বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : একটি পুনর্মূল্যায়ন


মোহীত উল আলম

বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫) বেঁচেছিলেন মাত্র পঞ্চান্ন বছর। একটি দেশের জন্ম দিয়ে দেশটির তিনি হাল ধরে কয়েকটি বছর কাটানর পর ষড়যন্ত্রকারী এক দল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। এ সেনা কর্মকর্তারা অধিকাংশই মেজর পদবির হলেও এদের মদদদাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সতীর্থ কিন্তু যিনি মীর জাফরের ভূমিকায় নামতে কুণ্ঠিতবোধ করেননি, সে খোন্দকার মুশতাক আহমেদ ছিলেন একজন, আর আরেকজন ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, যাঁর সম্পর্কে সাংবাদিক এ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস তাঁর গ্রন্থ বাংলাদেশ : আ লিগাসি অব ব্লুাড-এ ধারণা দিয়েছেন যে সব সময় কালো চশমা পরিহিত জিয়া এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং এতে তাঁর মৌন সম্মতি ছিল। এ ছাড়া, সাংবাদিক লরেন্স লিপস্যুজ যথেষ্ট প্রত্যয়ের সঙ্গে তাঁর গ্রন্থ বাংলাদেশ : এ্যান আনফিনিশড রেভ্যুলেশন-এ প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিল সিআইএ, এবং এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশস্থ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বুস্টারের আপত্তি সত্ত্বেও ঢাকাস্থ সিআইএ-র প্রধান ফিলিপ চেরির মুশতাক গং-এর সঙ্গে যোগসাজশের দালিলিক ফিরিস্তি দেন। বলাবাহুল্য, লিপস্যুজের এ ধারণাও গ্রহণযোগ্য যে বাংলাদেশের উত্থান এবং বঙ্গবন্ধুর এর জনক হওয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিংগার নিজের রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁর ভ্যান্ডেটা বা প্রতিহিংসার শিকার হন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর জীবনটা- তাঁর উত্থান এবং তিরোধান- যদি কাব্যের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনের বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’-এর সঙ্গে মিল চলে। কবি বলছেন, কবিতায় কথিত দেশপ্রেমিক যখন দেশে ফিরছিলেন তখন রাস্তা ছিল গোলাপ দিয়ে বিছান, কিন্তু মাত্র এক বছর পর সেই দেশপ্রেমিক নেতাকেই ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে অগ্রসরমান হতে দেখা যায়। ‘দাস আই এন্টারড, এ্যান্ড দাস আই গৌ’- ঐভাবে এসেছিলাম এবং এভাবে যাচ্ছি, নিজের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের কথা বলে দেশপ্রেমিক তখন বলছেন, জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেও ঈশ্বর তাঁকে তাঁর কাজের জন্য পুরস্কৃত করবেন, কাজেই তিনি নিরাপদ। ব্রাউন কবি হিসেবে ছিলেন বক্রোক্তির রাজা। দেশপ্রেমিক বলছেন, আমার গত এক বছরের ‘মিসডিডস’ (খারাপ কাজ)-এর জন্য আমাকে জনগণ পাথর মেরে কপাল ফাটিয়েছে, সে জন্য আমার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। এখানে ‘ভালো কাজের’ কথা বোঝাতে বক্রোক্তি অর্থে মিসডিডস ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক কবিতায় কথিত দেশপ্রেমিককে যেমন জনগণ ভুল বুঝেছিল বলে তাঁকে ফাঁসিতে যেতে হয়, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বিরাট ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

ইতিহাসের একটা সুবিধা হলো কালের দূরত্ব থেকে যখন একটা ঘটনা অবলোকন করা হয় তখন তার তাৎক্ষণিকতা সরে যেয়ে সেখানে যে পলি পড়ে তা কালের যষ্টিপাথরে বিচার করলে ঘটনার সত্যাসত্য বের হয়ে পড়ে। এ কথা এ জন্য বলছি যে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পর প্রকাশিত বহু রচনা ও সমীক্ষার একটি প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল যে বঙ্গবন্ধুর আগমন এবং নির্গমন পরস্পর ছিল বৈপরীত্যপূর্ণ। ‘প্যাট্রিয়ট’ কবিতার দেশপ্রেমিক নায়ক যেমন আগমনের সময় গোলাপ আচ্ছাদিত পথ দিয়ে হেঁটে এসেছিলেন, যেরকমটি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এবং কবিতার নায়কের ফাঁসির দিনে যেমন ছিল রাজপথে বৈরী জনতা, তেমনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সময় এবং পরবর্তী দিনগুলোতে যে সামান্য বিক্ষোভ মিছিলও তাঁর সমর্থনে ঢাকার রাজপথে বা দেশের অন্য কোথাও হয়নি এবং এই মৌনতাকে সমর্থন মনে করে ষড়যন্ত্রের নায়ক মীরজাফর, খোন্দকার মুশতাক আহমেদ, নিজের চার সতীর্থ এবং বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সেনানী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় শুধু খুন করলেন না, তাঁরই উত্তরসূরি, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের পরোক্ষ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যা থেকে দ্বিতীয় প্রধান উপকৃত ব্যক্তি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক দলিলে অনুমতির স্বাক্ষর দেন, যেটি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা বিচাররহিতকরণ বিল নামে পরিচিত, যে আইনের বলে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ খুনি মেজর সৈয়দ ফারুখ রহমান, মেজর শাহরিয়ার, মেজর নূর, মেজর ডালিমসহ সবাই আইনি শাস্তির বাইরে থাকার অনুমতি পায়।

