বঙ্গবন্ধুর শৈশবের নদী বাঘিয়া এবং একটি প্রস্তাব

  
শেখ রোকন

কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিসৌধ এবং তার পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছোট্ট নদী বাগিয়া বা বাঘিয়া, মতান্তরে বাঘিয়ার দেখে আসার পর থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র একাধিক স্থানে বৃহত্তর খুলনা ও ফরিদপুরকে ভাগকারী বৃহৎ নদী মধুমতির প্রসঙ্গ থাকলেও, টুঙ্গিপাড়ায় তার পৈতৃক ভিটার পাদদেশ ঘেঁষে প্রবাহিত ছোট্ট বাঘিয়া নদীর নাম নেই। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্ম-জনপদ গুজরাটের আরব সাগর-তীরবর্তী পোরবান্দারেও প্রবাহিত হয়েছে ছোট্ট একটি নদী, নাম অসমাবতী। তার লেখা গ্রন্থাবলিতেও এই নদীর উল্লেখ নেই। অনেকেই জানেন, গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও জে দং সাঁতারের প্রতি কতটা অনুরাগী ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে যখন তিনি চীনের সর্বোচ্চ ক্ষমতায়, তখনও সদলবলে ইয়াংজি নদীতে বা উত্তর চীন সাগরের বিক্ষুব্ধ সৈকতে প্রায় নিয়মিত সাঁতার কাটতে যেতেন। আরও জানা যায়, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের আগেও তিনি বন্ধুদের নিয়ে নদীতে সাঁতার কাটতেন। এর সূচনা হয়েছিল তার বাড়ির পাশের ছোট্ট 'লিয়ান' নদীতে; সেই শৈশবে। অবশ্য তিনিও সেই নদীটির কথা উল্লেখ করেননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমন, মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, চেয়ারম্যান মাও জে দং_ এশিয়ার রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতিতে বিপুল প্রভাব বিস্তারকারী ও তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এই 'ট্রিপল এম' (মুজিব, মোহনদাস, মাও) তাদের লেখালেখি বা আত্মজীবনীতে যে শৈশবের নদী তিনটির কথা প্রায় অনুল্লেখ্য রেখেছেন, তার একটি কারণ হতে পারে পরিণত বয়সে তাদের সামনে ছিল গোটা জাতি, নতুন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা-ভাবনা। সেই রাষ্ট্রে হাজারো নদী প্রবাহিত হয়। সব নদী ও তার অববাহিকার জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, অধিকার, স্বাধীনতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হতো তাদের। যে স্বাধীন, স্বাবলম্বী বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের স্বপ্ন স্ব স্ব জাতির এই পিতাত্রয়ী দেখেছেন, সেখানে নিজের শৈশবের নদীসহ অন্য সব নদীই সমৃদ্ধির প্রবাহ হয়ে বয়ে চলে। সেই বিবেচনা থেকেই হয়তো বাংলাদেশ, ভারত ও চীন তাদের বড় নদীতে পরবর্তীকালে এই তিন মহান রাষ্ট্রনায়কের নাম স্থায়ী করে রেখেছ। আমাদের প্রবল যমুনার ওপর নির্মিত এখন পর্যন্ত দেশের বৃহত্তম (৪.৮ কিলোমিটার) 'বঙ্গবন্ধু সেতু' দেশের দুই অংশকে প্রথমবারের মতো সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করেছে। ভারতের বিহারে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে সে দেশের বৃহত্তম (সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার) 'মহাত্মা গান্ধী সেতু'। চীনের ইয়াংজি রিভার ব্রিজ যদিও সরাসরি মাও জে দংয়ের নামাঙ্কিত নয়; সেখানে রয়েছে তার এক বিরাট ভাস্কর্য।

ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতের একটি পার্থক্য হচ্ছে, বড় নদীতে তাদের রাষ্ট্রের স্থপতির স্মৃতি ধরে রাখার পাশাপাশি তারা শৈশবের ছোট্ট নদীটিকেও যথাসাধ্য সংরক্ষিত রেখেছে। মহাত্মা গান্ধীর জন্মভূমি পোরবান্দারে তার পৈতৃক ভিটার পাশাপাশি অসমাবতীও পরিণত হয়েছে পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্র। চেয়ারম্যান মাওয়ের জন্মভূমি শাওশানচোং-এ তার পৈতৃক ভিটার পাশাপাশি শৈশবের নদীটিও দেখতে যান অনেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশবের নদী বাঘিয়া যেন বড়ই অবহেলিত।

