মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব


প্রফেসর ড. এম শাহ নওয়াজ আলি

‘এই বাংলার আকাশ, বাতাস, সাগর, গিরি ও নদী, ডাকিতেছে তোমারে বঙ্গবন্ধু ফিরিয়া আসিতে যদি’ আমাদের প্রিয় কবি- সুফিয়া কমালের কবিতার দুটি লাইনের সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরে বলতে চাই- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া তথা ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ডের সর্বত্রই সেই সুর আজো বেজে উঠে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বালি শতাব্দীর মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের মাঝে কোনো দিন ফিরে আসবেন না এ কথা সত্য। তারপরও শোকের মাস আগস্ট এলেই লাখো কোটি বাঙালির হৃদয়ে ব্যথিত চিত্তে উদিত হয় সেই কালো রাতের কথা! মনে পড়ে শিশু রাসেলের কথা! বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথা, শেখ কামাল, জামালসহ শহীদদের কথা!! ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৫ আগস্টে চোখ পড়লেই মনের মধ্যে ভিড় করে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়ির কথা!!

আজ সেই বেদনা বিধুর এবং শোকাবহ ১৫ আগস্ট। দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৪০টি বছর। মহাকালের কাছে ৪০ বছর তুচ্ছ মূর্ত মাত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে যে কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়েছে তা বইবে অনন্তকাল। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের আয়ুষ্কালের মধ্যে ৩৫ বছরে রাজনীতি এবং সংগ্রামী জীবনের যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন তা বাঙালি জাতির হৃদয়ে বহতা নদীর মতোই বইতে থাকবে দীর্ঘকাল। মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ৩৫ বছরে রাজনৈতিক জীবনের ২৩ বছর (১৯৪৮-৭১) কেটেছে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ এবং সামরিক শাসনের নামে নব্য ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে এ দেশের সাত কোটি বাঙালিকে মুক্তি দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে, আন্দোলন এবং সংগ্রামে। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৪ দিন ছিলেন যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শাসনকর্তা। ফরিদপুর জেলা মুসলিম লীগের হোমগার্ড সদস্য থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের মানুষের কাছে প্রিয় মুজিব ভাই, লিডার, বঙ্গবন্ধু এবং শেষে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতির মাধ্যমে ৩৫ বছররের সংগ্রামী জীবনের সমাপ্তি ঘটলেও বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন, মহাকালের পথ ধরে। কারো ভাবনার পথ ধরে সময় চলে না। সময় চলে তার নিজ গতিতেই। অনুরূপভাবে সময়ের বিবর্তনে সৃষ্টি হয় ইতিহাস। আবার ইতিহাস সৃষ্টির প্রয়োজনেই পৃথিবীতে কিছু মানুষের আগমন কিংবা প্রস্থান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই কাতারেরই একজন মহানায়ক। ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রোষানলে পড়ে ৭ দিন কারাভোগের মাধ্যমে তাঁর সংগ্রামী জীবনের শুরু। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনের নেতৃত্বে, পুলিশ বিদ্রোহ, ’৫২-ভাষা আন্দোলন, বিদ্রোহী পুলিশ বাহিনীর ওপর সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ, ’৫৩ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের অন্তর্ভুক্তির আন্দোলন, ’৫৪ সালের নির্বাচন এবং নির্বাচনের রায় বানচাল বিরোধী আন্দোলন, ’৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খাঁন সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার এবং দীর্ঘ ১৪ মাস কারাভোগ। ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে আইয়ুবর সামারিক সরকার দেশের উভয় অঞ্চলে কয়েকজন রাজনীতিবিদকে এবডো এবং প্রাডো আইনের মাধ্যমে ৬ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুকে সেই কালো আইনের মধ্যে ফেলা হলো। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থনদান, ’৬৩ সালের জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, ’৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে আন্দেলন পরিচালনা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি, ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্যোগ গ্রহণ, ’৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির অন্যতম সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৭ সালে রাজনৈতিক কারণে ৬টি মামলার মোকবেলা, ’৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রতিহতকরণ, ’৬৯ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খাঁর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সফল গণঅভ্যুত্থান পরিচালনা, ’৭০ সালে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ, ’৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং ২৫ মার্চ গভীর রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সর্বোপরি তাঁর জীবনে এই ২৩টি বছরের একটি দিনও আন্দোলন-সংগ্রাম ব্যতীত কাটেনি।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডন পরে দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যুদ্ধে বিধ্বস্ত-যোগাযোগ, শিল্প কারখানা, অবকাঠামোসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুরু হয় আরেক সংগ্রামের ইতিহাস। ৩ বছর ৭ মাস ৪ দিন শাসনামলে তাঁর সততা, দেশপ্রেম, নেতৃত্ব, সাহসী পররাষ্ট্রনীতির জন্য যুগ যুগ ধরে দেশে-বিদেশে লাখ কোটি মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। কপর্দকহীন রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য অর্থ সংগ্রহ, শূন্য খাদ্য গুদামসমূহের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা, দেশীয় মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তন, ৮০টি দেশে দূতাবাস স্থাপন, স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের প্রায় প্রতিটি স্কুল, কলেজে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। পরাজয়ের পূর্বে তারা এগুলোকে ধ্বংস করে বা জ্বালিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে ৪৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং ৫০ হাজারের অধিক নতুন শিক্ষক নিয়োগ করেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক বিজ্ঞানম্মত, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় উন্নতি করার লক্ষ্যে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এ ছাড়াও টেক্সটবুক বোর্ড গঠন, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল এবং স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ৩৬৫ থানায় ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে জোরদার করেন। কৃষি নির্ভর দেশ বাংলাদেশ সেই ধারণাকে মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর গ্রাম পর্যায়ে ২২ লাখ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন, তাদের কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করেন। জাতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীকে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদায় পুনর্গঠন এবং কুমিল্লার ময়নামতিতে দেশের প্রথম আধুনিক বিমান বহর গড়ে তোলা হয়। আর্টিলারি বাহিনীর জন্য সাজোয়া গাড়ি, ট্যাংক সংগ্রহ করা হয়। সমুদ্রসীমা পাহারার জন্য নৌবাহিনী গঠন করেন। বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ ও আনসার বাহিনী গড়ে তোলেন। পাকিস্তানে আটক ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে দেশে ফেরত আনা ও তাদের চাকরি প্রদানসহ পুনর্বাসিত করা হয়। একই সঙ্গে পাকিস্তানের কাছে পাওনা ২২ হাজার কোটি টাকা প্রাপ্তির বিষয়ে অঙ্গীকার আদায় করেন। দেশে দুটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে যায় পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি। হার্ডিঞ্জ রেল সেতুসহ ২৯১টি রেল সেতু, ২৭৪টি রোড সেতু যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৪০টি রেল ইঞ্জিন ধ্বংস করে দেয়। ৬৬টি ফেরি, ৫০০০টি ট্রাক ও ২৫০০টি বাস ধ্বংস করে যায়। একটি বিমানও ছিল না। ছিল না একটি সমুদ্রগামী জাহাজ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অতি দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন সমগ্র বিশ্বে কাছে তা ছিল অকল্পনীয়।

