হুমাযূন আহমেদের চার দশকের বর্ণময় লেখকজীবনের শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’। ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে ‘দেয়াল’ রচনা শুরু করেছিলেন তিনি। সে সময় উপন্যাসের পাঁচটি পর্ব ধারাবাহিকভাবে ‘অন্যদিন’-এর প্রকাশিত হয়। এরপর বেশ কিছুদিন বিরতির পর যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ক্যানসার চিকিৎসা চলাকালে নতুন করে ‘দেয়াল’ রচনায় মনোনিবেশ করেন তিনি, যদিও শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটির চূড়ান্ত রূপ দেয়ার সুযোগ পান নি। ‘দেয়াল’ ইতিহাস-আশ্রিত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। একজন লেখক ইতিহাসবিদ তথা সত্যসন্ধানীর ভূমিকা নিয়ে নামতেই পারেন। হুমায়ূন আহমেদ দেয়াল উপন্যাসে সেই কাজটি কতটুকু সক্ষমতার সাথে করেছেন? একজন লেখক- ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্য নির্ভরতা তিনি বজায় রাখেন নি । এ উপন্যাসে পাত্রপাত্রী আছে, ঘটনা-উপ ঘটনা আছে, আছে গল্প , তেমনি আছে ইতিহাসের ভুল বর্ণনা, ঐতিহাসিক কালের উল্লম্ফন উপরন্তু মানবিক-আধ্যাত্মিক উচ্চতায় ইতিহাসের খল নায়কদের নায়কোচিত আগমন। যে সময়কে উপজীব্য করা হয়েছে ‘দেয়াল’-এ, তা একটি সদ্যস্বাধীন জাতির ভাগ্যকাশের চরম অনিশ্চয়তার কাল। উপন্যাসের কিছু চরিত্র বাস্তব থেকে নেওয়া, নাম-ধাম সবই বাস্তব, ঘটনা-পরস্পরাও বাস্তবেরই অংশ। লেখক যেহেতু উপন্যাস লিখেছেন, তাই আছে কিছু কাল্পনিক চরিত্র। গল্প আবর্তিত হয়েছে এদের ঘিরেও। নানা ঘটনার ঘনঘটায় ঢাকা পড়ে নি জীবনসৌন্দর্য আর জীবন-সত্যের সন্ধান। ইতিহাসের সত্য আর লেখকের সৃজনী ভাবন্য-দুইয়ে মিলে ‘দেয়াল’ পরিণত হয়েছে একটি হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যানে। ‘দেয়াল’-এর মূল্যায়নে লেখক-গল্পকার সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন, “উপন্যাসটিতে হুমায়ূন ইতিহাসের দেয়ালটা ভাঙার একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিহাসের কাছে হয়তো এ তাঁর নিজস্ব দায়মুক্তি।ট্র্যাজিক নায়কদের মতো, যেমন খন্দকার মোশতাক আহমদকে, খালেদ মোশাররফকে; হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন; কর্নেল তাহেরকে পুনরধিষ্ঠিত করেছেন তাঁর বীরের আসনটিতে। এ দুই চরিত্রের এক আশ্চর্য নিরাবেগ চিত্রায়ন করেছেন হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসের দায় থেকেই।”সমসাময়িক বাংলা সানহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে বিবেচিত হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে গল্পের বর্ণনায় ১৯৭৫ সালের ১৫-ই আগস্টের আগেপরের কিছু চিত্র উপলব্ধির অভিপ্রায়ে দেয়াল-এর চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হল।
বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে এসেছেন র’-এর (ভারতের সিক্রেট সার্ভিস রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং) পরিচালক কাও। তিনি এসেছেন পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে। শেখ মুজিবুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, আমি আপনাকে চিনি। অনেকেই আপনাকে চেনে। আপনার ছদ্মবেশ ধরার প্রয়োজন পড়ল কেন? কাও বললেন, মাঝে মাঝে নিজেকে অন্য রকম ভাবতে ভালো লাগে বলেই ছদ্মবেশ। আপনাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মেজর রশীদ, ফারুক, লে. কর্নেল ওসমানী এ বিষয়ে আলোচনায় বসেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়। এই বিষয়ে আপনাকে তথ্য দিতে এসেছি।