বঙ্গবন্ধুর শৈশবের নদী বাঘিয়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বর্ণি বাঁওর থেকে উদ্ভূত। এই বাঁওড় মধুমতির পতিত ধারা, অশ্বখুরাকৃতি জলাভূমি। বর্ণি থেকে গোপালগঞ্জের বিল অঞ্চল ছুঁয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধির পাশ দিয়ে ডুমুরিয়ার কাছে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে ছোট্ট ও স্বচ্ছতোয়া নদীটি। এরপর এক ধারা মধুমতিতে নেমেছে, অপরটি চলে গেছে কোটালীপাড়ার দিকে।

সেপ্টেম্বরের সি্নগ্ধ সকালে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ ঘিরেও ছিল শরতের সি্নগ্ধতা। পুরো কমপ্লেক্স ঘুরে পেছন দিকের ফটক দিয়ে টুঙ্গিখাল পেরিয়ে হাঁটা দূরত্বে টুঙ্গিপাড়া থানার সামনের বাঘিয়া নদীর তীরে গিয়ে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠেছিল। বস্তুত প্রায় এক দশক ধরেই ইচ্ছে ছিল জাতির জনকের সমাধিসৌধে যাওয়ার। একই সঙ্গে তার শৈশবের নদীটিও দেখে আসা। কারণ সমাধিসৌধে যেমন পরিণত বঙ্গবন্ধু চিরনিদ্রায় রয়েছেন, তেমনই এই নদীতে শায়িত রয়েছে তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। শিশু মুজিব এই নদীতেই সাঁতার কেটে, স্নান করে, বৈকালিক হাওয়া খেয়ে বড় হয়েছেন। দীর্ঘ কারাবাসের স্বল্পকালীন বিরতিতে যখন গ্রামের বাড়িতে ফিরতেন, নিশ্চয়ই এই নদীর তীরে বসেই মন শান্ত করতেন। ঘাতকের হাতে শহীদ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে যখন হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া আনা হয়েছিল, তখন তার কফিন যারা বহন করেছিলেন তাদের একজন মো. আবদুুল হাই ২০১৩ সালের আগস্টে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন সেই মর্মান্তিক দিনের কথা। বলেছিলেন, এখনকার টুঙ্গিপাড়া থানা মসজিদের কাছে হেলিকপ্টার নেমেছিল। তারা পাঁচ-ছয়জন সেই কফিন বহন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, 'কফিন এত ভারী যে ঘাড়ে করে বয়ে চলা কষ্ট হচ্ছিল। বাঘিয়া নদীর তীরে কফিনটি মাটিতে রেখে আমরা এক দণ্ড দাঁড়িয়েছিলাম। হয়তো বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিমাখা বাঘিয়ার তীরে এক দণ্ড থামতে।' (প্রথম আলো, আগস্ট ১৪, ২০১৩)।

এখনও বাঘিয়ার তীরে দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেখলাম, নদীতীরে একটি অর্ধসমাপ্ত ঘাট। অদূরে বালাডাঙ্গি সেতু পেরিয়ে টুঙ্গিপাড়া থেকে পাকা সড়ক চলে গেছে কোটালীপাড়ার দিকে। সবে বর্ষাকাল শেষ হয়েছে বলে নদীটিতে তখনও পানি টলমল ছিল। কিন্তু ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায়, নদীসুলভ স্রোত যেন বড়ই দুর্লভ। উজানে ও ভাটিতে যতদূর চোখ যায়, চাক চাক কচুরিপানা। পানি হাতে নিলে বোঝা যায়, শরতের সোনাঝরা সকালের রোদে অদূর থেকে স্বচ্ছতোয়া মনে হলেও আদতে মজা রঙের বদ্ধ পানি। শুকনো মৌসুমে যখন উৎসে পানির টান পড়বে; তখন এই পানি আরও ঘোলা হবে; আরও জেঁকে বসবে কচুরিপানা ও শ্যাওলা; আরও কমে যাবে টিমটিমে প্রবাহ। আমাদের পাশে দাঁড়ানো কৌতূহলী ভ্যানচালকও বললেন, নদীটি আর আগের মতো নেই। আগে এই পথে নৌকা তো বটেই, বড় বড় লঞ্চ চলত। কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুম ছাড়া নৌকা চালানো ভার।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত নদীটি ওই অঞ্চলের নানা ঐতিহ্যেরও ধারক, আগেই জানতাম। জানতাম যে অন্তত দুইশ' বছর ধরে নদীটিতে আয়োজিত হয়ে আসছে নৌকাবাইচ। টুঙ্গিপাড়া থেকে কোটালীপাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানেই স্থানীয়ভাবে আয়োজিত হয় নৌকাবাইচ। তাতে বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের খেলার নৌকা অংশ নেয়। দুই তীরে ভেঙে পড়ে মানুষের ঢল। সাধারণত অক্টোবরে দূর-দূরান্ত থেকে লাখো মানুষের জমায়েত হয়। দুই পাড়ে মেলা বসে। বাঘিয়া নদী অঞ্চলের সংস্কৃতিতে নৌকাবাইচ এতটা গ্রোথিত যে, এখানকার নারীদেরও নৌকা খেলার আলাদা দল রয়েছে। মনে আছে, ২০১২ সালের নভেম্বরে বরিশালের উজিরপুরে সন্ধ্যা নদীতে আয়োজিত নৌকাবাইচে কোটালীপাড়া থেকে এমনই একটি দল অংশ নিয়েছিল। এ নিয়ে সমকালে আমরা সম্পাদকীয় লিখেছিলাম।