মিত্রবাহিনী হিসেবে বিদেশি সৈন্য একবার কোনো দেশে ঢুকে পড়লে সহজে যেতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশ ছিল এর ব্যতিক্রম। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যের বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া এক অনন্য ঘটনা। এটা সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের কারণে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে সংবিধানের ভিত্তিতে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র দেশ যেখানে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে জাতিকে সংবিধান উপহার দিয়েছে এবং সেই সংবিধানের ভিত্তিতে ’৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা বঙ্গবন্ধুর এক বিরাট সাফল্য।

জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্ত প্রতিহত করে ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ এবং ১৯৭৪ সালে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ এবং একই সঙ্গে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার সদস্য পদ লাভ করতে বঙ্গবন্ধুর সরকার সমর্থ হয়। ১৯৭৩ সালে কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের সদস্য পদ লাভ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালি যিনি জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন এবং বাংলাকে জাতিসংঘের স্বীকৃত ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি, ফারাক্কার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৪ হাজার কিউসেক পানির ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের বিরাট সাফল্য। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে একজন সফল রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অমূল্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জুলি ও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তি আজো সব বাঙালির জন্য গর্বের এবং গৌরবের।

ইতিহাস সত্যের পথে অবিরল, অবিচল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুর নাম চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে খুনি মোশতাক, ফারুক, রশিদ, ডালিম ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ৩৪ বছর পরেও খুনিদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্মের মাঝে, সৃষ্টির মাঝে আমাদের হৃদয় মন্দিরে বেঁচে আছেন। দেশে-বিদেশে লাখ কোটি মানুষের অন্তরের মনিকোঠায় বেঁচে থাকবেন মহাকালের পথ বেয়ে অনন্তকাল।

SUMMARY

1166-1.png