বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী প্রথম সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল ১৯৭৫ সালে। ১৫ আগস্ট কয়েকজন মধ্যম সারির সেনা অফিসারের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানে দেশটির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন বাকশালেরই কিছু নেতাকে নিয়ে সরকার গঠন করা হয়েছিল।
তবে পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল সামরিক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তাদের হাতে।
সে সময়ই আরও সামরিক অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান চলেছে এবং দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল।এখন ৪০ বছর পর এসে রাজনীতিতে সরাসরি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ না থাকলেও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ঘটনার ২১ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে, তখন বিচার শুরু করা হলে, সেই প্রক্রিয়া চলার সময় খন্দকার মোশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়। বিচার হয় সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া সামরিক কর্মকর্তাদের।
তবে দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, শেখ মুজিবকে হত্যার পেছনে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র ছিল।৭৫ সালে সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। তিনি বলেছেন, জুনিয়র কিছু কর্মকর্তা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
কিন্তু সে সময়ের সিনিয়র কিছু কর্মকর্তা তাঁকে সহায়তা না করাতে তিনি তা প্রতিহত করতে পারেননি। পুরো ঘটনার পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল বলেও তিনি সে সময় অনুধাবন করেছিলেন।
শেখ মুজিবকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারও বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। আড়াই মাসের সেই সরকারের শেষ পর্যায়ে ৩ নভেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সৈয়দ তাজউদ্দিন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের চারজন নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হয়েছিলো। এরপর অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান চলেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন ৭৫এ ঢাকায় সেনাবাহিনীর মুল ব্রিগেড ৪৬-এ একজন কর্মকর্তা ছিলেন।
তিনি বলছেন, শেখ মুজিবকে হত্যার পর তাঁর মাপের বা তাঁর প্যারালাল কোন রাজনৈতিক নেতা সে সময় না থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছিলো। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কর্মকর্তারা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল, যার প্রভাবে দীর্ঘসময় ধরে সামরিক বাহিনীতে রক্তাক্ত অধ্যায় চলেছে বলে ব্রিগেডিয়ার হোসেন মনে করেন।
তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানের সময়ই ২১টি অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। জেনারেল এরশাদও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছিলেন।
জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সব রাজনৈতিক দলের নয় বছরের আন্দোলনে চূড়ান্ত পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানও হয়েছিল। সামরিক আইন জারী করে ক্ষমতায় এসে জেনারেল এরশাদ রাজনৈতিক দল করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং সংসদ নির্বাচন করে সংবিধানে সংশোধনী এনে তার শাসনকে বৈধতা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানও প্রথমে হ্যাঁ-না ভোট এবং পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন।
মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম একজন সংগঠক সুলতানা কামাল বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে ভিন্নদিকে দেশকে নেয়ার লক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ সময়ের সামরিক হস্তক্ষপ সেই লক্ষকে সফল করেছে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় সাধারণ মানুষের কয়েকজন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ যে ছিল, সেই হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে গেছে বলে তারা মনে করেন।
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে আসার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ সরাসরি দৃশ্যমান ছিল না। ওই সময়ের পর নির্বাচনের মাধ্যমে তিনটি রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তন হয়। ২০০৭ সালে রাজনীতিতে আবার সামরিক হস্তক্ষেপ দেখা যায়। কিন্তু এর প্যাটার্ন ছিল ভিন্ন। সংবিধানের ভিতরে থেকেই বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সরকারের সমর্থনে ছিল সামরিক বাহিনী। ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আবার রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসে।
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ৭৫এ প্রথম সামরিক হস্তক্ষেপের ৪০ বছর পর এসে হস্তক্ষেপ কমেছে, সেটা বলা যায় না। তবে বিশ্ব পরিস্থিতিসহ এখনকার বাস্তবতায় সামরিক হস্তক্ষেপের ধরন পাল্টেছে বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজনৈতিক সরকারগুলোর মধ্যে এক ধরনের আশংকা এখনও কাজ করে। আওয়ামী লীগের আগের সরকারের সময়ে সংবিধানে যে সংশোধনী আনা হয়, সেখানে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে মৃত্যুদন্ডের বিধান আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে সামরিক প্রভাব বা হস্তক্ষেপ থাকার বিষয়টি প্রমাণ হয় বলেও বিশ্লেষকদের ধারণা।
সুলতানা কামালও মনে করেন, রাজনীতি এখনও সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ থেকে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বিশ্লেষকদের অনেকের কাছে আবার ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোই সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহিদুল আনাম খান বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে অনেক সময় সেনা হস্তক্ষেপের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে থাকে।
সাধারণ মানুষের অনেকে মনে করেন, দেশে যত বড় রাজনৈতিক সংকট হোক না কেন, তা রাজনীতিকরাই মোকবেলা করবেন, সেটাই তারা চান।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যখন বাড়ে, তখন রাজনৈতিক সরকারও সামরিক বাহিনীর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে এমন পরিস্থিতি এড়ানো উচিৎ বলেও তাঁরা মনে করছেন।
সূত্র:বিবিসি বাংলা