মারুফ রায়হান
কবিতাপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম রয়েছে। এর নেপথ্যের সত্যটি এই- বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। তার আবেগমথিত উচ্চারণ অনেক সময়ই কবিতাধর্মী হয়ে ওঠে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তর পর্বে ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নয়নের মণি। তিনি নিজেও কি কবি নন? রাজনীতির কবি তিনি। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ কবিতারই মতো স্পষ্ট ও সংকেতময়, দ্রোহ ও দেশপ্র্রেমের রসে সিক্ত। তাঁকে নিয়ে কবিতা রচিত হতে থাকে সাতই মার্চের বহু আগে থেকেই। এমনকি জানা যায় ‘বাংলা ছাড়ো’খ্যাত কবি সিকান্দর আবু জাফর ওই সাতই মার্চের দিনই একটি জাতীয় দৈনিকে মুজিবকে নিয়ে রচিত কবিতা প্রকাশ করেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুর প্রতি সমর্থন প্রকাশের জন্য। তবে সত্য প্রকাশের দায়বোধ থেকে আমাদের বলতেই হবে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে সপরিবারে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পরই তাঁর প্রতি নিবেদিত কবিতা সহস্র্র ফল্গুধারায় লিখিত হতে থাকে; এ যেন জাতির সকরুণ অশ্রুরই বাঁধভাঙা জোয়ার। স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবকে বহু মাত্রায় মহিমান্বিত করার পরিবর্তে তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য শোক প্রকাশই মুখ্য হয়ে ওঠে। বাঙালির ঘরে স্বাধীনতার ফসল এন দেয়ার আগে যুগ যুগ ধরে তাঁর লড়াই ও আত্মত্যাগের বিষয়টি ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে শোকাভিভূত বিলাপ। বস্তুত মুজিবহত্যার বিচারের বিষয়টি স্থগিত থাকার বাস্তবতায় শোক ও ক্রোধই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। বহু বিলম্বে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলে এবং পরবর্তীকালে বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার ভেতর দিয়ে সেই পুঞ্জীভূত শোক ও ক্রোধ কিছুটা সান্ত¡না লাভ করে। সেইসঙ্গে শব্দে ও ছন্দে নেতার চরিত্রচিত্রণের ধরন ও চারিত্র্যেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে।
একটু আগেই বলেছি বাঙালির আবেগমথিত উচ্চারণ অনেক সময়ই কবিতাধর্মী হয়ে ওঠে। কিন্তু সার্থক কবিতা রচনার জন্যে আবেগকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হয়, শিল্পরসের যোগান দিতে হয়। শিল্পের যুক্তি গ্রহণে অপারগ থাকে ভাবাবেগ। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে কবিতার মতো পঙক্তি রচনার জন্যে ছন্দের সুষমা, ভাষার বৈভব কী দরকার? এমনটা বহুজনই মনে করেছেন। অন্তত তাঁদের কবিতা পাঠ করেই এমনটা ধারণা হয়েছে। নব্বই দশকের প্রথমার্ধে ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনার সূত্রে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাই। দেখেছি শত শত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী প্রিয় নেতার উদ্দেশে কবিতা লিখে নিজেই চলে এসেছেন পত্রিকা অফিসে ছাপানোর দাবি নিয়ে। মানহীন ও দুর্বল রচনা কিভাবে উত্তম নৈবেদ্য হতে পারে নেতার করকমলে! আপনি যদি সত্যিকারের শিল্পী না হন, সুরের ওপর যদি আপনার দখলই না থাকে, আর কণ্ঠস্বরটি যদি শ্রুতিসুখকর না হয় তাহলে আপনার গান কি শ্রবণযোগ্যতা পাবে? আমাদের সৌভাগ্য যে সেইসব পদ বা পদ্য রচয়িতাকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে ভালবাসা ও শ্রদ্ধাতর্পণের জন্যে কিছু রচনার প্রয়াসী হওয়া প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু সেসবের প্রকাশযোগ্যতার জন্যে জরুরী শিল্পবিচার। তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে নিজেকে উপযুক্ত করে নেয়াটাই আবশ্যক।
