আল মাহমুদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু ও জিয়া


ওমর বিশ্বাস

বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ। কবিতার সঙ্গেই তার নিবিড়তা। সাহিত্যের নানা শাখায়ও রয়েছে তার অবাধ বিচরণ। এর পাশাপাশি রাজ-রাজড়াদের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যের কথা কমবেশি সবার জানা। মুক্তিযোদ্ধা কবি হিসেবে তিনি যেমন গর্বিত, তেমনি তার আর একটি অহংকার হলো, তিনি ছিলেন একটি র‌্যাডিক্যাল পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’-এর সম্পাদক। তিনি ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য যেমন পেয়েছেন, তেমনি আবার তাদের রোষানলে পড়ে জেলও খাটতে হয়েছে। তার পরও তিনি বিভিন্ন সময় গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। জিয়াউর রহমানের প্রতিও তার বিনম্র শ্রদ্ধা। এই দুজনারই খুব কাছের মানুষ হতে পেরেছিলেন তিনি। লেখার মধ্য দিয়ে তিনি সেগুলো প্রকাশ করেছেন। তাদের নিয়ে লিখেছেনও।

এই দুই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সেই সব সখ্যের লেনাদেনা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ‘কথোপকথন আল মাহমুদ’-এ। একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের নানা বিষয়ের সঙ্গে কবি আল মাহমুদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিএনপি ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে নানা আঙ্গিকে কথোপকথন হয়। সেখান বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। এখানে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তুলে ধরা হয়েছে।

সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আল মাহমুদ বলেন, “… নব্য বাঙালি ধনীরা পাঞ্জাবি, ইস্পাহানী, বাওয়ানী, দাউদ-এদের খপ্পর থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। বাঙালিরা কলকারখানা করতে চেয়েছে। নিজেদের পুঁজি খাটাতে চেয়েছে। ধনী হতে চেয়েছে। আর এদের প্রতিনিধি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিরা যেটা চেয়েছে, তাদের যে দাবি ছিল, সেটাই রূপায়িত করতে চেষ্টা করেছেন শেখ মুজিব ছয় দফা দিয়ে। বাঙালি জাতির যদি মুক্তি না হয়, বাঙালি পুঁজিপতিদের মুক্তি হবে না; বাঙালি কৃষকের মুক্তি হবে কী করে? এটাই শেখ মুজিব খুব নির্ভুলভাবে কাজে লাগিয়েছেন, যা অন্যরা পারেনি। পাকিস্তান ধর্মীয় দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও ধর্ম দিয়ে কি শাসিত হয়েছে? সোজা কথা, সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পাকিস্তান শাসিত হয়েছে। এ রকম একটি দেশে বাঙালিরা থাকতে চায়নি। এদের যত উদ্যোগ ছিল, মার্শাল ল তা শেষ করেছে। ঠিক এ রকম একটি পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব ছয় দফা দিয়েছেন। সোজা কথা, তিনি জনগণের স্বাভাবিক চাওয়াকে পুঁজি করে রাজনীতি করেছেন এবং তাতে তিনি সার্থকও হয়েছেন। এই হলো আওয়ামী লীগের সার্থকতা। এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। আর অবশেষে শেখ মুজিব তার অসাধারণ নেতৃত্বের মাধমে বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিলেন, যা আজকের বাংলাদেশ।”

আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আল মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে সফল হয়েছে। শেখ মুজিব এটা করতে পেরেছেন। এটাই তার রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকিস্তান আমলে এ দেশের ইন্টেলেকচুয়ালরা কেউ তখন শেখ মুজিবের সমর্থক ছিল না। প্রগতিবাদীরা তো ছিলই না। চীনপন্থী প্রগতিবাদীই হোক বা মস্কোপন্থীই হোক, তারা কিন্তু প্রথম থেকেই শেখ মুজিবের ছয় দফার বিরোধী ছিল বা এটাকে তারা তেমন গুরুত্বও দেয়নি। এটার রাজনৈতিক গুরুত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা উপলব্ধি করেনি অন্য রাজনীতিবিদরা। এটা ছিল তাদের ভ্রান্তি।

