বেদনাসিক্ত ১৫ আগস্ট


প্রফেসর মো. শাদাত উল্লা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সুবহ সাদেকের সময় মসজিদগুলোয় ধ্বনিত হচ্ছিল মহান সৃষ্টিকর্তার পবিত্রবাণী : তোমরা ঘুম থেকে জাগ্রত হও, নামাজ আদায় কর। এই সময়েই ধানমণ্ডির লেকের পাড়ে চলছিল একদল নরপিশাচ রক্তখেকো মানুষ বেশধারী হায়েনার হত্যাযজ্ঞ। পবিত্র আজানের ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ঘাতকদের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। গুলির আঘাতে বাড়ির সিঁড়িতে পড়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত মৃতদেহ। আর অন্যত্র ছড়ানো-ছিটানো ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজি জামাল এবং কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরো ২৮ সদস্য। পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ঘাতকরা সেদিন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরই কেবল হত্যা করেনি, বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দুকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। ৪০ বছর আগের সেই শোকাবহ দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত হলে সেনাবাহিনীর একটি দল শাহবাগ বেতার কেন্দ্র দখল করে বরখাস্তকৃত মেজর ডালিম ঘোষণা করেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং কারফিউ জারির কথা। দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী তখন হতবিহŸল। অপরদিকে বঙ্গভবনে তখন খুনি মোশতাক, ডালিমদের বসার মহড়া। চারপাশে খুনি ফারুক-রশিদ গংদের হলাহলি। বেতার-টিভিতে তাদের দম্ভোক্তি। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারে সবাই লাশ হয়ে পড়ে রইলেন। এভাবেই পার হয়েছিল ১৫ আগস্টের শুক্রবারের দিনটি। ১৬ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ার সোনার ছেলে হেলিকপ্টারে করে ফিরে এলেন টুঙ্গিপাড়ায় তবে জীবত নয়, লাশ হয়ে। ততদিনে তিনি তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন বাংলার মানুষের স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলেছেন। মাত্র পনের মিনিটে সামরিক তত্ত্বাবধানে পৈতৃক কবরস্থানে বাবা-মার পাশে কবর খুঁড়ে সমাহিত করা হয় হিমালয়সম সাহসী এই মানুষটিকে, অন্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

১৫ আগস্ট ফিরে ফিরে সেই শোকার্ত স্মৃতি আবেগ আপ্লুত করে। আর সব সময়ই একটা প্রশ্ন মনে জাগে, যে ব্যক্তি নিজের সারাটা জীবন এই জাতির জন্য উৎসর্গ করেছেন, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের জন্ম দিয়েছেন, নিজে জেল জুলুম সহ্য করেও স্বাধিকারের প্রশ্নে অনড় থেকেছেন, সেই মহান ব্যক্তিটিকে কয়েকজন বিপথগামী সেনাসদস্য স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছর যেতে না যেতেই সেদিন হত্যা করল! এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য বোধহয় একটি দেশের জন্য, একটি জাতির জন্য আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশের স্থপতি পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নাম বাংলার ইতিহাসে ও প্রকৃত বাঙালি প্রতিটি মানুষের অন্তরে সোনার অক্ষরে অক্ষয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের হৃদয়-গভীর শ্যামল একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়া থেকে উত্থিত হন তিনি, তারপর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ধারাবাহিকতায় নিজেকে স্থাপন করেন ইতিহাসের পটভূমিতে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের অনন্য মুক্তিদাতা রূপে। স্থির পদবিক্ষেপে তিনি আমাদের প্রাণিত করেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁরই রণমন্ত্র জয় বাংলা কণ্ঠে ও বাহুতে ধারণ করে বিজয় অর্জিত হয় একাত্তরে। তিরিশ লাখ রক্তের বিপুল সাগর দিগন্তে উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য। কোটি কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনির প্লাবনে ভেসে যায় পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। বিশ্ব অবাক হয়ে চেয়ে রয় বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর দিকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নিপীড়িত শৃঙ্খলিত সব মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন মুক্তির প্রশংসিত প্রতীক।

৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ২১ বছরের বৈষম্যের ইতিহাস তুলে ধরে প্রশ্ন করেছিলেন- ‘কী পেলাম আমরা’। ৪০ বছর পর আজও মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কী পেল এই জাতি? তিনটি বছর পার হতে না হতে একদল রাতারাতি আশা করে বসলেন আলাদিনের প্রদীপ, আরেকদল জাতিকে টেনে নিতে চাইলেন উল্টো দিকে পাকিস্তানি আদর্শের গহিন অন্ধকারের পথে। এ সব হত্যাকাণ্ড নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তবে আমরা দেখতে পাই যে, স্মরণীয় বরণীয় এবং গণমানুষের নেতাদের এভাবেই মৃত্যু হয়েছে। আমরা যদি একটু বিশ্লেষণ করি তবে দেখব আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধী, প্যাটিস লুলুম্বা, জন এফ কেনেডি, চে গুয়েভারাসহ আরো কয়েকজনের মতো ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের কোনো দোষ ছিল না। শুধু একটি মাত্র দোষ ছিল, আর তাহলো এরা সবাই নিজের জীবনের চেয়ে জনগণকে বেশি ভালোবাসতেন, জনগণের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ বলে ভাবতেন। এক কথায়, জনগণকে নিয়েই এদের চিন্তা-চেতনা এবং স্বপ্ন গড়ে ওঠে। যারা শোষিতের পক্ষে নয়, তারা কখনো স্বৈরাচারী মনোভাব ছেড়ে নেতৃত্বের এই সেতুবন্ধন মেনে নেয় না। কাজেই তাদের গুলি বারবার টার্গেট হয়েছে এসব নেতৃত্বের প্রতি। আর এভাবেই নেতাদের যারা খুন করে তারা নিক্ষিপ্ত হয় তমাসার ঘোর অন্ধকারে। আর নিহত নেতারা হয়েছেন অবিনশ্বর, চিরস্মরণীয়, চির বরণীয়। তেমনি অবিনশ্বর, চিরস্মরণীয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৫ আগস্ট কেবল শেখ মুজিবের দেহকেই বুলেটবিদ্ধ করা হয়নি, আঘাত করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করাই নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশটাকেই ধ্বংস করে দেয়া। তাই তো ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় একই বছরের ৩ নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর চার জাতীয় নেতাকেও। ’৭১-এর পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ নেয়ার যে প্রক্রিয়া সে সময় অঙ্কুরিত হয়েছিল তারই একটি ভয়ঙ্কর পরিণতি ১৫ আগস্ট। বিশ্বের ইতিহাসে এত নির্মম, এমন বর্বরোচিত রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের নজির নেই। অথচ খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়। যা ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট সংসদে রহিত করা হয়। এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারের কার্যক্রম। বহু কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লে. কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকায় আরো ৬ খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খোন্দকার আবদুর রশীদ, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লে. কর্নেল (অব.) নূর চৌধুরী, মেজর (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) শরফুদ্দিন আহমেদ ডালিম এবং রিসালদার (অব.) মোসলেম উদ্দিনের ফাঁসির রায় এখনো কার্যকর করা যায়নি। তাই এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের তপ্ত হৃদয়ে এখনো বইছে ক্ষোভের বহ্নিশিখা।

’৭৫-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষ আজ জাতীয় শোক দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে। আমি মনে করি, তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে তিনি যে সুখী, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার বাস্তব রূপ দেয়া। এমন একটি দেশ গড়ে তোলা যেখানে স্বাধীনতার মূল চেতনা বাস্তবায়িত হবে এবং ধর্মগোত্রনির্বিশেষে সব মানুষ সমঅধিকার ভোগ করবে। গণতন্ত্র, সামাজিক এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সেই কাজটি করা সম্ভব। আজকের এই দিনে আমরা তাঁকে স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়। আজ শোক হোক আমাদের শক্তির উৎস।

SUMMARY

1171-1.png