শেখ রেহানা
ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বা প্রায়ই থাকতেন জেলখানায়। আমাদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আর আব্বাও জেলখানার বাইরে, ঈদও এল—এমন হলে তো কথাই নেই। আমাদের হতো ডাবল ঈদ।
আব্বা জেলে থাকলে ঈদের পরের দিন মা বেশি করে ভালো খাবারদাবার রাঁধতেন। জেলে তো আব্বা একা খাবেন না, অন্য যে নেতারা আছেন, তাজউদ্দীন চাচারা আছেন, আশপাশে যাঁরা আছেন, সবাইকে নিয়ে খাবেন। আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আমরা যেতাম জেলখানায়। ১৫ দিনে একবার দেখা করতে যাওয়ার অনুমতি মিলত। সেদিন আমি স্কুলের শেষ দুই পিরিয়ড না করেই চলে আসতাম। রাসেল তো জন্মের পর আব্বাকে বাইরে কমই দেখেছে। ও জেলখানায় গেলে আর ফিরতে চাইত না। বলত, এটা আব্বুর বাড়ি। আমি আমাদের বাড়িতে যাব না। আসো, আমরা আব্বুর বাড়িতেই থাকি। কতই-বা বয়স ছিল তখন। তিন বা চার। ও তো বুঝত না। আমাদের জেলগেট থেকে ফিরে আসতেই হতো। সেই রাতে রাসেল আর ঘুমোতে পারত না। গভীর রাতে সে কাঁদতে শুরু করত। হাছু আপাকে ডাকো, দেনা আপাকে ডাকো, (আমাকে প্রথম প্রথম সে ডাকত দেনা আপা, তারপর রেয়না আপা), বড় ভাইকে ডাকো, ছোট ভাইকে ডাকো। আমরা ছুটে যেতাম। কী হয়েছে! কোনো দিন বলত পেটে ব্যথা, কোনো দিন বলত হাতে ব্যথা, আসলে আব্বার কথা তার মনে পড়েছে, সে ঘুমোতে পারছে না, আমাদের সবাইকে কাছে পেতে চাইছে, আমরা তাকে ঘিরে বসে আছি, সে মায়ের কোলে, ছোট্ট হাত-পা-শরীরের মানুষটা, মায়াভরা মুখ, বড় বড় চোখের পাতা, একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধু, তঁার পেছনে শেখ রেহানা, শেখ জামাল, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও অন্যান্য। তঁারা কখনো একা খেতেন না
আর আব্বা বাসায় থাকলে তো আমাদের ঈদের খুশি। বাড়িতে গমগম করছে মানুষ। কতজন যে আসছেন, কতজন যে খাচ্ছেন, আমরা যা খাই, তা-ই খাচ্ছেন—আলাদা কিছু নয়। রাজনৈতিক পরিবার, যাঁরা আসেন, খান। আমাদের ডাইনিং টেবিলটা ছিল বিশাল বড়। একসঙ্গে ১২ জন ১৬ জনও খেতে বসতে পারত। বাসাভর্তি লোকজন গমগম করছে, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে—আমরা তো পড়ারও জায়গা পাই না। ছাদে চলে যাই। কিংবা এই ভিড়ের মধ্যেই সব ভাইবোন একখানে গোল হয়ে বসে গুনগুন করে একসঙ্গে পড়ি। সব সামলাতেন আমার মা। আব্বার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে, মাকে বলছেন, তুমি যা ভালো বোঝো, কোরো। কী যে সম্মান করতেন মাকে। নারীর প্রতি, স্ত্রীর প্রতি কী যে তাঁর সম্মানবোধ ছিল। আর আমার মা! তাঁর কথা ভাবি। কত অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে জীবন-সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। আব্বা আগের দিন মন্ত্রী, পরের দিন জেলখানায়, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ মাকে বাসাভাড়া দিচ্ছে না। আমার তখনো জন্ম হয়নি, কিন্তু এসব ঘটনা তো শুনেছি, পড়েছি, পরে নিজের চোখে দেখেছি। গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছ থেকে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে-দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোনো মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি—সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাঁর নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলাচ্ছেন।
