নিতাই চন্দ্র রায়
যে মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না একটি মানচিত্র ও লাল সবুজের পতাকা পেতাম না আমরা, সেই মহামানবের নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠানো নির্মাণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে অভাবিত উন্নয়ন হয়েছে তা স্বাধীনতা ছাড়া কোনো দিনই সম্ভব হতো না। মানুষের গড় আয়ু, বাষিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সাক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, স্যানিটেশন, প্রভৃতি সূচকে বাংলাদেশ উপমহাদেশের অনেক বড় বড় দেশকে পিছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে উন্নয়নের মহাসড়কে। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার বাস্তব ও যুগপোযোগী কর্মসূচি গ্রহণের ফলে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার তদানীন্ত গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মায়ের নাম সায়ারা খাতুন। পিতামাতার চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। খোকার শৈশব কাটে টুঙ্গিপাড়ার এক নিভৃত গ্রামে। ৭ বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে বঙ্গবন্ধু পড়শোনা শুরু করেন। তিনি ৯ বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে এবং পরে স্থানীয় মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে ১৪ বছর বয়সে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর লেখাপড়া সাময়িকভাবে বিঘিœত। ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন নেছার বিয়ে সম্পন্ন হয়। তাঁরা দুই কন্যা- শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের জনক-জননী।
ছাত্র জীবন থেকে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে এন্ট্রেন্স পাস করেন এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টারমিডিয়েটে ভতি হন এবং বেকার হোস্টেলে অবস্থান করেন। এই বছরই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি সক্রীয় রাজনীতিতে জড়িয় পড়েন এবং মুসলিমলীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এবং ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে কলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরোধ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নিবাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের আসনে মুসলীম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন এবং প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচন কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ওই বছর ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবির পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশে সারাদেশের গ্রামগঞ্জে গণসংযোগ করেন।১৯৬৮ সালে পাকিস্তানকে বিছিন্ন করার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালে ছাত্রজনতার প্রবল আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের কারণে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য আসামি ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় আন্দোলনের আগুন জ্বলে ওঠে। ৩রা মার্চ আওয়ামী লীগের ডাকে সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পারিত হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র থেকে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। ওই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াল আহবান জানান। তিনি বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য জনাব ভুট্টো ও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য আনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা বিডিআর সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অুনষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের মহান আত্মত্যাগ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৯২ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছলে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ এবং ঋণের দায়ে জর্জরিত হাজার হাজার কৃষককে সার্টিফিকেট মামলা থেকে নিঃশর্তে মুক্তি দেন। তার সময়ে ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ করা হয়। এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী পুনর্বাসন সংস্থা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে নতুন আশা উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী উচ্চবিলাষী অফিসার নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, ছোট ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিলসহ ১৬ জন আত্মীয়-স্বজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ঘাতকদের ধারণা ছিল- বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে বাংলার ইতিহাস থেকে মুছে যাবে শেখ মুজিবের নাম। কিন্তু ঘাতকের সেই দুঃস্বপ্ন কোনো দিনই পূরণ হবে না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন উচ্চারিত হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন বাংলার পাখির গানে, নদীর কুলুকুল ধ্বনিতে ও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জনে, শিল্পীর রঙের তুলি ও কবিতার ছন্দ-উপমায়। কালের কষ্টিপাথরে তিনি থাকবেন দীপ্যমান। সারা পৃথিবীর খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি থাকবেন অনন্ত প্রেরণার উৎস হিসেবে আজীবন।
[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ, ময়মনসিংহ]