ইতিহাসের যে কথাটা বলছিলাম, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর একুশ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির গভীর ঘোরের মধ্যে পতিত হয়েছিল, যে ইতিহাস বিৃকৃতির- জঙ্গলের ভাষায়- পরিচিতি হতে পারে শেয়ালকে বাঘ রূপে প্রমাণ করার প্রচেষ্টায়। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্থলে এই ইতিহাস বিকৃতির কুশীলবরা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। এই বিকৃতিকে দাঁড় করাতে যেয়ে ইতিহাসের চোখে ধুলা দেয়ার জন্য তাঁরা যে অপকৗশলটি নিলেন সেটি হলো ঘটনাকে প্রেক্ষাপট ছাড়া নিবেদন করা। মানব সমাজে জারজ সন্তান দেখার প্রচলন আছে কিন্তু ইতিহাসের গর্ভে জারজ ঘটনা বলে কোন কিছুর জন্ম হয় না। প্রতিটি ঘটনার পূর্বাপর থাকে। আকাশ থেকে বা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো ঘটনার উৎপত্তি হয় না। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর একটি জনসভার ভাষণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাস বিকৃতির চরম প্রকাশে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, কে এই জিয়াউর রহমান? প্রশ্নটি তৎকালীন ইতিহাস বিকৃতির ডামাডোলের মধ্যে হারিয়ে গেলেও, এটির ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল এই যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ যখন স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহী এবং ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিশ্চিত করে এনেছিল, সেই পর্যায়ে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পাকিস্তানের অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার প্রাক্কালে জিয়াউর রহমান ছিলেন মেজর হিসেবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে দায়িত্বরত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তৎকালে চট্টগ্রামে অবস্থানরত আরো কিছু বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের মতো (যেমন ইপিআর-এর মেজর রফিক) সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে যান এবং বের হয়ে এসে চট্টগ্রাম শহরের অদূরে কালুরঘাটে অবস্থান গ্রহণ করেন। এদিকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এম, এ, হান্নানের নেতৃত্বে, এবং চট্টগ্রাম রেডিওতে কর্মরত বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম স›দ্বীপের সহযোগিতায়, রেডিও স্টেশনটি আগ্রাবাদ থেকে চাঁদগাঁও ট্রান্সমিশন কেন্দ্রে স্থানান্তর করেন এবং ২৬ মার্চ দুপুরে হান্নান বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন কিন্তু যা নতুন স্থাপিত বেতার তরঙ্গমালার সংযোগ-দুর্বলতার কারণে ব্যাপক জনশ্রæতি পায় নি। সে সময় এম আর সিদ্দিকী এবং হান্নান লোকমুখে খবর পান যে কাছেই একজন বাঙালি মেজর অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা তখন তাঁর কাছে যান এবং তাঁকে অনুরাধ করেন যে বেতারকেন্দ্রে এসে স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিতে। তিনি, অর্থাৎ মেজর জিয়া, ঘোষণাটি দিলেন, সেদিন ২৭ মার্চ বিকেল, দিলেন কিন্তু প্রথমে নিজের নামে, যেটি থেকে ইতিহাসের জারজ ঘটনা জন্ম দেবার সূচনা হয়, তারপর সংশোধিত হয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে।