আব্বা জেলে থাকলে তো আমাদের ঈদ বিশেষ কিছু ছিল না। কাপড়চোপড়ও তো নতুন তেমন কিছু আসত না।
ঈদের আগে সবচেয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো হাসিনা আপাকে, আমাদের এখনকার প্রধানমন্ত্রীকে। আমাদের ছিল সেলাই মেশিন। তখন দরজির কাছে কেউ পোশাক বানাতে যেত না। বাড়িতে জামাকাপড় বানাতে হতো, সেটাই ছিল চল। মা আমাদের কাপড় সেলাই করতেন, তারপরে করতে শুরু করেন হাসু আপা। আমাদের বাড়িতেই কত লোকজন, তার ওপর আশপাশের পড়শিরাও এসে দিয়ে যেত কাপড়। আপা সবার জামা বানিয়ে দিতেন। সবারটা দিচ্ছেন, শুধু আমারটা দিচ্ছেন না। আমি বলি, আপা, আমার জামাটা বানাবে না? বানাও।
আপা বলেন, ‘বানাব রে। একটু মাথা ধরেছে। তুই এক কাজ কর তো। এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। তোর বানানো চায়ের কোনো তুলনা হয় না।’ চা বানিয়ে আনলাম। খাচ্ছেন। ‘ভালো হয়েছে’ বলে হাসলেন। তারপর আবার আরেকজনের জামা বানাতে শুরু করলেন। আমি বলি, আপা, আমারটা বানাবে না? আমারটা ধরো। তিনি হাসতেন, হয়তো বললেন, ‘যা তো, দেখ তো, কফি কোথায় পাওয়া যায়, একটু কফি খেতে পারলে ভালো হতো।’ আমি অভিমান করতাম, যাও, আমারটা তোমাকে বানাতে হবে না। আমারটা বানাতেন একেবারে চাঁদরাতে। শেষ সময়ে। উফ্। কী যে করতেন! একবার তো শেষ সময়ে তাড়াহুড়ো করে আপা জামা বানিয়ে দিয়েছেন ঈদের আগের রাতে। লুকিয়ে রেখে সকালে পরতে গেছি। দেখি, সেলাই করেছেন কাপড়ের উল্টো দিকে।
শেখ রেহানা। ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল
রাসেল আব্বাকে জেলখানার বাইরে পেলে কাছছাড়া করতে চাইত না। আব্বার মতো করে কাপড়চোপড় পরত। আব্বার মতো পাঞ্জাবি-পায়জামা, মুজিব কোট, আব্বার মতো শেরওয়ানি। আবার তার একটা ছোট্ট লুঙ্গিও ছিল। আব্বার তো সবচেয়ে প্রিয় পোশাক ছিল লুঙ্গি আর গেঞ্জি। রাসেলও আব্বাকে অনুকরণ করে পোশাক পরত। আব্বার মতো করে হাঁটত। আবার আব্বা হয়তো পাঞ্জাবি-পায়জামার সঙ্গে জুতা পরে বাইরে যাচ্ছেন। রাসেল দৌড়ে গিয়ে স্যান্ডেল-শু এনে দিত। বলত, আব্বা, পায়জামার সঙ্গে জুতা পরতে হয় না। আব্বা বলতেন, কাদা-পানিতে হাঁটতে হবে বাবা। রাসেল বলত, তাহলে আরেক জোড়া সঙ্গে করে নিয়ে যাও।
ঈদের দিন আব্বা, ভাইয়েরা, বাসায় আর যাঁরা যাঁরা আছেন ছেলেরা, সবাই সকালবেলা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজ পড়তে গেল। জামাল ভাই তো পুরো রমজান মাস টুপি পরে থাকতেন। ৩০ রোজা তো করতেনই। আব্বা নামাজ পড়তেন সোবহানবাগ মসজিদ বা ধানমন্ডি মসজিদে। তারপর সোবহানবাগে আমাদের ছোট ফুপু লিলি, সৈয়দ হোসেন ফুপার বাড়িতে গিয়ে সবাই নাশতা করতেন। নাশতা সেরে সেখান থেকে চলে আসতেন বাসায়। ফুপুরাও চলে আসতেন, সবাই মিলে আমাদের বাসাতেই কাটাতেন ঈদের দিনের বাকি সময়টা। আমরাও বিকেলবেলা বেড়াতে বের হতাম। ধানমন্ডি, কলাবাগান, শুক্রাবাদে বন্ধুদের বাসা, লেকের ধার ধরে হাঁটা। মাঠে-বাগানে চষে বেড়ানো। তখন তো সবকিছু খোলামেলা ছিল। দিনের বেলা আমাদের বেড়ানোয় কোনো মানা ছিল না।
