জাতীয় ঐক্যের দুই ভিত্তি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ


বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ আছে, দেশে ও বিদেশে। অনেকে বিষয়টাকে অতি-সরলীকরণ করেও ভাবেন, কেউ আবার মনে করেন- এ সংকট শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ সংকটের শেষ না টানা পর্যন্ত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিপন্ন হতে থাকবে, দেশ তার প্রার্থিত শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হবে। এবং সে সুযোগ লাভ করবে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী, যারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি।

কাজেই বিবদমান পক্ষগুলোকে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে এই সংকটের সমাধান টানতে হবে। রাজনৈতিক দলগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এ উপলব্ধি যত দ্রুত ঘটে ততই মঙ্গল। সাধারণ মানুষ এ সংকটের সমাধান চায়।

দ্বিমত করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট আরোপিত, বেশির ভাগই পরিকল্পিত; রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার মধ্য দিয়ে, লাখো শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে। এই দুই অঘটন বাংলাদেশের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধক। পঁচাত্তরের কুশীলবরা চেয়েছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রটির সব অর্জন ধূলিস্মাৎ করতে। তারা চেয়েছিল মুসলমান প্রধান একটি জনপদে বঙ্গবন্ধু সব অর্থে যে আধুনিক এবং জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির পত্তন করার সাফল্য দেখিয়েছিলেন, তাকে আঁতুর ঘরেই গলা টিপে মারতে।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৪ বছর চলছে। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের ৪০তম শোকের মাস চলছে এই আগস্ট মাসে। চার যুগ পার হয়েছে এরই মধ্যে। নতুন নাগরিকরা, নতুন মানুষরা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও খেলাধুলায় তারা অবাক করা সাফল্য দেখাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে তাদের লক্ষ করতে হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গ্রাস করছে সংকট, স্বাধীনতা বিরোধী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা মুক্তচিন্তা গ্রাস করতে উদ্যত।

কাজেই মূলে ফিরে যে হবে। মৌলিক সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। একটি-দুটো নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক বাগাড়ম্বরে এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয়। বুঝতে হবে আমরা উত্তরোত্তর বিভাজিত হয়েছি, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিমূল থেকে ক্রমশই দূরে সরে গেছি। অথচ সবাই জানি- মৌলিক জাতীয় ভিত্তিমূলে ফিরে যেতে না পারলে মৌলিক জাতীয় সংকট দূর হওয়ার নয়।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র শাসন করেছে অবৈধ সেনাপতি শাসকরা কিংবা তাদের হাতে গড়া হঠাৎ গজানো রাজনীতিবিদরা। এ সময়ে বাংলাদেশে এক নতুন পূর্ব পাকিস্তান তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে। এসব শাসকদের হাতে রাষ্ট্রের স্থপতি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও আদর্শ। ফলে গজিয়ে উঠেছে নানা পরগাছা, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি খুঁটি গেড়ে বসেছে, ধনেজনে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসবই করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, যাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় লাখো মানুষের আত্মদানের মুক্তিযুদ্ধ, যে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল।

নানা পালাবদলের পর ১৯৯০ থেকে রাষ্ট্রের আশাজাগানিয়া গণতান্ত্রিক নবযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সে যাত্রা মসৃণ হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার। এর প্রধান কারণ এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার প্রশ্নে ইতিহাস ও ন্যায়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের আবির্ভূত করেছিল কিছু রাজনৈতিক দল। এরা, বিগত সামরিক শাসকদের ধারাবাহিকতায়, ক্রমান্বয়ে অস্বীকার করে গেছে বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে; আঘাত হেনেছে সেক্যুলার সমাজশক্তির প্রতিটি স্তম্ভে।

কিন্তু বিগত বছরগুলোর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সাক্ষ্য দেয়, এই মনোভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র লাভবান হয়নি বরং সমাজ কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে, জাতি উত্তরোত্তর বিভাজিত হয়েছে, একের পর এক সংকট গ্রাস করেছে। দুর্ভাগ্যজনক এই প্রক্রিয়ায় দেশের স্বাধীনতার চিহ্নিত প্রতিপক্ষরা শক্তি সঞ্চয় করেছে।