কথাগুলো এজন্যেই বলা যে, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত গ্রন্থবদ্ধ সহস্র্র কবিতার ভেতর খুব সামান্যই প্রকৃত অর্থে বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতার প্রতিকৃতি অঙ্কনে শিল্পসফল হয়েছে। তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে যত পঙক্তি রচিত হয়েছে তার নেপথ্যে যে পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার আবেগ কাজ করেছে তা সত্যিই মূল্যবান। মানুষের হৃদয়ের ধ্বনির ওপরে তো আর কিছু হতে পারে না। আর ভালবাসা আপনা আপনি সৃষ্টি হয় না। আমাদের প্রায় সকল প্রধান কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। এসব রচনা বাংলাদেশের সময় ও ইতিহাসেরই শিল্পিত প্রকাশ। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই অবধারিতভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণের নামই চলে আসে। একাত্তরপূর্ববর্তী স্বাধিকার আন্দোলনের কালে তিনি ‘হুলিয়া’ কবিতায় আকস্মিকভাবে উচ্চারণ করেছিলেনÑ ‘শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’ এই প্রশ্নটি বাঙালি মননের অবচেতনে কখনও না কখনও নিশ্চিতরূপেই গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছিল। কবি একাধারে সত্যদ্রষ্টা ও সত্য-উচ্চারণকারী। আমরা লক্ষ্য করে দেখব এই কবি শেখ মুজিবকে উপজীব্য করে যে কয়টি কবিতা রচনা করেছেন তার ভেতরে রয়েছে সত্যের শক্তি ও সৌন্দর্য।
সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণদানের ঘটনাটিকে কবিতায় গেঁথে রেখেছেন নির্মলেন্দু গুণ যা পাবে দীর্ঘায়ু। দৃঢ় ঋজু শিল্পিত ভাস্কর্যের মতোই দীর্ঘস্থায়ী এই শব্দ-ভাস্কর্য। সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে নানাকৌণিক ভাষ্য ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়ে চলেছে ফিবছর। কিন্তু এই একটি মাত্র কবিতা শ্রোতা বা পাঠকের কাছে যেভাবে দৃশ্যটি রচনা করে দেয় এবং তার ভেতরকার সারসত্য তুলে ধরে তা শত পাতার গদ্যও স্পষ্ট করে তুলতে অক্ষম। এখানেই কবিত্ব শক্তি এবং কবিতা আঙ্গিকটির জয়ডঙ্কা বেজে ওঠে। কবিতাটির কয়েকটি চরণ পাঠ করা যাক :
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যেরকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : ‘কখন আসবে কবি?, ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মাত্র আটটি চরণসম্বলিত কবিতা লিখে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতাভা-ারে বিশেষ আসনটি পাকাপোক্তভাবে অর্জন করে নিয়েছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। কবিতাটি রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়ছে।
যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরি যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান।
অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের ভেতর শব্দ দিয়ে সাঁকো বেঁধে দিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক ‘আমার পরিচয়’ কবিতায়। প্রকৃত বিচারে এটি বাঙালির আত্মপরিচয়েরই ইশতেহার।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে’?
