এরশাদুল আলম প্রিন্স
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ভাষণ। আজ অবধি এমন রাজনীতিক বিশ্ববাসী পায়নি। একটি নিপীড়িত জাতির আত্মোপলব্ধির শ্রেষ্ঠতম দিন ৭ মার্চ। এ দিন আমাদের সমুখে উন্মোচিত হয়েছিল আমাদের হাজার বছরের যাপিত জীবনের খতিয়ান।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ভাষণ। আজ অবধি এমন রাজনীতিক বিশ্ববাসী পায়নি। একটি নিপীড়িত জাতির আত্মোপলব্ধির শ্রেষ্ঠতম দিন ৭ মার্চ। এ দিন আমাদের সমুখে উন্মোচিত হয়েছিল আমাদের হাজার বছরের যাপিত জীবনের খতিয়ান। ইতিহাসের আয়নায় হয়েছিল নিপীড়িত জাতির আত্মদর্শন। উন্মোচিত হয়েছিল তার ভবিষ্যতও। বাঙালি-জীবনের শ্রেষ্ঠ মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই দিনের সেই ভাষণ তথা মহাসমাবেশে নির্ধারণ হয়েছিল আমাদের হাজার বছরের নিয়তি, খুলে গিয়েছিল মুক্তির দখিন দুয়ার।
কিন্তু ৭ মার্চের প্রেক্ষাপট হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। যদি অন্তত পাকিস্তান শাসনকাল ধরি, তাতেও দুই যুগের ইতিহাস। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ ও ১৯৭১। ইতিহাসের একেকটি মাইলফলক। কিন্তু ৭ মার্চ শুধু দুই যুগের শোষণের ফলে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো জনবিস্ফোরণ না। এর পেছনে কাজ করেছে বাঙালির শত বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। ৭ মার্চ কেবল সেই শত বছরের বঞ্চনার ঢেউ, আছড়ে পড়েছিল বাঙালি চেতনার সর্বোচ্চ চূড়ায়। বাঙালি তাই গলা ছেড়ে গেয়েছে মুক্তির গান। বজ্র কণ্ঠে শুনিয়েছে স্বাধীনতার কথা। বঙ্গবন্ধু স্বকণ্ঠে ধারণ করেছেন সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠকবিতাখানি।
তিনটে কুড়ি মিনিট। বঙ্গবন্ধু এলেন। গাড়ি থেকে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই লাখো জনতার মিছিল “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “শেখ মুজিবের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। বাঙালি সেদিন তৈরিই ছিল এমন একটি ঘোষণার জন্য। সিঁড়ি বেয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তিনি মঞ্চেউঠে দাঁড়ালেন। যেন ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন এক মহানায়ক। যার মাধ্যমেই রচিত হবে একটি জাতির মু্ক্তির ইতিহাস-যার স্বাধীনতার মন্ত্রপাঠে আমরা পাবো মুক্তির স্বাদ।
কত মানুষ গিয়েছিল সেই মহাসমাবেশে? ইতিহাসে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে কোনো বর্ণনাতে আছে ৩ লক্ষ, আবার কোনো বর্ণনাতে ৪ থেকে ৫ লক্ষও পাওয়া যায়। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশ থেকেই সেদিন রেসকোর্স ময়দানে জমায়েত হয়েছিল লাখো জনতা। মানুষ উন্মুখ হয়েছিল একটি দিক নির্দেশনার জন্য, একটি ঘোষণার জন্য।
ভাষণের প্রথম শব্দযুগল ছিল, ‘ভা(ই)য়েরা আমার’। এরপর শুরু করলেন তার ভাষণ এক সহজাত ভঙ্গীমায়। বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে তার নিজস্ব বাচনেই সে ভাষণ দিলেন। কিন্তু সেদিনের সেই ভাষণ অন্য সব ভাষণের থেকে ব্যতিক্রম। অনন্যসাধারণ এক আবেগ ও উপলব্ধি জাগায় সে ভাষণ।
সেদিনের সেই মহাসমাবেশের তিনিই একমাত্র বক্তা যা বাংলাদেশতো বটেই, বিশ্বেও বিরল। তিনিই একমাত্র বক্তা, সঞ্চালক, নির্দেশদাতা ও সমাপনাকারী। বঙ্গবন্ধুতেই শুরু, বঙ্গবন্ধুতেই শেষ। রাজনৈতিক সমাবেশের ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির অবিচল পূর্ণ আস্থার প্রতীক। এটি এক অনন্য ‘গণতান্ত্রিক ম্যানডেট’। বঙ্গবন্ধু ভাষণেও জনগণের থেকে সেই স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, যখন তিনি বলেন, ভায়েরা আমার, আমার ওপর বিশ্বাস আছে? লাখো কণ্ঠের ‘হ্যা’ সূচক ধ্বনিতে মুখরিত হলো রেসকোর্স। মূলত ’৭০ এর নির্বাচনেইতো এদেশের জনগণ মুজিবের ওপর পূর্ণ আস্থা দিয়ে দিয়েছেন। তারপরও এ ভাষণে আবার সে আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করা হয়। কারণ, স্বাধীনতার ঘোষণার প্রাক্কালে জনগণের ম্যান্ডেট থাকার বিষয়টিকে শাসকচক্র তথা বিশ্ববাসীকে আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া।
দ্বিতীয় বাক্যটি ছিল, ‘আজ দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হয়েছি’। এর মাধ্যমে তিনি অব্যক্ত কিন্তু সুষ্পষ্টভাবেই সেদিনের মহাসমাবেশের প্রেক্ষাপটটি বলে দিলেন। কি বলবেন নেতা-তা নিয়ে নানা সংশয় থাকলেও কেন আজকের সমাবেশ তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিলনা জনগণের মাঝে। বাকি ছিল একটি দিক নিদের্শনার। যা সেদিনের বক্তব্যে পরিস্কার হয়ে গেছে। পথ এখন একটাই-বাচঁতে হলে লড়তে হবে।
‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিকে আর একবার মনে করিয়ে দিলেন। বাঙালি তার জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছে একটি রাজনৈতিক সমাধান। কিন্তু পাকিস্তান শাসকচক্র সমাধানের পথে না হেঁটে রক্তাক্ত পথেই পা বাড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে লক্ষ জনতাকে ‘আপনি’ নয়, বরং ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। প্রথমে তিনি ‘আপনি’ দিয়েই শুরু করেছেন-যা একটি আনুষ্ঠানিক ভাষণে হয়ে থাকে। এরপর তিনি ভাষণের যথাস্থানে ‘তুমি’তে চলে আসেন-যা একজন কর্তৃত্ববান যোগ্য রাজনৈতিক নেতা ও অভিভাবকের পক্ষেই সম্ভব। ৭ কোটি মানুষের হৃদয়ের কথা শুনতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের কোটি কণ্ঠকে ধারণ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ না, এটি একটি জাতির ‘আত্মকথা’।
‘৭১ এর ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন। জনগণের ক্ষমতায় পাকিস্তানি শাসকচক্রের যতো ভয়। তাই তারা এরকম সিদ্ধান্ত নিল। ’৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আবির্ভাব হয়। কিন্তু ইয়াহিয়াচক্র তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর ফাঁদে পা দিলেন। অধিবেশন স্থগিত করা ছিল পাকিস্তানপ্রেমি শাসকচক্রের অন্যতম হঠকারী সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের ফলে বাঙালির মনে পাকিস্তান শাসনের প্রতি যে অনাস্থা সৃষ্ট হয় তা আর ফিরে আসেনি। বরং নানা টালবাহানা করে অবশেষে বাঙালি নিধনযজ্ঞে নামে পাকিস্তানি সামরিকজান্তা।
দেশের প্রকৃত রাজনৈতিক অবস্থা অনুধাবন না করে ইয়াহিয়া বরাবরের মতোই ভারতকে এর মধ্যে টেনে আনলেন। পাকিস্তানেও ‘ভারত’ রাজনীতির প্রলাপ বকলেন (the general situation of tension created by India has further complicated the whole position)। আইয়ুব-ভুট্টো-ইয়াহিয়া-মোনায়েম খানচক্র বাঙালি মুসলমানদের প্রতি কখনোই আস্থা রাখতে পারেনি। কারণ তারা জনগণের ওপরই আস্থা রাখতে পারেনা।
বাঙালিদের প্রতি ছিল তাদের সহজাত ঘৃণা ও অশ্রদ্ধাবোধ। আইয়ুব খান উন্নয়ন দশক পালন করেও জনগণের ওপর শেষ ভরসা করেত পারেননি। তার তথাকথিত ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ বইতে উঠে এসেছে বাঙালিদের প্রতি তার সহজাত অশ্রদ্ধাবোধ ও ঘৃণার কথা। নিজের তথাকথিত গণতন্ত্রের ফর্মুলা প্রয়োগ করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সব কৌশলই প্রয়োগ করেছিলেন আইয়ুব খান।
আসলে যুগে যুগে যারা জনগণের ওপর আস্থা না রেখে বন্দুকের নলের ওপর আস্থা রাখেন তারা সবাই একই পথের পথিক। তারা ভেবেছিল এভাবেই বুঝি দাবিয়ে রাখা যাবে বাঙালিকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সতর্ক করলেন, সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা।’
তারা চেয়েছিল, বন্দুকের নল দিয় শুধু ক্ষমতা নয়, অবাস্তব মানচিত্রও বুঝি রক্ষা করা যাবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ইয়াহিয়া নিজেই বয়ান করেছেন সে কথা, ‘It is the duty of the Pakistan Armed Forces to ensure the integrity, solidarity and security of Pakistan, a duty in which they have never failed.”। কিন্তু একটি দেশের integrity, solidarity ও security- রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর ও প্রধান নিয়ামক হলো জনগণের শক্তির বিশ্বাস করা। বন্দুকের নল দিয়ে মারপিট বন্ধ করা যায়, জনবিস্ফোরণ না।
অত:পর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ‘টালবাহানা’র আর বাঙালির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ১৮ দিন পর ঢাকার রাস্তায় নেমে এলো অপারেশন সার্চ লাইট। এ যেন অন্ধকারে আলোর সন্ধান। বাঙালি প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান শাসকচক্র আর আলোর মুখ দেখেনি। শুরু হয় বাঙালির জনযুদ্ধ, জন্মযুদ্ধ।
৭ই মার্চের সে ভাষণ পুরো জন্মযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছে। আজও করছে বাঙালিকে। তাই যতোবার শুনি, শিহরিত হই। রক্তে লাগে দোলা। কণ্ঠ হয় রুদ্ধ। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের উত্তর প্রজন্ম, শহীদের রক্তের সুবিধাভোগী-আসুন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই সে রক্তের ঋণ শোধ করবার। পথ একটাই-‘বাংলাদেশ’।