কে এই জিয়াউর রহমান (?) প্রশ্নটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাখলে এই কথা প্রমাণিত হয় যে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘটনাকে জারজ ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রেক্ষাপটবিহীন করে তোলা। জিয়া নিজেও এই দাবির অযৌক্তিকতার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন মনে হয়, কারণ তিনি কোনো লেখা বা কথায় নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেন নি। দাবি না করলেও জিয়ার ভূমিকা ছিল প্রতিবিপ্লবীর এবং মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বাধীনতা-বিরোধীর, কেন না তাঁর রাজত্বের সময় তিনি পরাজিত মৌলবাদী ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানপন্থীদের কাছে ডুবে যাওয়া অবস্থা থেকে ভেসে থাকার জন্য খড়কুটোর মতো অবলম্বনের মতো হয়ে যান। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে তিনি তখন প্রতিবিপ্লবের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। যে জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনার কথামতো, ছিলেন নামগোত্রহীন, সে জিয়াউর রহমানকে খুঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়ে বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তিগুলো পুনরায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যে মূল্যবোধগুলো দর্শন হিসেবে কাজ করেছিল- অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সাম্যতা এবং বাঙালি জাতিয়তাবোধ- সে সবের একে একে কবর রচিত হতে থাকে। এমন উল্টো ঘুরল ইতিহাসের রথ যে শাহ আজিজুর রহমানের মতো শীর্ষস্থানীয় রাজাকারকে জিয়া শুধু যে প্রধানমন্ত্রী করলেন তা নয়, তাঁরই স্ত্রী বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যখন কালক্রমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন কয়েক দফা, তিনি তাঁর স্বামীর বাংলাদেশকে রাজাকারকরণের ধারবাহিকতায় ’৭১-এর বাঙালি ঘাতকদের অন্যতম হোতা জামায়াতে ইসলামের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে দিলেন মন্ত্রিত্ব এবং চট্টগ্রামের কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বাবু নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যাকারী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে করলেন নিজ দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, যিনি পূর্বেই সামরিক শাসক এরশাদের আমলে মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। অর্থাৎ, যাঁরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ক্ষান্ত ছিলেন না, অংশগ্রহণ করেছিলেন বাঙালি জাতিকে নিধনকল্পে গণহত্যায় তাঁদের কপালে জুটল মন্ত্রিত্ব, পেলেন মন্ত্রী হিসেবে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়াবার অধিকার। (এই কলাম যখন লিখতে শুরু করেছি, ২৯ জুলাই ২০১৫, দেখছি আজই সকালে আপিল কোর্ট যুদ্ধাপরাধের দায়ে অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর যুদ্ধাপরাধী বিচার আদালত-১-এর দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছে, ঠিক যেরকম একই অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীর ওপর যুদ্ধাপরাধী বিচার আদালত-১-এর দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ও আপিল বিভাগে অপেক্ষাধীন আছে চূড়ান্ত রায়ের জন্য। এই ঘটনা দুটো থেকেও মানবজীবনের ভাগ্যের হেরফের অনুধাবন করা যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ ফারুক রহমান যেমন সদম্ভে ঘোষণা করতেন এই বাংলাদেশে তাঁর কোনোদিন বিচার হবে না, ঠিক দাম্ভিকতার শিরোমণি সাকা চৌধুরীও পরম তাচ্ছিল্যভরে টিটকারি সহকারে বলে বেড়াতেন সাহস থাকলে তাঁকে বিচার করুক বাংলার মাটিতে। এখন রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে জাতি উন্মুখ।)

সে যা হোক, ঘাতক-রাজাকারদের মন্ত্রী হিসেবে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর ঘটনায় ফিরে আসি। জিয়াউর রহমানের ‘জারজ ঘোষণা’কে অবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলো যখন মধ্য সত্তর থেকে মধ্য নব্বই পর্যন্ত ফুলে-ফেঁপে উঠছিল, যে কারণে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, তখন তারা আসলে ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছিল এ জন্য যে তারা ইতিহাসকে পুনর্ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল। ঐতিহাসিক ঘটনার তাৎক্ষণিক সত্যাসত্যের একটি বিষয় আছে কিন্তু ইতিহাস মূলত কোনো একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিষয় এবং এটি বুঝতে পারলে আমরা এ কারণটি ধরতে পারব যে জিয়াকে আশ্রয় করে পাকিস্তানি ধর্মীয়বাদ তারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল এবং খানিকটা সফলও হয়েছিল। অর্থাৎ ইতিহাসকে তারা নতুন করে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল। ইতিহাস বিকৃতির পদ্ধতির মধ্যে একটি মিথ্যার আশ্রয় থাকে, সে জন্য বেশিদিন সেটা চালান যায় না কিন্তু সেই তুলনায় ইতিহাসের নবতর ব্যাখ্যা অনেকখানি টেকসই হয় এবং সেটিই জিয়া-আশ্রিত নব্যপাকিস্তানি গোষ্ঠী এখনো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় রত। এই ব্যাখ্যাটা হচ্ছে যে বাংলাদেশ যেহেতু মুসলমান জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত, সে জন্য বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলোর কায়দায় চলতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরব কিংবা পাকিস্তান হয়ে চলতে হবে।

