সাইফুদ্দীন চৌধুরী
[বাঙালির শোকের মাসÑআগস্ট উপলক্ষে এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদ, রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি অধ্যাপক নূরল আলম ও সাধারণ সম্পাদক কবি আরিফুল হক কুমার- এর অনুপ্রেরণায় প্রবন্ধটি রচিত]
পিত্রাদেশ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারকির কাজে ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আজকের বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ববঙ্গে যাতায়াত করেছেন। পূর্ববঙ্গের তিন জমিদারি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর আর রাজশাহীর পতিসরে যাওয়া-আসা করেছেন নদীপথে ‘বোটে’ চড়ে। পদ্মা, গড়াই, ইছামতি, হুরাসাগর, করতোয়া, নাগর, বড়াল নদী আর চলন বিল ছিল তাঁর ওই জলপথ।
পূর্ববঙ্গে জমিদারি পরিচলনা করতে এসে, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত নিবিড়ভাবেই যেন পরিচিত হয়েছিলেন এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে। যার প্রমাণ রয়ে গেছে, এখানে লেখা অজ¯্র কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং স্বজনদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে। এখানকার মানুষদের ভালবেসে, তাঁদের কল্যাণার্থে অনেক জনহিতৈষণামূলক কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রজা-জমিদার স্বার্থরক্ষার এমন ঘটনা বিরল। প্রজাদের কল্যাণেও গ্রামের উন্নতির জন্য নিজপুত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে ¯œাতক করে নিয়ে এসেছিলেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অর্থের একটি বড় অংশ দিয়ে নিজস্ব জমিদারি পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করে প্রজাদের স্বল্পসুদে, সহজ কিস্তিতে কৃষি ঋণ পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
আজকের বাংলাদেশে নানা কৌণিকেই, রবীন্দ্রনাথের অবদান বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। অর্ধ-শতাব্দীব্যাপি সময় ধরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়নের যে ধারা গড়ে তুলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংক স্থাপন করে গ্রামের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন- বলা যায় শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের যে অনেক দেশই সেই পথকে এখন অনুসরণ করে চলেছে। তাঁর লেখা ছাড়া একাডেমিক কোনো কার্যক্রম চলে না- শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চতর উপাধি পর্যন্ত পাঠ্য রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখা গান ছাড়া বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবন থাকে অপূর্ণ। তাঁর লেখাই হয়ে উঠেছিলো আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল প্রেরণা। তাঁর প্রতি বাঙালি জাতির ঋণের অন্ত নেই।
বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের পুনর্বসান সহজ ছিল না। ইতিহাস তো একথাই বলে। ’৪৭-এ দেশভাগের পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শোষণ প্রভৃতি কারণে অশান্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কিছুদিন পরেই এই অবস্থার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এসে যায়। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদে বিতর্কের ঝড় উঠে। রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হচ্ছে জেনে রাজপথে মিছিল করে দেশের মানুষ। ৫২’র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল, এক দশক কালের মধ্যেই, বলা বাহুল্য তা পাকিস্তানের উভয় অংশের সংহতিকে অনেকটাই দুর্বল করে তুলেছিল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতার বিষয় মেনে নেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের স্বাধিকার আন্দোলন অংশত সফল হয়েছিল।
ক’বছর পর, ১৯৬১ সালে সারা দেশে পালিত হয় রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী। এতে দেশে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে উঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয়ে উঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছ’দফা দাবি ঘোষণার পরে। ১৯৬৭’র জুনে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে; সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠে। ১৯৬৭ এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আইয়ুবশাহীর কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পরপরই রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। দেশের অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে, বাঙালির প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য, আর সরকার আমাদের পাঠে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলা কবিতা লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না- আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এদেশে গীত হবেই।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর ওই ভাষণে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দসঙ্গীতের উপর থেকে সব ধরনের বিধি-নিষেধ তুলে নিয়ে, দুটি প্রচার মাধ্যমেই পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের দাবি জানান। একটি কথা এখানে স্মরণীয় যে, তার কিছুদিন আগেই বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এসময় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল গগণস্পর্শী। কাজেই বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ তখন ছিল অনেকটাই নির্দেশের মতো। বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিলেন খানিকটা হলেও তাঁর প্রস্তাব অনুসরণ করতে।
১৯৬৯-এর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কলীম শরাফী, সানজিদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, আফসারী খানম, বিলকিস নাসিরুদ্দীন, রাখী চক্রবর্তী, ইফফাত আর দেওয়ান প্রমুখ নন্দিত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ওই অনুষ্ঠানে বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারের সময়সীমা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। তিনি বক্তব্যে বলে – …. ঞধমড়ৎব যধফ ৎবভষবপঃবফ ঃযব যড়ঢ়বং ধহফ ধংঢ়রৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ইধহমষধববং ঃযৎড়ঁময যরং ড়িৎশং ধহফ রিঃযড়ঁঃ ঞধমড়ৎব ঃযব ইবহমধষর খধহমঁধমব ধিং রহপড়সঢ়ষবঃবফ. উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার সময় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
পাকিস্তান সরকার ও তাদের সহযোগী সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী কিছু বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করতে সুপরিকল্পিতভাবে অনেক প্রয়াসই চালিয়েছিলেন, কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আস্থাশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তা সফল হতে দেয়নি। পাকিস্তানের দুঃশাসন, অর্থনৈতিক নিপীড়ন প্রভৃতির নিগড় থেকে মুক্ত করতে অন্যান্যের সঙ্গে রবীন্দ্রচর্চার প্রতি বাঙালির জাতির দুর্বার আগ্রহ অনেকটাই সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছিল বৈকি?
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের লেখা, রবীন্দ্রনাথের গান ছিল প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রেরণার উৎস। আমাদের লাল-সবুজের পতাকা অর্জনে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনেকখানি। কৃতজ্ঞ জাতি তাঁর গানকে জাতীয় সঙ্গীত করে, রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে বাঙালিরা স্থায়ী আসনেই বসিয়েছেন। বাঙালি জাতি কখনই কী রবীন্দ্রনাথের সেই অবদানের কথা বিস্মৃত হতে পারবে?
লেখক: গবেষক। অধ্যাপক ও ডিন, লিবারেল আর্টস, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নাটোর।