রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু

 ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী

পিত্রাদেশ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারকির কাজে ১৮৮৯ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আজকের বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ববঙ্গে যাতায়াত করেছেন। পূর্ববঙ্গের তিন জমিদারি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর আর রাজশাহীর পতিসরে যাওয়া-আসা করেছেন নদীপথে 'বোটে' চড়ে। পদ্মা, গড়াই, ইছামতি, হুরাসাগর, করতোয়া, নাগর, বড়াল নদী আর চলনবিল ছিল তার ওই জলপথ।পূর্ববঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করতে এসে, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত নিবিড়ভাবেই যেন পরিচিত হয়েছিলেন এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে। যার প্রমাণ রয়ে গেছে এখানে লেখা অজস্র কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং স্বজনদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে। এখানকার মানুষদের ভালোবেসে, তাদের কল্যাণার্থে অনেক জনহিতৈষণামূলক কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রজা-জমিদার স্বার্থরক্ষার এমন ঘটনা বিরল। প্রজাদের কল্যাণেও গ্রামের উন্নতির জন্য নিজ পুত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক করে নিয়ে এসেছিলেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অর্থের একটি বড় অংশ দিয়ে নিজস্ব জমিদারি পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করে প্রজাদের স্বল্প সুদে, সহজ কিস্তিতে কৃষিঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।আজকের বাংলাদেশে নানা কৌণিকেই, রবীন্দ্রনাথের অবদান বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। অর্ধশতাব্দীব্যাপী সময় ধরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়নের যে ধারা গড়ে তুলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংক স্থাপন করে গ্রামের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন_ বলা যায় শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের যে অনেক দেশই সেই পথকে এখন অনুসরণ করে চলেছে। তার লেখা ছাড়া একাডেমিক কোনো কার্যক্রম চলে না_ শিশু শ্রেণী থেকে উচ্চতর উপাধি পর্যন্ত পাঠ্য রবীন্দ্রনাথ। তার লেখা গান ছাড়া বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবন থাকে অপূর্ণ। তার লেখাই হয়ে উঠেছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল প্রেরণা। তার প্রতি বাঙালি জাতির ঋণের অন্ত নেই।বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের পুনর্বাসন সহজ ছিল না। ইতিহাস তো এ কথাই বলে। '৪৭-এ দেশভাগের পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শোষণ প্রভৃতি কারণে অশান্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কিছুদিন পরেই এ অবস্থার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এসে যায়।


রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদে বিতর্কের ঝড় উঠে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ হচ্ছে জেনে রাজপথে মিছিল করে দেশের মানুষ। '৫২-র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল, এক দশককালের মধ্যেই, বলা বাহুল্য তা পাকিস্তানের উভয় অংশের সংহতিকে অনেকটাই দুর্বল করে তুলেছিল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতার বিষয় মেনে নেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের স্বাধিকার আন্দোলন অংশত সফল হয়েছিল।ক'বছর পর, ১৯৬১ সালে সারাদেশে পালিত হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এতে দেশে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি ঘোষণার পর। ১৯৬৭-এর জুনে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে; সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভে দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৬৭-এর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আইয়ুব শাহীর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। দেশের অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে, বাঙালির প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপিয়ার, অ্যারিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য, আর সরকার আমাদের পাঠে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলা কবিতা লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এ ব্যবস্থা মানি না_ আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এ দেশে গীত হবেই।'বঙ্গবন্ধু তার ওই ভাষণে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর থেকে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে, দুটি প্রচার মাধ্যমেই পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের দাবি জানান। একটি কথা এখানে স্মরণীয় যে, তার কিছুদিন আগেই বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এ সময় তার জনপ্রিয়তা ছিল গগনস্পর্শী। কাজেই বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ তখন ছিল অনেকটাই নির্দেশের মতো। বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিলেন খানিকটা হলেও তার প্রস্তাব অনুসরণ করতে।১৯৬৯-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কলীম শরাফী, সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, আফসারী খানম, বিলকিস নাসিরুদ্দীন, রাখী চক্রবর্তী, ইফফাত আরা দেওয়ান প্রমুখ নন্দিত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ওই অনুষ্ঠানে বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের সময়সীমা আর বাড়ানোর প্রস্তাব করে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। তিনি বক্তব্যে বলেন "Tagore had reflected the hopes and aspiration of the Bangalees through his works and without Tagore the bengali Language was incomplete."


উল্লেখ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার সময় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।পাকিস্তান সরকার ও তাদের সহযোগী সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী কিছু বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করতে সুপরিকল্পিতভাবে অনেক প্রয়াসই চালিয়েছিলেন; কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আস্থাশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তা সফল হতে দেয়নি। পাকিস্তানের দুঃশাসন, অর্থনৈতিক নিপীড়ন প্রভৃতির নিগড় থেকে মুক্ত করতে অন্যান্যের সঙ্গে রবীন্দ্রচর্চার প্রতি বাঙালির জাতির দুর্বার আগ্রহ অনেকটাই সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছিল বৈকি?আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের লেখা, রবীন্দ্রনাথের গান ছিল প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রেরণার উৎস। আমাদের লাল-সবুজের পতাকা অর্জনে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনেকখানি। কৃতজ্ঞ জাতি তার গানকে জাতীয় সঙ্গীত করে, রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে বাঙালিরা স্থায়ী আসনেই বসিয়েছেন। বাঙালি জাতি কখনোই কি রবীন্দ্রনাথের সেই অবদানের কথা বিস্মৃত হতে পারবে?

লেখকঃ অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

1133-1.jpg