ঠিক এই জাংচারে অর্থাৎ ঘটনার আবর্তের মধ্যে যখন জিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছিল, যে অবস্থানকে ব্যঙ্গ করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন বাংলাদেশ ছোট পাকিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছিল, তখন, ফিরে দেখলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভূমিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে জানা যায় তাঁরা সবাই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর একান্ত লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়া। জিন্নাহ প্ররোচিত দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান যে আসলে একাট সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, এটি তৎকালীন পূর্ব-বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব তেমন আমলে নেননি, কারণ যেনতেন প্রকারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্নে তাঁরা ছিলেন বিভোর। এমনকি বাঙালি হয়েও পূর্ব-বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অবাঙালিদের মুসলমানি জজবার কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিলেন। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধুর চোখ খুলে যায় যে পূর্ব বাংলার মানুষ আসলে রাজনৈতিক ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পেয়ে ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতায় পদার্পণ করেছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাস হয়ে পড়ে ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানী প্রমুখ মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে ‘পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামক নতুন দল গঠন করলেন এবং বঙ্গবন্ধু এর প্রথম যুগ্ম সম্পাদক হন এবং ১৯৫৩ সালে এর সাধারণ সম্পাদক হন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কর্তন করা হয় এবং এর ফলে দলটির অসাম্প্রদায়িক চারিত্র নির্দিষ্ট হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে জোড়া লাগিয়ে যখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটি প্রদেশের সৃষ্টি করা হয় তখন বঙ্গবন্ধু অতিশয় খেদ নিয়ে বলেছিলেন যে ‘বেঙ্গল’ শব্দটাতো ‘বে অব বেঙ্গল’ ছাড়া আর কোথাও রইল না।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এভাবে যদি ইতিহাসের ওপর দিয়ে একটি রেখা টানা হয় তা হলে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতা থেকে বঙ্গবন্ধুর কাণ্ডারি পরিচালনায় মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে বলা যায়। সঙ্গে সঙ্গে যে সব ভ্রমাত্মক চিন্তা পথিমধ্যে ত্যাজ্য হয়ে পড়ে সেগুলি হচ্ছে কতগুলো নিশ্চিন্ত ভাষিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। ধর্মের মোড়কে একটি জাতির ভাষাকে হেয় করা যায় না। যে জাতির যে ভাষা সে ভাষায় ধর্ম পালিত হবে, অন্য ভাষায় নয়। আমাদের দেশে যে ধর্মের নামে আস্ফালন ও কুসংস্কার-নির্ভর ধর্ম পালিত হচ্ছে তার প্রধান কারণ ধর্ম আমাদের দেশে মাতৃভাষায় চর্চিত হয় না। ধর্ম পরিব্রজনশীল হলেও সেটি কখনো কোনো অঞ্চলের ভাষাকে মৌলিকভাবে এবং জলবায়ু বা ভূগোলকে একেবারেই প্রভাবিত করতে পারে না। ঠিক সেরকম ধর্ম কখনো একটি জাতির স্বকীয় কৃষ্টি, খাবার, পরিচ্ছেদকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্থিত পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্ম যথাক্রমে ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের বহু পরিব্রজনশীলতা লক্ষ করেও এ কথা বলা যায় যে শেষ পর্যন্ত এক একটি এলাকার ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হতে সচেষ্ট থাকে। জিয়ার প্রতিবিপ্লবী-আশ্রিত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির অতীত দেখলে বোঝা যায় এধারার কুশীলবরা পাকিস্তানকে ইসলামের সঙ্গে তুলমূল্য করে দেখার চেষ্টা করেছিল, বলেছিল পাকিস্তান ভাঙলে ইসলাম ধর্ম ভাঙবে, কিন্তু সেটা হয়নি, তাই এখন তারা ভাব তুলেছে যে সৌদি আরবের সঙ্গে বা আরবি ভাষার সঙ্গে ইসলামকে তুল্যমূল্য করা, অর্থাৎ সৌদি আরব যেন ইসলাম ধর্ম কিংবা আরবি ভাষা যেন ইসলাম ধর্ম। প্রকৃত বাস্তবতায় দুটোর কোনোটিই সত্য নয়। সৌদি আরব ঠিক সেরকম একটি রাষ্ট্র, বাংলাদেশ যেমন একটি রাষ্ট্র এবং সৌদি আরব ইসলামি দেশ, যেমন বাংলাদেশও অষ্টম সংশোধনী মতে একটি ইসলামি দেশ। আবার আরবি ভাষা ঠিক সেরকম একটি ভাষা, বাংলা যেমন একটি ভাষা। পবিত্র কুরআন শরিফ আরবি ভাষায় নাজেল হয়, সে জন্য ওই গ্রন্থভুক্ত আরবি ভাষাটি পবিত্র কিন্তু এই গ্রন্থের বাইরে আরবি ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার আছে, যেমন বাংলার আছে। বাজারে গেলে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে যেমন আমরা মাছ কিনি, তেমনি আরব দেশের লোকেরা বাজারে গেলে আরবি ভাষা ব্যবহার করে খেজুর কেনে। কোনো ভাষাকে পবিত্র বা অপবিত্র এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না কিন্তু সব জীবন্ত ভাষারই সর্বজন স্বীকৃত আটপৌরে ব্যবহার আছে।