‘সোনালী কাবিন’-এর কবি আরো বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই, একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ। এবং তারা পাঞ্জাবিদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। এটা শেখ সাহেবের অবদান। তিনি সারা জীবন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন এবং তিনি দক্ষিণপন্থীই ছিলেন, বামপন্থী ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে তার ভুল পদক্ষেপ ছিল যে, তিনি হঠাৎ এ দেশের মস্কোপন্থীদের আবর্তে পড়ে গেলেন এবং বাকশাল গঠন করলেন। এই বাকশালই তার পতনের প্রধানতম কারণ বলে আমি মনে করি। এই হলো আমার মূল্যায়ন। এর বেশি আমি কিছু বলতে চাই না।”

সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্ন ছিল, “আপনি অনেক সময় বলেছেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে আপনার এক ধরনের ঋণের সম্পর্ক আছে। ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসটি লিখে আপনি সেই ঋণ শোধ করেছেন। বিষয়টি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?” তার উত্তরে আল মাহমুদ বলেন, “আমি সরাসরিই বলি। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি ছয় দফা দাবির আবেগে এবং বাঙালি জাতির সমর্থনে। তখন থেকেই শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। পরবর্তী সময়ে ‘গণকণ্ঠ’ যখন করি, তিনি আমাদের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে যদিও তিনি আমার ব্যাপারে খুব সফট ছিলেন, কিন্তু তবু তিনি প্রায় এক বছর আমাকে জেল খাটিয়েছেন। কিন্তু একটা কথা আবার স্বীকার করতে হবে, জেলখানা থেকে বের হওয়া মাত্র তিনি আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে গেছেন। আমি জেল থেকে বেরিয়ে রাতটা শুধু কাটিয়েছি। সকালবেলা আমার বাড়িতে টেলিফোন আসে। ওনার সেক্রেটারি টেলিফোন করে বলেছেন, শেখ সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি যেন সেখানে চলে যাই। আমি গিয়েছি। তিনি আমাকে একটা চাকরির অফার দিয়েছেন। আমি তাকে বলেছি যে, আমি আমার পেশায় (সাংবাদিকতা) থাকতে চাই। কিন্তু তিনি সেটা করতে দেননি। তিনি আমাকে শিল্পকলা একাডেমীতে জয়েন করতে বলেছেন। আমি অনেক চিন্তা করে সেটা করেছি। এটাও তো একটা ঋণ। তিনি যেখানে তার বিরোধীদের সহ্যই করতেন না একদম, সেখানে আমার মতো একজন কবিকে তিনি একটা সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করলেন, এটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। আমি মনে করি, এটা একটা ঋণই বটে।”

আল মাহমুদ আরো বলেন, “আমি কি আর করতে পারি? আমার জানামতে, তৎকালীন সময়ের চিত্রে শেখ মুজিবের যে ইমেজ ছিল, সে ইমেজটা আমি ধারণ করি। এই যে পাকিস্তান ভেঙে গেল এবং এই যে টানাপোড়েন, এর ওপর একটা উপন্যাস লিখেছি। ওই উপন্যাসে শেখ মুজিবের ছবিটা খুব কম। দু-একবার একটু প্রস্ফুটিত। কিন্তু সেখানে আমি তাকে এমন মর্যাদা দিয়েছি, আমি মনে করি ইতিহাস যদি সমকালীন উপন্যাস অনুসন্ধান করে, তাহলে সেখানে শেখ মুজিবের আসল চরিত্রটি দেখা যাবে। একটা ছায়ার মতো এসে উপস্থিত হবে।”

