পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ : রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু


সেলিনা হোসেন
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গের শিলাইদহে আসার আগে পর্যন্ত কখনো নিজের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে নিজের মুগ্ধ-চেতনার এমন অনুভব প্রকাশ করেননি : ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই-যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’ এ চিঠিতে স্বদেশের ভিন্ন জায়গা দেখার অনুপ্রেরণায় তিনি নিজের উপলব্ধিকে প্রগাঢ় করেছেন। প্রকৃতি, পল্লীর, পল্লীর জনজীবন, দারিদ্র্য ইত্যাদি মিলিয়ে পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুর তাঁর জীবনদর্শনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গের গণমানুষের সাহস, আত্মশক্তি দেখেছেন, তাদের মধ্যে নবজাগরণে বাণী শুনতে পেয়েছেন।

১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ময়মনসিংহে এসেছিলেন। ময়মনসিংহ পৌরসভার আয়োজনে সূর্যকান্ত টাউন হলে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন : ‘আমি আপনাদের এখানে আসবার সময় গাড়ীর বাতায়ন থেকে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম আজকের দিনের জর্জরিত দেশকে নয় দুঃস্থ দেশকে নয় শ্রদ্ধাবিশ্বাসহীন অবমানিত দেশকে নয় দেখতে চেষ্টা করেছিলুম ভাবীকালের হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গমাতার সুন্দরী মূর্তি। সেই দূরের মূর্তি ধ্যানের মধ্যে আনবার চেষ্টা করেছিলুম। কি করে সকলের কাছে সেরূপ প্রকাশ করব এই ইচ্ছা আমার হচ্ছিল। সেই সুজলা, সুফলা, শ্যামলামধুকর, গুঞ্জিতনবজচ্যুত মঞ্জরী শোভিত সুন্দরী বঙ্গমাতার মধুর মূর্তি আমার অন্তরে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। আজ নতুন যুগ এসেছে রথের ঘর্ঘর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বঙ্গদেশ আশার বাণীতে মুখরিত হয়েছে উঠেছে। আমার স্বাস্থ্য নেই, যৌবনের তেজ নেই, কিন্তু তৎসত্ত্বও আমার ইচ্ছা আছে, সেই ইচ্ছাই আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করতে চাই। এ দেশের আকাশে বাতাসে স্নেহ আছে, মাদকতা আছে, সৌন্দর্য আছে তার কথা চিন্তা করতে করতে আমার জীবন শেষ হবে, এই আমার কামনা। সেই আশার সঙ্গীত ধ্বনি দেশের আকাশে বাতাসে মুখরিত হবে এই আমার চিরন্তন বিশ্বাস।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৪ বৎসর বয়সে। সঙ্গী হয়ে ছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সময়টি ছিল ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস। ১৯ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামপুর বোয়ালিয়ার ব্রাহ্মমণ্ডলী আয়োজিত প্রার্থনাসভায় যোগ দেন। প্রশান্ত কুমার পাল তত্ত্ববোধিনী মাঘ-সংখ্যার সূত্র ধরে লিখেছেন ‘স্বাধ্যায়ের পর প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমধুর স্বরে একটি মনহোর ব্রাহ্মসঙ্গীত করেন। এই সময়ে শিলাইদহে অল্পদিন অবস্থানের কারণে শিলাইদহ তাঁর মনে তেমন দাগ কাটেনি। তিনি দ্বিতীয়বার শিলাইদহে যান ১৮৭৬ সালে। সঙ্গী হয়েছিলেন বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এবার তিনি শিলাইদহে একমাসের বেশি সময় কাটিয়ে ছিলেন। এ সময় তিনি  কবিতা লিখে খাতা ভরিয়েছেন। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেছেন। ফুলের রঙিন রস কলমের নিবে লাগিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। তিনি জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন—‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোটো একটি কোণের ঘর, যত বড়ো ঢালা ছাদ তত বড়ো ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন দেশের ছুটি, পুরানো দিঘার কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এইসঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে। সেগুলো যেন ঝরে পড়বার মুখে মাঘের প্রথম ফসলের আমের বোল ঝরেও গেছে। কিশোর বয়সে পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি দেখার সূচনায় নগরজীবন এবং গ্রামীণ জীবনের পার্থক্যটি প্রবল হয়ে ওঠে। পূর্ণ হয় সৃজনশীলতার মাত্রা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন পূর্ববঙ্গের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের মেয়ে ভবতারিনীকে। ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। বিয়ের পরে তিনি স্ত্রীর  নাম রাখেন মৃণালিনী। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘মা গায়ে হলুদের পরে রবিকাকাকে আইবুড়াভাতের নেমন্তন্ন করে। মা খুব খুশি, একে যশোরের মেয়ে, তায় রথীর মা মার সম্পর্কের  বোন। বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রবেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দক্ষিণডিহি গ্রামে এসেছিলেন কিনা এই নিয়ে তথ্যের মতভেদ আছে। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন : ১৮৮৩ পূজার ছুটির সময় জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহী হইয়া বাস্তুভিটা দেখিবার অজুহাতে যশোর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে যান, উদ্দেশ্য কাছাকাছি পিরালী পরিবারের মধ্যে হইতে বধূ সংগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ নিজে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে বলেছেন—‘আমার বিয়ের কোনো গল্প নেই। বৌঠানরা যখন বড় বেশী পীড়াপীড়ি শুরু করলেন আমি বললুম, তোমরা যা হয় কর, আমার কোনো মতামত নেই। তারাই যশোর গিয়েছিলেন, আমি যাইনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিত বলা যাবে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে দক্ষিণডিহি গ্রামের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বংশানুক্রমিক যোগ আছে। দক্ষিণডিহির জমিদার জগন্নাথ কুশারী রবীন্দ্রনাথের আদিপুরুষ। এই পরিবারের জয়রামের পুত্র নীলমণি ১৭৮৪ সালের জুন মাস থেকে জোড়াসাঁকোতে বসবাস শুরু করেন। নীলমণির মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রামলোচনের পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি ভায়ের ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। পৈতৃক উত্তরাধিকারের সূত্রে রবীন্দ্রাথ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কে যুক্ত। তার মা সারদা দেবীও ছিলেন দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা। সুতরাং মামাবাড়িও পূর্ববঙ্গে। আর দক্ষিণডিহি গ্রামের কন্যা মৃণালিনী দেবীকে বিয়ের সূত্রে পূর্ববঙ্গ একই সমান্তরালে তাঁর জীবন-সম্পৃক্ত ভূখণ্ড হয়।