শেখ মুজিব বললেন, আপনারা অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে যে আমার কাছে তথ্য দিতে আসে, তার কথায় আমার বিশ্বাস নেই।
-আপনার সামনে মহাবিপদ।
:মহাবিপদ আমি পার করেছি। পাকিস্তানের কারাগারে যখন ছিলাম, তখন বিপদ আমার ঘাড়ে বসে ছিল। এখন বিপদ ঘাড় থেকে নেমেছে।
-ঘাড় থেকে নামেনি, স্যার।
শেখ মুজিব বললেন, যাদের কথা আপনি বলছেন, তারা আমার সন্তানসম। আমি এই আলোচনা আর চালাব না। আমার শরীরটা ভালো না। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি ঘুমুতে যাব।
হরিদাসের চুল কাটার দোকান সোবহানবাগে। তার দোকানের একটু সামনেই ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডের মাথা। সংগত কারণেই হরিদাস তার সেলুনে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে:
শেখের বাড়ি যেই পথে
আমার সেলুন সেই পথে।
সাইনবোর্ডের লেখা পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে হরিদাস পথচারীদের জন্য এই সাইনবোর্ড টাঙায়নি। তার মনে ক্ষীণ আশা, কোনো একদিন এই সাইনবোর্ড বঙ্গবন্ধুর নজরে আসবে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসবেন। গম্ভীর গলায় বলবেন, সেলুনের সাইনবোর্ডে কী সব ছাতা-মাথা লিখেছিস। নাম কী তোর? দে, আমার চুল কেটে দে। চুল কাটার পর মাথা মালিশ।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ ধরনের কথা বলা মোটেই অস্বাভাবিক না, বরং স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি এমন আচরণ করেন বলেই তাঁর টাইটেল ‘বঙ্গবন্ধু’।
হরিদাস চুল কাটার ফাঁকে ফাঁকে খদ্দের বুঝে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প ফাঁদে। খদ্দেররা বেশির ভাগই তার কথা বিশ্বাস করে। হরিদাস কাঁচি চালাতে চালাতে বলে, আমার কথা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। যে কেঁচি দিয়া আপনের চুল কাটতেছি, সেই কেঁচি দিয়া স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর চুল কেটেছি। তাও একবার না, তিনবার। প্রথমবারের ঘটনাটা বলি, চৈত্র মাসের এগারো তারিখ। সময় আনুমানিক এগারোটা…
পনেরোই আগস্ট শেষরাতে হরিদাস তার দোকানে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। মড়মড় শব্দ হচ্ছে—দোকান ভেঙে পড়ছে। হরিদাস ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে দৌড়ে দোকান থেকে বের হয়ে হতভম্ব। এটা আবার কী? আলিশান এক ট্যাংক তার দোকানের সামনে ঘুরছে। ট্যাংকের ধাক্কায় তার দোকান ভেঙে পড়ে যাচ্ছে ট্যাংকের ঢাকনা খোলা। দুজন কালো পোশাকের মানুষ দেখা যাচ্ছে। দোকান ভেঙে ফেলার জন্য কঠিন কিছু কথা হরিদাসের মাথায় এসেছিল। সে কোনো কথা বলার আগেই ট্যাংকের পেছনের ধাক্কায় পুরো দোকান তার মাথায় পড়ে গেল। পনেরোই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সূচনা করল হরিদাস।
ঢাকা মসজিদের শহর। সব মসজিদেই ফজরের আজান হয়। শহরের দিন শুরু হয় মধুর আজানের ধ্বনিতে। আজান হচ্ছে। আজানের ধ্বনির সঙ্গে নিতান্তই বেমানান কিছু কথা বঙ্গবন্ধুকে বলছে এক মেজর, তার নাম মহিউদ্দিন। এই মেজরের হাতে স্টেনগান। শেখ মুজিবের হাতে পাইপ। তাঁর পরনে সাদা পাঞ্জাবি এবং ধূসর চেক লুঙ্গি।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কী চাও? মেজর বিব্রত ভঙ্গিতে আমতা-আমতা করতে লাগল। শেখ মুজিবের কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব আবার বললেন, তোমরা চাও কী?
মেজর মহিউদ্দিন বলল, স্যার, একটু আসুন।
কোথায় আসব?
মেজর আবারও আমতা-আমতা করে বলল, স্যার, একটু আসুন।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ তোমরা করবে?