বাংলা ভাষার প্রধান কবি বলেন, “যদিও এই উপন্যাস লেখার আগেই আমার আদর্শগত দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে, কিন্তু আমি কখনো ভুলিনি শেখ সাহেবের কী ভূমিকা ছিল? এই জন্যই আমি লিখেছি যে, তার কাছে আমার ঋণ ছিল। সে ঋণ আমি শোধ করে দিয়েছি।”

জিয়াউর রহমান

বিএনপি সম্পর্কে আল মাহমুদ তার মূল্যায়নও তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, “আমি দীর্ঘদিন জিয়াউর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি শেখ মুজিবেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, এটা মনে রাখা দরকার। শেখ মুজিব আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি তার খুব প্রিয়পাত্র ছিলাম। এটা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করি যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে তিনি আমাকে ডেকে পাঠাতেন গণকণ্ঠের এডিটর হিসেবে। দেশের বিভিন্ন বিষয় তিনি আলোচনা করতে চাইতেন। আমি বুঝতে পারতাম, শেখ সাহেব দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে করতে দেয়নি।

আর বিএনপির জিয়াউর রহমান খুব হিরোইক লোক ছিলেন। অসাধারণ মেধাবী মানুষ এবং তার দেশপ্রেমের কোনো তুলনাই হয় না। তিনি চেষ্টা করেছেন দেশটাকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে একটা গোড়াপত্তন করার। এবং ভারতের পাশে একটা রাষ্ট্রের স্বাধীন থাকার যেসব উপাদান দরকার, তিনি সেটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করারও চেষ্টা করেছেন। তার একটা চমৎকার ধারণা ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে। আমি তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। আমার উপলব্ধি যে, জিয়াউর রহমান তার ব্যক্তিগত চারিত্রিক দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের জন্য জনগণের সমর্থন পেয়েছেন। জিয়াউর রহমান যদি আরো কিছু দিন থাকতেন, তাহলে দেশের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যেত, সে বিশ্বাস আমার এখনো আছে। পরবর্তী সময়ে তার মতো যোগ্য লোক বিএনপিতে ছিল না, এখনো নেই।

আল মাহমুদ ছিলেন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপাতি। বিএনপির এই অঙ্গসংগঠনটি সম্পর্কে তিনি বলেন, “জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) প্রথম দিকে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছিল না। এটা একটা আলাদা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। জিয়াউর রহমান আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। তিনি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্য একটি সাংস্কৃতিক কণ্ঠস্বর তৈরি করতে চেয়েছিলেন। গান-বাজনায়, সাহিত্যে, শিল্পে এটা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সেই জন্য তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে এটা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি জাসাসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলাম। তিনি যতদিন ছিলেন, আমি ছিলাম। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যখন এটা বিএনপির অঙ্গসংগঠন হিসেবে পরিণত হলো, তখন আমি এতে আর থাকিনি। কারণ, আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতির চর্চা করি না। আমি সাহিত্যের মানুষ।”

আর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা কীভাবে গড়ে ওঠে, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “একবার উনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করেন। আমাকে জাসাসের সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই সময় প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাকে খুব উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এটা আমার মনে আছে খুবই যে, তিনি বলেছিলেন ‘এটা আপনাকে করতে হবে।’ আমি করেছিলাম। জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও আমার বহু বিনিময় হয়েছে। কথাবার্তা হয়েছে। আমি তাকে অত্যন্ত দেশপ্রেমিক এক মহৎ হৃদয়ের মানুষ মনে করি। রাষ্ট্রনায়কসুলভ সব গুণই তার ছিল।”

আল মাহমুদ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ‘তৃষিত জলধি’ নামে বহুল আলোচিত একটি গল্পও লিখেছেন। তিনি অকপটে বলেছেন, “লিখেছি। কবিতাও লিখেছি তার ওপর। আমি শেখ সাহেবের ওপরও কবিতা লিখেছি। শেখ সাহেবের ওপর কবিতার একটা কালেকশন বেরিয়েছে, সেখানে আমার কবিতা আছে।”

সূত্রঃ নতুনবার্তা

SUMMARY

1141-1.jpg