আমাদের সময়ে জামা-কাপড়ের সংখ্যা তো কারোরই বেশি ছিল না। কামাল ভাই, জামাল ভাই, কারোরই না। কামাল ভাই খুব শৌখিন ছিলেন। খুব গুছিয়ে রাখতেন সবকিছু। কিন্তু বেশি কিছু চাইতেন না। আমার কাছেই এসে হয়তো কোনো দিন বললেন, দশটা টাকা দিবি। বিড়ি-সিগারেট কোনো দিন খাননি। খরচ তো কিছু ছিল না। কত যে তাঁর গুণ ছিল। আমি তো বলি, আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি তাঁদের মামার একটা গুণও পায়, সেও হবে অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। কামাল ভাই সেতার বাজাতেন। ধরা যাক, বাড়িতে অনেক মানুষ। আমার পরীক্ষা। পড়ব কোথায়? পড়ার জায়গার খোঁজে ছাদে গেছি। গিয়ে দেখি কামাল ভাই। হাতে সেতার। আকাশে চাঁদ। চারদিক থইথই করছে জোছনায়। কামাল ভাই বললেন, পড়তে হবে না আজকে। অত পড়ে কী করবি। আয়, আমার সঙ্গে বস। গান ধর। আমি তাঁর সঙ্গে গান ধরলাম। একজন-দুজন করে এসে বসে পড়ল পাশে। জামাল ভাই এলেন। হাসু আপা এলেন। আমরা গান করছি। আকাশে তখন চাঁদ, নারকেলের পাতার ফাঁকে অকৃপণ আলো বিলাচ্ছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়। হাসু আপার কোলে রাসেল, তার ঢুলু ঢুলু চোখে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। হাসনাহেনার গন্ধ বয়ে আনছে রাতের বাতাস।
আমাদের বাসাটা তো ছিল খেলাপাগল বাসা। আমাদের নিয়ম ছিল, বিকেল হলে খেলতে যাও, কিন্তু মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরতে হবে। এসে গোসল করে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসো। বাসায়ও নানা রকমের খেলা হতো। ক্যারম খেলার তো টুর্নামেন্ট হতো। মনি ভাই, সেলিম ভাইয়েরাও আসতেন। বাগাডুলি খেলা নিয়ে মজা হতো খুব। একটা ঘর আছে বাগাডুলিতে, এলটিপি, লস্ট টোটাল পয়েন্ট। কেউ একজন বলল, এইবার তোর এলটিপি হবে, তারপর যদি হতো, আমরা সবাই তার ওপরে কপট রাগ ঝাড়তাম, তুমি হলে এলটিপি ভাই, এই যে এলটিপি ভাই এসেছেন। চোর-পুলিশ খেলতাম। লুকোচুরি খেলতাম। বাইরে পেয়ারাগাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছি, বড় বড় লাল পিঁপড়া, কালো পিঁপড়া, হাত-পায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু চুপটি মেরে আছি। আরেকটা খেলা ছিল, ভূত নামিবে খেলা।
পাঁচ ভাইবোন: শেখ রাসেল, শেখ কামাল, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ জামাল
রোববারে ছুটির দিনে মা একটু ভালো রান্না করতেন। হয়তো লুচি বা পরোটা। মা লুচি ভাজছেন। একটা মোড়া নিয়ে আব্বা বসেছেন। তাঁর পাশে আমরা সবাই পিঁড়ি পেতে বসেছি। একটা একটা করে লুচি ভাজা হচ্ছে। আমাদের একেকজনের পাতে পড়ছে। আমাদের চার ভাইবোনের চারটা কাঁসার থালা ছিল। সেই কাঁসার থালায় আমরা খাচ্ছি।