এই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে এল মেজর নূর। শেখ মুজিব তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই সে ব্রাশফায়ার করল। সময় ভোর পাঁচটা চল্লিশ। বঙ্গপিতা মহামানব শেখ মুজিব সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়লেন। তখনো বঙ্গবন্ধুর হাতে তাঁর প্রিয় পাইপ।
বত্রিশ নম্বর বাড়িটিতে কিছুক্ষণের জন্য নরকের দরজা খুলে গেল। একের পর এক রক্তভেজা মানুষ মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে লাগল।
বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূ তাঁদের মাঝখানে রাসেলকে নিয়ে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ঘাতক বাহিনী দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট রাসেল দৌড়ে আশ্রয় নিল আলনার পেছনে। সেখান থেকে শিশু করুণ গলায় বলল, তোমরা আমাকে গুলি কোরো না। শিশুটিকে তার লুকানো জায়গা থেকে ধরে এনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হলো। এরপর শেখ জামাল ও শেখ কামালের মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে হওয়া দুই তরুণী বধূকে হত্যার পালা।
বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি মন্ত্রী সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে শেখ মণির বাড়িও একই সঙ্গে আক্রান্ত হলো। সেখানেও রক্তগঙ্গা। শেখ মণি মারা গেলেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে। পিতামাতার মৃত্যুদৃশ্য শিশু তাপস দেখল খাটের নিচে বসে। এই শিশুটি তখন কী ভাবছিল? কেবিনেট মন্ত্রী সেরনিয়াবাত মারা গেলেন তাঁর দশ-পনেরো বছরের দুই কন্যা, এগারো বছর বয়সী এক পুত্র এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সী এক নাতির সঙ্গে।
সকাল সাতটা।
বাংলাদেশ বেতার ঘন ঘন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছে। উল্লসিত গলায় একজন বলছে, ‘আমি ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে এক সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে। সারা দেশে মার্শাল ল জারি করা হলো।’
দেশ থমকে দাঁড়িয়েছে।
কী হচ্ছে কেউ জানে না। কী হতে যাচ্ছে, তাও কেউ জানে না।
মানুষের আত্মার মতো দেশেরও আত্মা থাকে। কিছু সময়ের জন্য বাংলাদেশের আত্মা দেশ ছেড়ে গেল।
খন্দকার মোশতাক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও ফজরের নামাজটা সময়মতো পড়তে পারেন না। তিনি অনেক রাত জাগেন বলেই এত ভোরে উঠতে পারেন না। পনেরোই আগস্ট তাঁর ঘুম ভাঙল আটটায়। শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন—এই খবর তাঁকে দেওয়া হলো। তিনি বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। খবর নিয়ে এসেছেন তাঁর ভাতিজা মোফাজ্জল। তাকে ভীত ও চিন্তিত দেখাচ্ছে। মোফাজ্জল বলল, রেডিও ছাড়ব? খবর শুনবেন?
মোশতাক বললেন, না। কড়া করে এক কাপ চা আনো। চা খাব।
মোফাজ্জল বলল, আপনি কি বাড়িতেই থাকবেন, না পালিয়ে যাবেন?
পালিয়ে যাব কোন দুঃখে? আমি অপরাধ কী করেছি?
সদর দরজায় কি তালা লাগায়া রাখব?
না। সদর দরজা থাকবে খোলা। তুমি নিজে সেখানে টুল পেতে বসে থাকবে। আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে চাইলে তাকে সম্মানের সঙ্গে নিয়ে আসবে।
কে আসবে দেখা করতে?
মোশতাক এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কিছু সময় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা দরকার। বাথরুম হলো নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য আদর্শ স্থান।
সিঁড়িতে বুটজুতার শব্দ হচ্ছে। খন্দকার মোশতাক একমনে দোয়ায়ে ইউনুস পড়তে লাগলেন। এই দোয়া পাঠ করে ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর বিপদ ইউনুস নবীর চেয়ে বেশি।
দরজা খুলে মেজর রশীদ ঢুকলেন। তাঁর হাতে স্টেনগান। তাঁর পেছনে দুজন সৈনিক। তাঁদের হাতেও স্টেনগান। সৈনিক দুজন স্টেনগান মোশতাকের দিকে তাক করে আছে।
মোশতাক নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করলেন। মেজর রশীদ বললেন, স্যার চলুন। মোশতাক বললেন, কোথায় যাব?
প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। প্রথমে রেডিও স্টেশনে যাবেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।
ট্যাংক এসেছে কেন?
প্রেসিডেন্টের মর্যাদা রক্ষার জন্য ট্যাংক এসেছে।
মোশতাক বললেন, শুক্রবারে আমি জুমার নামাজের আগে কোনো কাজকর্ম করি না। দায়িত্ব যদি গ্রহণ করতে হয়, জুমার নামাজের পর।
মেজর রশীদ কঠিন গলায় বললেন, আপনাকে আমি নিতে এসেছি, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। অর্থহীন কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।
মোশতাক বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। তবে আমাকে কিছু সময় দিতে হবে।
আপনাকে কোনো সময় দেওয়া হবে না।
কাপড় চেঞ্জ করার সময় দিতে হবে। আমি নিশ্চয়ই লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিব না?
