারী, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সমালোচক অধ্যাপক পাড়া, চাঁদপুর।

SUMMARY

1178-1.png