কেন বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে হবে


শহীদ ইশবাল

মধুমতী তীরের এক অজপাড়া গ্রামের, রক্ত-মাংসশীল আবেগের, উচ্চ-আপসহীন বঙ্গবন্ধু গণআন্দোলনের পরিণতির পর্যায়ে ক্রমশ প্রতিরোধে পরিণত হয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে, তা আরো একধাপ এগিয়ে, গণশক্তির স্তর অতিক্রম করে, সম্মুখে পেরোন। ওই সময়টাতে বাংলাদেশের পক্ষে কিন্তু কেউ রিস্ক নিতে চায়নি, ইয়াহিয়ার আগ্রাসী ভাবমূর্তির মুখোমুখিও হতে চায়নি; কিন্তু মুজিব তখন হয়ে ওঠেন তর্কহীন ও নিঃশঙ্কচিত্ত। সাহসী প্রেরণায় সমস্ত জনগণকে তিনি প্রস্তুত করেছিলেন- তাঁরই নেতৃত্বের দিকে- প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধী শক্তিতে। ওই নির্বাচনে বিজয়ের পরই কার্যত অনিবার্যভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। নির্বিকল্পরূপে হন অবিসংবাদিত। কোটি মানুষের নেতার অকুস্থল তখন তিনি। এর পেছনে কী ছিল? নিশ্চয়ই স্বার্থ ছিল না। লোভ ছিল না। আরো ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিত যেটি তা হলো- বাঙালি মুসলমানের যে আধুনিক হওয়ার স্বপ্ন, আধুনিক হওয়ার ক্রমবিকশিত পথ, ভাষাভিত্তিক যে দর্শনটি গোচরে-অগোচরে অনুভূত হচ্ছিল- প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে তার জাগরিত শক্তি; সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তারই একটা নির্মীয়মাণ কল্পনায় আঁকা বাস্তব সৌধ- এই সমতল পাহাড়-পর্বত ঘেরা সুন্দর ভূখণ্ডকে ঘিরে- প্রবল সত্যের ভেতরে, নিষ্কম্প আবেগের নির্বিচার শর্তে, প্রতিষ্ঠিত হয়- বাঙালির জাতীয়তাবাদী দর্শনে, মাতৃভাষার সমর্থনে, মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠায়- সর্বত্র, গণমানুষকে একত্রিত করার এক ভিশনে পেরুনো- ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’- ওই মতে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সমবণ্টন ব্যবস্থা- সবকিছু তার স্থির লক্ষ্য নির্ধারিত কেন্দ্র হয়ে পড়ে। এসবের ভেতর দিয়েই এক পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এই উপায়টুকু তিনি জনগণের হয়েই বুঝতে পেরেছিলেন। গণতন্ত্রের প্রশ্নে বুঝতে পারেন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বুঝে ওঠেন- সেখানে পৌঁছুনোর জন্য দুরন্ত হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। এরকম কর্মসূচি বা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে মুজিব নিজেকে এগিয়ে নেন- প্রয়োজনমাফিক এবং দূরদর্শিতার ভেতর দিয়ে। ফলে তিনি একটি দল বা পার্টির লোক হলেও তা আর বিশেষ থাকে না। নির্বিশেষরূপে সব দলের, সব মতের, সব মানুষের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। প্রসঙ্গত, এ ক্ষেত্রে কিছু বিবেচনা আমি যোগ করতে চাই, প্রাসঙ্গিকভাবে ওই সময়টার কথা স্মরণে আনি। তখন তো যোগাযোগের সহজতা ছিল না, বাঙালির আধুনিক চিন্তাধারারও তেমন বিকশিত হয়নি, রেডিওই একমাত্র ভরসা। কিন্তু জনতা বাঁশিওয়ালার সুরধ্বনিতে এক হয়ে যায়। জনতাই ছেড়ে দেয় না, ক্রম-বিচ্ছুরিত হয়- জাতি-চেতনায় স্ফুলিঙ্গে; নেতার ছবি বা নেতার আদেশ সবার কাছে তখন এক ও অনিবার্য পদক্ষেপ- বিশেষ করে ওই পাকিস্তানি জান্তার কুণ্ঠিত অহঙ্কারের মুখে। হ্যাঁ, আশ্চর্য হলেও সত্য, অপ্রতিরোধ্যরূপে সবকিছু এক হয়ে গেল। নেতার কণ্ঠে যেন ছড়িয়ে গেল, সর্বত্র পর্যায়ে থেকে তৃণমূলে শেখ মুজিব দৃশ্যমান হলেন। এইরূপ অখণ্ড নেতৃত্ব, জাতীয় ভাবনার অভিমুখ সৃষ্টির প্রণোদনা- মুজিবের ক্যারিজমাটিক ও আপসহীন অবিচলিত প্রত্যয় এক উৎসমুখের নির্ণয় পায়- স্বাধীনতা। বিষয়টি সে সময়ে ভিনদেশি নেতৃত্বকেও আকৃষ্ট করে। আমরা মনে করতে পারি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ, যুগোসøাভিয়ার মার্শাল টিটো প্রমুখের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল। কর্মপদ্ধতির গুণেই শুধু নন, অপার এক ব্যক্তিত্বই তার চরিত্রের ক্রিস্টালরূপ তৈরি করে। ফলে পাকিস্তানি শোষণ বা অন্যায় পীড়ন, বৈষম্যমূলক আচরণ- সহজেই বিশ্বনেতৃত্বের দৃষ্টিতে পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্বকীয় ও সহজাত কর্মপ্রাণনাতেই এসব করতে সক্ষম হন। এ পর্যায়ে তার ন্যায়দণ্ডের দুর্বলতা বিন্দুমাত্র নয়, তেমনি এতটুকু ছিল না কোনো অধর্ম-অহঙ্কার; শুধুই গণমানুষের ঐক্য ছিল তার নিবেদন ও পূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা, কার্যত পরবর্তীতে তাই মুজিবাদর্শ বলে স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