সবার আরো জানা যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠেকানো সম্ভব হয়নি, বিচার ঠেকানো যায়নি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের। দেরিতে হলেও ইতিহাসের অমোঘ সত্যগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নিরন্তর বিষবাষ্প ছড়ালেও নতুন প্রজন্মের বৃহৎ অংশ মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের প্রতি আজ আস্থাশীল। নবপ্রজন্মের মানুষ বিকৃত জাতীয় ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায় ও সত্যের পক্ষ নিয়েছে, যা একটি বড় ইতিবাচক অগ্রগতি। অন্যদিকে নানা আঘাতে দীর্ঘকাল পর্যুদস্ত থাকলেও, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি আগের যে কোনো সময়ের চাইতে শক্তিশালী। তাদের শক্তিকে অদূর ভবিষ্যতে খর্ব করা যাবে ভাবা ঠিক হবে না। যদি কেউ ভাবে তা হবে তাদের ব্যর্থ উপলব্ধি।

রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, সে কারণেই, একটা গুণগত পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুরনো ব্যর্থতা ও কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়। আমার বিশ্বাস, পরিবর্তনের এ ধারাটির সূচনা করে বিএনপি দেশের রাজনীতিতে সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে, জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধাটি দূর করতে পারে। এ পরিবর্তনের মূল শর্ত- অতীতের কলঙ্ক ঝেরে ফেলে নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রের জনক হিসেবে তাঁর ঐতিহাসিক মহিমায় গ্রহণ করা, তাঁর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জ্ঞাপন করা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী তস্করদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আকণ্ঠ সমর্থন দান করা।

রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করা অপরাধ কিছু নয়, যদিও ঐতিহাসিক সত্য এই যে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং চার যুগ পর, আজো, নানা সীমাবদ্ধতার পরও, অসাম্প্রদায়িক সমাজশক্তির নেতৃত্ব দান করছে। কাজেই অপরাধ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতার নামে জাতির জনককে অবজ্ঞা করা, তাঁরই মুখ্য নেতৃত্বে সংগঠিত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উপেক্ষা করা, বিতর্কিত করা এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে আঁতাত করে জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও রক্তস্নাত ইতিহাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।

আমি জানিনে, বিএনপি তাদের দীর্ঘকালের কলঙ্কময় অবস্থান পাল্টাবে কিনা, রাষ্ট্রবিরোধী জামায়াতসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চেতনাবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গ ছাড়বে কিনা। যদি তা করে তা হবে রাষ্ট্রের বড় লাভ। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় সমঝোতার প্রধান শর্ত হচ্ছে- নিঃশর্ত এবং পরিপূর্ণ আবেগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রহণ করা, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা। বিএনপির মতো একটি বড় দল যতদিন না এ কাজটি করতে পারবে ততদিন সংকট জিয়িয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪০তম মৃত্যুবর্ষিকী পালন চলছে। কেবল আওয়ামী লীগ নয় সমাজের অন্যান্য মতপথ থেকেও ‘জাতীয় শোক দিবস’ এর অনুষ্ঠানমালা পালিত হচ্ছে। কিন্তু এবারেও বিএনপি জাতীয় রাজনীতির সঠিক উপলব্ধিতে আসতে পারেনি বলেই মনে হয়। পারলে দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সংকটের একটি বড় বাধা দূর করা সম্ভব হতো। সবাইকে পূর্ণ উপলব্ধিতেই বুঝতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দলের নেতা নন, ইতিহাস পরিক্রমায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা, জাতির জনক। কাজেই জনককে উপেক্ষা করে জাতীয় এক্য গঠন বা সামনে এগুনো বাস্তবসম্মত নয়। যদি কেউ তা করার চেষ্টা করেন, করেছেনও, তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তা অবশ্যই প্রতিরোধ যোগ্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মানার প্রধানতম শর্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমহিমায় মান্য করা, মুক্তিযুদ্ধকে তার অবিকৃত ইতিহাসে মান্য করা- কোনো সন্দেহ নেই আমার এ উচ্চারণে। এ রাষ্ট্রে এর ব্যতিক্রম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না কখনই। বঙ্গবন্ধুর যারা অনুসারী, তাদেরও উচিত হবে জাতির জনককে গণ্ডিবদ্ধ না করা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে সার্বজনীন করা।

SUMMARY

1162-1.png