ওপরের কথাগুলোকে গুছিয়ে বললে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শকে উপলব্ধি করা যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির মাধ্যমে ধর্মের নামে কতগুলো অযৌক্তিক বাহাস তুলে বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতিয়তাবোধের ওপর যে আঘাত হানার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিয়তাবাদের ভিত্তিতে তারই বিরুদ্ধে শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতা তৈরি করলেন। ধর্মের নামে শোষণ করার প্রক্রিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন নয় কিন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হলে এর বিশেষ ভৌগোলিক কাঠামোর জন্য- ভারতের দুই প্রান্তে এক হাজার মাইল তফাতে দুটি প্রদেশ- এই শোষণ প্রক্রিয়া একটি বিজাতীয় রূপ নেয়, ধর্মীয় ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ঔপনিবেশিকতাও মিশ্রিত হয়। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদেশ না হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশের মতো রূপ পরিগ্রহ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ’৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করলে তা সহসাই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে পরিগণিত হয়। অন্যদিকে তা বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের সূচনা করে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রান্তর প্রক্রিয়ার সব পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা বাতিঘরের মতো কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে যে পোস্টারটি মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়-উজ্জীবন শক্তি হিসেবে কাজ করে সেটি ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শীর্ষক প্রচারপত্রটি।

‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ প্রচারপত্রটি একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিচায়ক এবং এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করলে বুঝতে পারব কেন বাংলাদেশে খোন্দকার মুশতাক-জিয়াউর রহমান প্রণীত নতুন-পাকিস্তান তৈরি করার তাত্তি¡ক দিকটি শেষ পর্যন্ত টিকে উঠতে পারেনি।

আমরা যতই ধর্ম নিয়ে বা এটা ওটা নিয়ে কথা বলি, রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে অর্থনীতি। বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ বাস্তব কর্মসূচিটি সে জন্য পাকিস্তানি ধর্মীয় জজবাকে পরাজিত করতে পেরেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এর অর্থ এ নয় যে শুধু বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি ও বাঙালির ইতিহাস স্বাধীন হয়েছে, এর অর্থ এই যে বাংলাদেশের নাগরিকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কয়েক দশক পার হওয়ার পর্যায়ে পাকিস্তানি-ধর্মীয়তত্ত্ব মারাত্মক সন্ত্রাসী-মৌলবাদী চরিত্র গ্রহণ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী কিছু দুরন্ত কেন্দ্র থেকে ইসলামের একটি ভয়াবহ মৌলবাদী চরিত্র প্রকাশ করে খোদ ইসলাম ধর্মকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং এরই আংশিক কিন্তু উগ্র প্রকাশ বাংলাদেশে সমকালীন সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের শেষ অর্ধে এবং ২০১৫ সালের প্রথম চতুর্থাংশে ইসলামি উগ্রবাদী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সহযোগিতার মাধ্যমে প্রচুর জনসংহারের কর্মসূচি নেয়া হয়, যে কর্মসূচির প্রধান কর্ম ছিল পেট্রলবোমা মেরে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা আর গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে আবার সন্ত্রাসবাদী সাম্প্রদায়িক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অসাম্প্রদায়িক কিন্তু ধর্মভীরু জনগণ ঠিকই এই প্রাণসংহারী কর্মসূচিগুলোকে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল ও চলমান রাখতে সমর্থ হয়। বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’র ট্র্যাকে বাংলাদেশকে ওঠানর স্বপ্ন দেখেছিলেন আর তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর এবং বাংলাদেশের জনগণ তাঁকে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তাই অমর।

SUMMARY

1163-1.png