আর আমাদের ছিল গ্রামোফোন। মা যখন গ্রামে ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গী ছিল কলের গান। হাত দিয়ে হাতল ঘুরিয়ে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড চালানো হতো। মায়ের প্রিয় ছিল জগন্ময় মিত্র, শচীন দেববর্মণ, সন্ধ্যা-লতা, সুরাইয়া আর আব্বাসউদ্দীন সাহেবের নজরুলসংগীত। আমাদের বাসায় রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা একটা গান ছিল, মৈত্রেয়ী দেবী আব্বাকে দিয়েছিলেন, রুপার ফ্রেমে বাঁধানো ছিল। ১৯৭৫-এ কী করেছে, রুপার ফ্রেমটা নিয়ে ওই রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা কাগজটা দলা পাকিয়ে নিচে ফেলে রেখেছে। আমরা যখন ঢোকার অনুমতি পেলাম, আমি বহুদিন দোতলায় যাইনি, একদিন গেলাম, গিয়ে দেখি, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নিচে পড়ে আছে। আমি সেটা যত্ন করে তুলে রাখলাম। এখন আপার কাছে আছে, প্রথমে ভেবেছিলাম শান্তিনিকেতনে দেব, পরে ভাবলাম, না তা কেন, এটা তো বঙ্গবন্ধু জাদুঘরেই থাকতে পারে। কোন গানটা আছে জানেন? ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’।
বাসার মধ্যে আমিই ছিলাম একটু আদুরে, আবদার করতাম। আব্বা বাইরে গেলে আমি তাঁকে এত বড় ফর্দ ধরিয়ে দিতাম। আব্বা বলতেন—হানিফ, কী লিস্ট দেয় নে, রেখে দে, এনে দিস। ফরাশ সাহেব, দেখবেন। আর আব্বা বেশি রাত করে ফিরতেন। আমি তাঁর হাতে খাব। এই জন্য প্রায়ই ভাত খেতাম না। অজুহাত বের করতাম—জামাল ভাই আমার দিকে কটমট করে তাকাল কেন? ও আমার বইটা এখানে না রেখে ওখানে রাখল কেন? আমি ভাত খাব না। আব্বা ফিরতেন বহু রাতে। আমি ভাত খাইনি শুনে আমাকে ঘুম থেকে তুলতেন। একটা ছোট্ট তোয়ালে আমার গলার নিচে বাঁধতেন। তারপর ভাত-তরকারি হোক, দুধ-ভাত হোক, মাখাতেন। আমাকে তুলে তুলে খাওয়াতেন। তারপর তোয়ালে ভিজিয়ে আমার মুখ মুছে দিতেন। আলতো করে শুইয়ে দিতেন। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে আছি, শুনছি—এই, তোরা রেহানাকে বকেছিস কেন? সকালবেলায় উঠে আমি হাসতাম, কেমন কাল রাতে বকা খেলে...আব্বা আমার জন্যই কেবল নিউমার্কেটে গেছেন দু-একবার। আমি এটা-ওটা কেনার বায়না ধরতাম।
আব্বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গোপনে আমাদের টাকা দিয়ে বলতেন—নে, টাকা নে, লুকিয়ে বুড়ির জন্য ভালো শাড়ি কিনে আন। মাকে আদর করে বুড়ি ডাকতেন। আমরা মার্কেটে গিয়ে শাড়ি কিনে এনে গোপনে আব্বার হাতে দিতাম। আব্বা সেটা কোথাও লুকিয়ে রাখলেন। মা দেখলেন, শাড়ির প্যাকেট। আব্বা বলতেন, শাড়িটা কেমন? মা বুঝতেন, এ তো মার্কেটে যাওয়ার লোক নয়। নিশ্চয়ই মেয়েদের দিয়ে আনিয়ে নিয়েছেন।
রেডিও আর বই ছিল আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। কামাল ভাই ১৯৭১ সালে যুদ্ধে গেলেন, জামাল ভাই গেলেন। কামাল ভাই যাওয়ার আগে একটা রেডিও উপহার পেয়েছিলেন, একটা সুইডিশ ফ্যামিলি দিয়েছিল। সেটা আমাদের বাসায় জোরে জোরে বাজত। স্বাধীন বাংলা বেতারের গান আমরা জোরে জোরে বাজাতাম। বাইরে পাকিস্তানি সৈন্য। ওরা তো বাংলা বোঝে না। রাসেল সেই গান শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে। কিন্তু যখন ঘরের বাইরে গিয়ে সে গান গাইত, সে গাইত—
জয় জয় জয়
গাছের পাতা হয়...
