শামসুল হুদা
শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি এই মহামানব মহান নেতার সান্নিধ্যে আসি ১৯৪৮ সাল থেকে ছাত্রাবস্থায় মহান ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনটির ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালির নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সাধারণ শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাকে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে আমরা বিক্ষুব্ধ ছাত্রবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ডাকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করি। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিশীল ছাত্রনেতার সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হওয়ার পর ১১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহ, আবুল কাশেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুপ্ত প্রমুখ নেতাদের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘটে আমরা ছাত্রকর্মীবৃন্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হই। ১৯৪৮ সালের সাধারণ ধর্মঘট ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে নেতৃত্বদানকালে শেখ সাহেব পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার। ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে আমরা পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের করি। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আইন পরিষদ ভবন ঘেরাও করতে গিয়ে আমরা পুলিশি নির্যাতন ও প্রতিরোধের মুখে পড়ি।
১৯৫২ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ২য় বর্ষের (সম্মান) ছাত্র। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে সক্রিয় অংশগ্রহণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হাবিবুর রহমান শেলী (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান), ছাত্রনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ (পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী), শামসুল হক, (তৎকালীন এস এম হলের ভিপি, পরবর্তীতে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত), গাজীউল হক, এ আই এম তাহাসহ আরো অনেকের সঙ্গে আমি গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হই এবং দীর্ঘকাল কারাবরণ করি। এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব থেকে জেলে থাকার কারণে ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে উপস্থিত থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে না পারলেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং আমাদের জেল থেকে পরামর্শ ও নির্দেশ প্রদান করতেন। জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সহায়ক ভূমিকা পালন করেন সোহরাওয়ার্দীর মতো পরিবর্তনে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর সমর্থন আদায় করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্টভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন।
ওই বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯ জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন এম এ আউয়াল ও মিজানুর রহমানসহ সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় খণ্ডকালীন কাজ করতাম। যুবলীগের এম এ, ওয়াদুদ তখন ইত্তেফাকের প্রশাসন বিভাগে কর্মরত ছিল এবং আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পত্রিকাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯৫২ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।’ বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
১৯৫৩ সালে মহান একুশের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনে মিছিল ও নেতৃত্বের পুরোভাগে থেকে বিশেষ ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার মনে পড়ে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার দাবি তোলেন এবং অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের তীব্রতাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টিসহ বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলাভাষার উন্নয়নে শেখ সাহেব বিশেষ অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও বাংলাভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি আরো বর্ধিত মাত্রায় জাতির সামনে তুলে ধরতে তিনি সক্ষম হন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল সফল উদ্যোগ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন সরকারি পর্যায়ে বাংলা প্রচলন কমিটি গঠন করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন (সূত্র : রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা, পত্রসংখ্যা ৩০/১২/৭৫-সাধারণ-৭২৯/৯(৪০০) তারিখ : ১২ মার্চ, ১৯৭৫)।
বাঙালি জাতির জীবনে ভাষা আন্দোলন এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায় এবং ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এক বিরল ঘটনা। ভাষা আন্দোলনই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও গোড়াপত্তন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এ দেশের বঞ্চিত জনসাধারণ প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলন ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়ে অদম্য ত্যাগ স্বীকার করে ও অভূতপূর্ব রক্ষক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে পৃথিবীর মানচিত্রে একমাত্র ভাষাভিত্তিক এই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয়। এই বিরল ঘটনা ও মহান অর্জনের মূল নায়ক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার এই সর্বজনস্বীকৃত ও অসামান্য অবদান জাতির তথা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আয়োজিত বিভিন্ন বিক্ষোভ ও কর্মসূচিতে আমার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের কথা মনে পড়তেই মহান নেতার অনন্য অবদানের ঘটনা স্মৃতিতে ভাস্মর হয়ে ওঠে। স্মৃতিতে ভাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাঝে মাঝে ইত্তেফাক কার্যালয়ে আলাপ-আলোচনা, ৯৪/৯৫ নবাবপুর রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে দেখা-সাক্ষাৎ। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী সাহেব, মাওলানা ভাসানী সাহেব এবং আতাউর রহমান খান সাহেব যখন আওয়ামী লীগ অফিসে যেতেন, আমরা এম এ আউয়াল, এম এ ওয়াদুদসহ ছাত্রলীগ কর্মী দল প্রায় দেখা করতাম। তাছাড়া ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণের কথাও স্মৃতিতে উদয় হয়। মনে পড়ে, ‘চলো চলো নান্দাইল চলো’ স্লোগান দিয়ে ময়মনসিংহে গিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বিরুদ্ধে খালেক নেওয়াজ খানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের কথা। খালেক নেওয়াজ খান বিজয়ী হন।
বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর কালো দিন ও জাতীয় শোক দিবস ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ইতিহাসের এই দিনে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য তথা কাণ্ডজ্ঞানহীন ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শোক জাতি আজীবন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গভীরভাবে বহন করবে। এ যাবৎ আংশিক কিছুসংখ্যক নিষ্ঠুর ঘাতকের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, প্রাণদণ্ড হয়েছে। পলাতক বাকি ৬ জন ঘাতকের যৌক্তিক শাস্তি এবং দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার অপেক্ষায় দেশবাসী দিন গুনছে। এই পরম শোকের দিনে শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা বাস্তবায়নের জন্য দেশবাসীকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। জাতীয় শোক দিবসে এই মহান নেতার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।