সকাল এগারোটা পঁয়তাল্লিশে খন্দকার মোশতাক বেতারে ভাষণ দিলেন। তিনি আবেগমথিত গলায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ‘সূর্যসন্তান’ আখ্যা দিলেন।
মোশতাকের ভাষণের পর বঙ্গভবনে আনন্দ উল্লাস, কোলাকুলি, একে অন্যকে অভিনন্দনের পালা শুরু হয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ তখনো তাঁর বত্রিশ নম্বর বাড়িতে পড়ে আছে।
সন্ধ্যাবেলা শফিক এসেছে রাধানাথ বাবুর কাছে। শফিকের বিপর্যস্ত ভঙ্গি দেখে তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। শফিক কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আর কেউ প্রতিবাদ করল না! কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াল না!
রাধানাথ বললেন, কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি এটা ঠিক না। খবর পেয়েছি ব্রিগেডিয়ার জামিলউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। গুলি খেয়ে মারা গেছেন। পুলিশের কিছু কর্মকর্তা বাধা দিয়েছিলেন। তাঁরাও মারা গেছেন।
শফিক বলল, কেউ তাঁর পক্ষে রাস্তায় বের হয়ে কিছু বলবে না?
রাধানাথ বললেন, তুমি কি রাস্তায় বের হয়ে কিছু বলেছ? তুমি যেহেতু বলোনি, অন্যদের দোষ দিতে পারবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?
জি।
রাধানাথ বললেন, সাহস আছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলার—‘মুজিব হত্যার বিচার চাই?’
শফিক বলল, আমার সাহস নেই। আমি খুবই ভীতু মানুষ। কিন্তু আমি বলব।
কবে বলবে?
আজ রাতেই বলব।
রাত আটটা। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তিন বাহিনীর প্রধান নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। পুরোনো মন্ত্রিসভার প্রায় সবাইকে নিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা তৈরি হয়েছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যুক্ত হয়েছেন। আতাউল গনি ওসমানী হয়েছেন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা।
মনে হচ্ছে পুরোনো আওয়ামী লীগই আছে, শুধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই। আপসহীন জননেতা মওলানা ভাসানী, যিনি এক মাস আগেও বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তিনিও নতুন সরকারকে সমর্থন জানালেন।
পনেরোই আগস্ট রাত নয়টার দিকে সরফরাজ খানের বাড়ির সামনের রাস্তায় এক যুবককে চিৎকার করতে করতে সড়কের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত যেতে দেখা গেল। সে চিৎকার করে বলছিল, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’। যুবকের পেছনে পেছনে যাচ্ছিল ভয়ংকরদর্শন একটি কালো কুকুর।
সেই রাতে অনেকেই রাস্তার দুপাশের ঘরবাড়ির জানালা খুলে যুবককে আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধও করে ফেলছিল।
আচমকা এক আর্মির গাড়ি যুবকের সামনে এসে ব্রেক কষল। গাড়ির ভেতর থেকে কেউ একজন যুবকের মুখে টর্চ ফেলল। টর্চ সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ইংরেজিতে বলল, ইয়াং ম্যান, গো হোম। ট্রাই টু হ্যাভ সাম স্লিপ।
শফিককে এই উপদেশ যিনি দিলেন, তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। যান, যান, বাসায় যান।
শফিক বলল, জি স্যার। যাচ্ছি।
খালেদ মোশাররফ বললেন, আমি আপনাকে চিনি। অবন্তীদের বাসায় দেখেছি। আপনি অবন্তীর গৃহশিক্ষক।
জি।
গাড়িতে উঠুন। আপনি কোথায় থাকেন, বলুন। আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
আমি হেঁটে যেতে পারব। তা ছাড়া আমার সঙ্গে এই কুকুরটা আছে। কুকুর নিয়ে আপনার গাড়িতে উঠব না।
শফিক চলে যাচ্ছে। জিপ দাঁড়িয়ে আছে। খালেদ মোশাররফ সিগারেট ধরিয়ে অবন্তীর গৃহশিক্ষকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ লিগেসি অব ব্লাড-এ উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর পর টুঙ্গিপাড়ার তাঁর পৈতৃক বাড়িতে স্থানীয় জনগণ হামলা করে এবং বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
হায়রে বাংলাদেশ!