তখনই সে বুঝেছে, জয় বাংলা বলা যাবে না পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে।
আব্বা তো তখন পাকিস্তানের জেলে বন্দী। রাসেল একা একা ঘরের কোণে বসে কাঁদছে। কী হয়েছে রে? জানি না আপা, আমার চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ে। আমার চোখে কী যেন হয়েছে। স্বীকার করতে চাইত না যে আব্বার জন্য তার মন খারাপ।
আব্বার সঙ্গে শেখ রেহানা
কার কী মনে হয় জানি না, আমার শুধু রাসেলের কথাই মনে হয়। ৪০ বছর হয়ে গেল! আপাকে বলি, আপা, মা বেঁচেছিলেন ৪৪ বছর, আমরা তো বেশি বছর বেঁচে গেলাম। জানি না, আমরা দুই বোন কেন বেঁচে আছি। রাসেলেরও তো আমার সঙ্গে জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল। অত ছোট ছেলে, মা ছাড়লেন না। ওর জার্মানি যাওয়া হলো না।
আব্বার ডায়েরি পাওয়া গেছে, আব্বা একটা মুরগি নিয়ে লিখেছেন, একটা পাখিকে নিয়ে লিখেছেন। কী তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কী যে তাঁর গাছপালা-প্রাণী-প্রকৃতি আর মানুষের জন্য ভালোবাসা।
আজও তো এই আকাশে চাঁদ ওঠে। জোছনায় ভেসে যায় চরাচর। আজও রাতজাগা পাখি গান করে। আমার মনে পড়ে সেই সব দিন। আমরা সবাই ছাদে। কামাল ভাই সেতার বাজাচ্ছেন। আমাকে বললেন, তুই একটা গান ধর। মায়ের পছন্দ জগন্ময় মিত্র। ‘যত লিখে যাই, চিঠি না ফুরায় কথা তো হয় না শেষ...তুমি আজ কত দূরে।’
কিংবা শচীনদেবের গান—
‘নদী যদি হয়রে ভরাট কানায় কানায়
হয়ে গেলে শূন্য হঠাৎ
তাকে কি মানায়।’
আমাদের ভর-ভরন্ত একটা পৃথিবী ছিল। হঠাৎ করে একদিন সব শূন্য হয়ে গেল। আমরা তো আগে কোনো দিন একা একা ভাত খাইনি। এখন একা একা খেতে হয়! জানি না, আল্লাহ কেন আমাদের দুজনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমরা আব্বার ডায়েরি পড়ি, সেগুলো বই হয়ে বেরোবে, সেসব কাজের তদারক করি। হয়তো, আব্বার স্মৃতিরক্ষার এই কাজগুলো করিয়ে নেওয়ার জন্য আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। আবার ঈদ এসেছে। আমার আবার আব্বার কথা মনে পড়বে, রাসেলের কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে মায়ের কথা, ভাইদের কথা, ভাবিদের কথা। এভাবেই তো কেটে গেল ৪০টি বছর।