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
আগেই বলেছি দেশের সকল প্রধান কবিই কিবতায় শেখ মুজিবের কথা বলেছেন; বিশেষ করে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরÑ এই তিন দশকে আবির্ভূত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিগণ অকৃপণভাবেই মুজিব বন্দনা করেছেন। এঁরাই পঁচাত্তরপূর্ব এবং পঁচাত্তর পরবর্তী পর্বে তাঁদের কবিতায় শেখ মুজিবের কথা মমতা ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। এসকল কবির জীবনাভিজ্ঞতার ভেতরেই ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। তবে এটা অস্বীকারের উপায় নেই, পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর আমরা আর তেমনভাবে শেখ মুজিবের কথা উচ্চারিত হতে শুনিনি। উল্লেখিত প্রথম তিন দশকে উত্থিত কবিদের কণ্ঠে প্রবলভাবেই ধ্বনিত হয়েছিলেন মহান নেতা। এর পরবর্তী তিন দশকের কবিদের ভেতর সেই ধারাটি অনেকখানিই অনুপস্থিত। পঁচাত্তরের পরে দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার অপপ্রয়াস শুরু হয়; সে ছিল এক ইতিহাস বিকৃতির কাল। নবীন কবিরা বিভ্রান্ত হয়ে থাকবেন।
যে-মৃত্তিকায় দাঁড়িয়ে তরুণ কবি লিখে চলেছেন আধুনিক কবিতা, সেই তরুণদের বড় অংশের মধ্যেই দেখা গেছে স্বাধীনতার স্থপতিকে স্মরণ করা ও সম্মান জানানোর ব্যাপারে উদাসীনতা। এটাও মানতে হবে যে নিজ রচনার ক্ষেত্রে কবি অবশ্যই স্বাধীন। পাশাপাশি এটাও আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে, দেশ কাল ও জাতির প্রতি কবির দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধ থেকে স্বাধীনতার সপক্ষে কবিতাকে প্রাণিত রাখা সমীচীন। আর স্বাধীনতার কথা মুক্তিযুদ্ধের কথা উচ্চারণ করতে গেলে মহাকালের মহানায়ককে বিস্মৃত হওয়া চলে না।
এরকম একটি বাস্তবতায় আকস্মিকভাবে কবিদের মধ্য থেকে একজন মহাকাব্য রচনার প্রয়াসী হয়ে লিখে ফেলেন ‘প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু’। গ্রিক পুরাণের চরিত্রের প্রতীকে ইতিহাসের মহানায়ককে চিত্রিত করার কৌশল আমরা দেশের সবচাইতে খ্যাতিমান কবি শামসুর রাহমানের ভেতর প্রত্যক্ষ করেছি। ‘ইলেকট্রার গান’ কবিতায় মুজিব ও মুজিবদুহিতাকে কালের প্রেক্ষাপটে সহজেই শনাক্ত করা যায়। কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা যাক :
মাথার ভেতরে ঝোড়ো মেঘ ওড়ে, আমি একাকিনী
পিতৃভবনে, আমার কেবলি শোক পালনের পালা।
পিতৃহন্তা চারপাশে ঘোরে, গুপ্তচরের
চোখ সেঁটে থাকে আমার ওপর, আমি নিরূপায় ঘুরি
নিহত জনক, এ্যাগামেনন, কবরে শায়িত আজ।
এই দীর্ঘ কবিতাটি রচিত হয়েছে ছয় মাত্রার প্রবহমান মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। মোস্তফা তোফায়েলের ‘মহাকাব্য’ নামাঙ্কিত ‘প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু’ লেখা হয়েছে অমিত্রাক্ষর ছন্দে। এই কাব্যটির আলোচনা করেছেন শামস হক। খানিকটা উদ্ধৃত করছি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করেই :
‘প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু কাব্যে আছে সর্গ বিভাজন। কালিদাসের বিখ্যাত মহাকাব্য মেঘদূত অবলম্বনে পূর্বমেঘ, উত্তরমেঘ নামীয় দু’টি অংশও আছে এ কাব্যটিতে। প্রতীয়মান হয় যে, এর রচয়িতা এটিকে মহাকাব্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।...
প্রফেসর কবীর চৌধুরী মন্তব্য করেছেন যে, বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সে-মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদপ্রতিম মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে এই কাব্যে যে-ভাষায়, ব্যঞ্জনায় ও মহিমাদীপ্ত উচ্চতায় উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে বলা যেতে পারে যে এটি মহাকাব্যের আদল অর্জন করেছে।...