ইত্যাকার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ভেতরেই প্রশ্নটি ওঠে, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় কেন তাকে প্রাণ দিতে হলো? শুধু তাই নয়, পুরো পরিবারকে কেন এমন নিষ্ঠুর মূল্য দিতে হলো! বিষয়টি ব্যক্তি মুজিব বা পরিবার ভাবলে চলবে না। কারণ, একটি দেশ স্বাধীন করা বা তার পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেয়া দুটো এক বিষয় নয়। চিহ্নিত শত্রুদের সমূলে বিনাশ করা যায় কিন্তু বিশ্বাসঘাতক-বেনিয়াদের তো নিষ্ক্রিয় করা কঠিন। মুজিবের মন্ত্রিসভার ক্রমশ বিশ্বাসঘাতকের দল প্রাধান্য বিস্তার করে। যে পাকিস্তানি জান্তা তাঁকে ফেরত দিয়েছিল, তারাই আবার এদেশে তাদের বশংবদ-বেনিফিসিয়ারি তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু মুজিবকে শুধু হত্যা করা নয়, তাদের সত্যধারণা ছিল যে, মৃত মুজিব অনেক বেশি শক্তিশালী হবে- তাই তার রক্ত-অনুসারি বংশধারাকে নির্বংশ করতে হবে, ফলে শিশু রাসেলও তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না। পাকিস্তানি-আমেরিকার বেনিয়া গোষ্ঠীই একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এ দেশীয় অনুচরদের কাজে লাগিয়ে, গুপ্তঘাতক সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, বিপথগামী সেনাবাহিনীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তুলে দেয়। এ কাজটি তারা নিষ্পন্ন করে ধর্মের নামে; ধর্মীয় সহনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে, বুদ্ধিহীন-প্রজ্ঞাহীন পঙ্গু একটি মনুষ্যত্বহীন জাতি সৃষ্টির লক্ষ্যে তারা নীলনকশা প্রণয়ন করে। বস্তুত এ ক্ষেত্রে ইসলামের মতো পবিত্র ধর্মকেই তারা বেশি কাজে লাগায়। পাকিস্তানের ইসলামী রাষ্ট্রদর্শনের বিপরীতে ভারতের হিন্দু বা বন্দেমাতরম স্লোগানকে বৈরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়। খন্দকার মোশতাক গং স্বীয় স্বার্থলোভে, ক্ষণিক আরাম-আয়েশ আর লোভের বশবর্তী হয়ে ‘অতিচালাক’ সেজে- দেশকে অন্ধকারে তলিয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। হিন্দুয়ানির নামে, রুশ-ভারতের দালাল বলে, নাস্তিকতার কথা বলে- মুজিব ও তার পরিবারকে হত্যা করে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের জয়কে নস্যাৎ করে দিয়ে দেশকে পেছনের দিকে, পুরনো অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। ফলে নিমেষে ডুবন্ত অন্ধকারে তলিয়ে যায় গোটা দেশ। দুঃখের বিষয়, এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধারা বিলুপ্ত হয়নি। এখনো তারা রাজনীতি করছে এবং তাদের কর্মতৎপরতা নানাভাবে সম্প্রসারণ ঘটার কাজ হচ্ছে বলে মনে হয়- ওই পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগার ওপরই। মীরজাফররা নতুন প্রজন্মকে হয়তো প্রশ্ন করেন- মুজিব-প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়ে কিংবা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে- কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করলে কী দাঁড়ায়- কারণ এ ব্যর্থতা যদি হয় রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রপ্রধানের- কিংবা অন্য কারো- তাহলে সেই ব্যক্তি প্রচলিত আইনে ফল ভোগ করবেন প্রয়োজনে এর জন্য রাষ্ট্রপ্রধানও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন- তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে তাকে ক্ষমতা থেকেও নামানো যেতে পারে বা নানা রাজনৈতিক দলও ইচ্ছেমতো কর্মসূচি দিতে পারে- কিন্তু তা না করে- সবকিছুর বিপরীতে রাতের আঁধারে, পেছনের দরজা দিয়ে, সপরিবারে নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক হত্যার কুৎসিত ষড়যন্ত্র তারা করে ফেলে। যেখানে শিশু রাসেল হত্যাও অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু কেন? হ্যাঁ, এসব প্রশ্নের মাঝেই বঙ্গবন্ধু হত্যার সত্যটি নিহিত থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাই সর্বদা মনে রাখতে হবে, মুজিব যেন বাক্সবন্দি না হয় বা নিছক কোনো দল বা মতের মধ্যে আটকে না থাকে, হয়ে ওঠে শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আইকন বা প্রতীকে। অন্তত, নতুন প্রজন্ম যাতে তাকে যথাযোগ্য সম্মানটুকু দিতে শেখে। নইলে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর কিছু হবে না, জাতি হিসেবে আমরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলব।

SUMMARY

1168-1.png