ঢাকায় ফিরে নদীটি সম্পর্কে আরও খোঁজ-খবর নিয়েছি। সংস্কারের অভাবে নদীটি আসলেই ক্রমশ মরে যাচ্ছে। কিন্তু সংরক্ষণে যেন কারও মনোযোগ নেই। সংবাদপত্রের পুরাতন প্রতিবেদনে পড়লাম 'বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের পাশেই আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র এবং 'নৌকা জাদুঘর' নির্মাণ করা হবে।' (প্রথম আলো, আগস্ট ১৮, ২০১০)। সেখানে বলা হয়েছিল_ 'পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাকৃতিক গ্রামীণ পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে পর্যটনকেন্দ্র করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব-পশ্চিম অভিমুখী খালের সঙ্গে প্রকল্প এলাকা উত্তর দিক দিয়ে আরও একটি সংযোগ খাল খননের মাধ্যমে বাঘিয়ার নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। খালের উভয় পাশে পায়ে চলার ব্যবস্থা রাখা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের যে কোনো স্থান থেকে পর্যটকদের টুঙ্গিপাড়ায় যাতায়াতের জন্য বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থা থাকবে। পর্যটন এলাকায় বাগান, জলাশয়, বনায়ন, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, গ্রামীণ জাদুঘর, ইকোপার্ক থাকবে। সমাধিসৌধ এলাকাকে কেন্দ্র করে পৌরসভা এলাকার খাল ও বাঘিয়ার নদী মিলে নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হবে।' কিন্তু এবার গিয়ে নদীটিকে কেন্দ্র করে এমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ল না। অন্য অনেক কিছুতেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে; কিন্তু নদীটি রয়ে গেছে অবহেলিত। অথচ প্রকল্পটির যথাযথ বাস্তবায়ন হলে সত্যিই বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের পাশাপাশি তার শৈশবের নদী বাঘিয়ারও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হতে পারত। বাঁচত নদীটিও। তাতে টুঙ্গিপাড়ার পরিবেশ, প্রতিবেশ, মৎস্যসম্পদ, কৃষিও নিঃসন্দেহে উপকৃত হতো।

ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, বিলম্বে হলেও সরকার কি বাঘিয়া নদী উদ্ধার, সংস্কার ও সংরক্ষণে উদ্যোগী হতে পারে না? বিশ্বের অনেক নেতার জন্মভূমিতেই প্রাকৃতিক নদী বা জলাশয় নেই। সৌন্দর্য ও সি্নগ্ধতার জন্য কৃত্রিম উপায়ে জলাশয় তৈরি করা হয় সেক্ষেত্রে। আর টুঙ্গিপাড়া কেবল বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি নয়, শেষ নিদ্রাস্থলও। কেবল প্রকৃতি নিজেই সেখানে একটি নয়নাভিরাম নদী দেয়নি, ওই নদীতে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরের অমূল্য স্মৃতি। কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে জাতির জনকের স্মৃতিময় সেই নদী সংস্কার ও সংরক্ষণ কোনো কঠিন কাজ হতে পারে না।

সাংবাদিক ও গবেষক

SUMMARY

1172-1.png