গ্রিক পুরানে গ্রিক টাইটান দেবতা প্রমিথিউসকে যেভাবে বন্দী করে লোহার শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল বহু দূরের ককেশাস পর্বতের সাথে, বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু মুজিবকেও সেভাবে বন্দী করে কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ অবস্থায় রেখে দিয়েছিল শোষক ঔপনিবেশিক ক্ষমতাধর শক্তি, হাজার মাইল দূরের এক নির্জন পাহাড়ি এলাকায়।’
কাব্যটির স্বাদ বোঝাতে উল্লেখ করছি কয়েকটি লাইন:
ভারত মহাসাগর পার হয়ে পাবে
নিম্নচাপে রুদ্ধশ্বাস বঙ্গোপসাগর,
তীরে যার বঙ্গদেশ। অগ্নি লেলিহান
শাল তমাল তাল বিজল হিজল।
বৃক্ষরাজি সর্বব্যাপী অগ্নিশোভাময়
জ্বলছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে আদিগন্ত সব
শত্রু তাড়িয়ে দিতে। সেখানে গিয়েই
তোমার বিষম গতি, বিদ্যুচ্চমক,
গম্ভীর সংঘর্ষ, নাম্বুনিনাদ
চরম উৎকর্ষ পাবে। তুমি যোগ দেবে
যুদ্ধে, সেখানে গিয়ে। সহায়ক হবে
বাংলাদেশের সেই মানুষের প্রতি। কর্মসূত্রে, রাজনৈতিক সূত্রে বা কোন না কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন এমন বহু ব্যক্তিই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত সেইসব স্মৃতিকথা অত্যন্ত মূল্যবান। সৃষ্টিশীল রচনার প্রয়োজনে সেইসব লেখা যে মাহমূল্যবান উপাদান হয়ে উঠতে পারে সেকথা বলাবাহুল্য। এ ক্ষেত্রে তাজউদ্দীনের ডায়েরির কথা প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই। এখনও ওই দিনলিপি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়নি। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ‘প্রথম দর্শনে বঙ্গবন্ধু’ বইটির কথা। আরেকজন সচিব মুহাম্মদ সিরাজুদ্দিন টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা লিখেছেন। তিনি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিগ্রন্থ লিখলে বঙ্গবন্ধু আমলের প্রশাসনিক বহু অজানা কথাই মানুষ জানতে পারবেন। হয়ত অতিরিক্ত নেতিবাচকভাবে প্রচারিত তিয়াত্তর চুয়াত্তরের দিনগুলো প্রকৃত সত্যের তরবারিতে ঝলসিত হয়ে উঠবে। তাতে কাটা পড়বে বহু মিথ্যাচার।
এখানে সদ্যপ্রয়াত কবি আবুল হোসেনের স্মৃতিকথা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে চাই কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। এই লেখাটির প্রথম পাঠক এবং প্রথম প্রকাশকারী ছিলাম আমি। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বঙ্গবন্ধুর প্রায় সমবয়সী এই কবির জন্মদিন পনেরোই আগস্ট। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর আর কখনই তিনি তাঁর নিজের জন্মদিন পালন করেন নাই। কবি আবুল হোসেন লিখেছেন : ‘প্রতিষ্ঠার দেড়-দু’বছরের মধ্যেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহভঙ্গ ঘটে পূর্ববঙ্গের। বিরোধীরা আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে সরকারী মুসলিম লীগের বিপরীতে। ভাসানী তাঁর সভাপতি, শেখ মুজিব যুগ্ম সম্পাদক। বিরোধী দলগুলো শেরে বাংলা ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে সম্মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালে। প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। পরিষদে গরিষ্ঠ দল যুক্তফ্রন্টের নেতা ফজলুল হক যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তার কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যে মন্ত্রিসভাকে ১৫ দিনের বেশি টিকতে দেয়নি। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে তার প্রধান শেরে বাংলাকে বরখাস্ত করে শেখ মুজিবকে পাঠায় জেলে। এর আগেও একাধিকবার তাঁর জেল হয়েছে। পরে যদিও তিনি একবার প্রাদেশিক মন্ত্রী হয়েছেন, বছর খানেকের জন্য, জেল খেটেছেন বহুবার। ষাটের দশকের শুরুতে বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ার সময় দেখে যাই তার রাজনৈতিক জীবনের অত্যাশ্চর্য রূপান্তর। জেলের ভাত আর সরকারের তাড়া খেতে খেতে কিভাবে এক তরুণ একগুয়ে ছাত্রনেতা দেড় দশকের মধ্যে তাঁর সমসাময়িক সতীর্থ এবং অনেক সহযাত্রীকে রাজনীতির ময়দানে পেছনে ফেলে, নয়তো মিইয়ে যেতে দিয়ে উঠে এসেছেন এক আপোসহীন চড়া গলার নেতার আসনে। সাড়ে ছ’বছর পরে যখন দেশে ফিরে এলাম তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা। সরকারের বিপক্ষে। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য আমার হয় দৈবক্রমে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরে এক হাসপাতালের কেবিনে। পরিচয় দিয়ে আমিই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি এক সহকর্মীর আসন্ন দুর্ভোগ থেকে রক্ষার প্রচেষ্টায়।’
ব্যক্তিগত গুণাবলী, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অসামান্য চরিত্রমাধুর্যের সৌরভে অবিস্মরণীয় নেতাদের কাতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ইতিহাসের অতুলনীয় এক মহাকাব্যের মতো। এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবন নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু লিখিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীও প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটি সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, দেশের জন্য আত্মত্যাগকে তিনি বড় করে দেখেছেন। রাজনীতি ছাপিয়ে গণমানুষের কথাই বেশি ধ্বনিত হয়েছে তার হৃদয়ে। এই অসামান্য আত্মকথায় তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি একটি ব্যতিক্রমী বই। অসামান্য হৃদয়বত্তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে এ বইয়ে। শুধু রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বা বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গই নয়, সাধারণ মানুষের কথাও সমগুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে বইটিতে।
ব্যক্তির মূল্যায়নের জন্যে আত্মজীবনী গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এটিকে ভিত্তি করে বড় মাপের সাহিত্য রচনার সম্ভাবনা থাকে। এই দুখিনী বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক শিশু কালে কালে কী বিপুল সঙ্কট ও সংগ্রাম পেরিয়ে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কোটি মানুষের অন্তরের মণিকোঠায়। হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো করুণ এক মৃত্যুর শিকার হন অবশেষে। ইতিহাসের এই মহানায়ককে নিয়ে খুব বড় মাপের সাহিত্য রচনার সুযোগটি এখনও রয়ে গেছে। আংশিক বা খ-িত জীবন নয়, বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবন নিয়েই সৃষ্টি হতে পারে অত্যন্ত উন্নত স্তরের সাহিত্য, বিশেষ করে বড় ক্যানভাসের ক্ল্যাসিক উপন্যাস। যা কেবল বাংলাদেশের সাহিত্যেরই অনন্য দৃষ্টান্ত হবে না, হয়ে উঠবে বিশ্বসাহিত্যের ভা-ারে এক কালজয়ী ধ্রুপদী সাহিত্য। এভাবেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসতে পারে বাংলাদেশ। বর্গমাইলের হিসাবে আয়তনে ছোট হলেও এই দেশ যে খুব বড় একটি সম্ভাবনার দেশ এবং যার রয়েছে শ্রদ্ধাজাগানিয়া এক গৌরবময় ইতিহাস- সেটি বিশ্ববাসী নতুন করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। একমাত্র সাহিত্যেরই রয়েছে সেই ব্যাপকগভীর তাৎপর্যপূর্ণ শক্তি।