কলকাতার সেরেস্তায় বসে জমিদারি দেখাশোনার কাজ শিখে নিতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দেবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি এক চিঠিতে লেখেন—‘এইক্ষণে তুমি জমিদারির কাব্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও। প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিতরূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিল কার্য ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি রপ্তানি পত্রসকল দেখিয়া তার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ। বাবার এমন নির্দেশের কথা শুনে তিনি অবাক হয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে মৃণালিনী দেবী, তাঁর বান্ধবী বেলা ও রথীন এবং ভাইপো বলেন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি শিলাইদহ আসেন।

পূর্ববঙ্গে তখন জমিদারির তিনটি পরগণা ছিল একটি নদীয়া জেলার বিরাহিমপুরে, তার কাছারি ছিল। শিলাইদহে; দ্বিতীয়টি রাজশাহী জেলার কালিগ্রামে, তার কাছারি ছিল পতিসরে; তৃতীয়টি ছিল পাবনা জেলার শাজাদপুরে, তার কাছারি শাজাদপুর গ্রামেই ছিল রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তিরিশ বছর। এরপর থেকে দশ বছর টানা পূর্ববঙ্গে কাটিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি ভাগ করে দিলে রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়েছিল কালিগ্রাম। জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাজ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন উপলক্ষে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন। বিশেষ করে নাগরিক সমাজের আমন্ত্রণে তাকে বিভিন্ন। জায়গায় যেতে হত। তিনি সব নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন গভীর আনন্দ ও দায়িত্ববোধে। কারণ পূর্ববঙ্গ তার চিন্তা, চেতনা, মননকে ভিন্ন  খাতে নিয়ে গিয়েছিল। উপলব্ধির বহুতল বিস্তৃত এই পরিসর তার সৃজনশীলতার, জ্ঞানের বোধকে তীক্ষ্ন করেছিল। পূর্ববঙ্গকে নিয়ে  তাঁর আশাবাদ পরিব্যাপ্ত হয়েছিল তার চিন্তার সূত্রে।

১৮৯২ সালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন। উপলক্ষ ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দশম প্রাদেশিক সম্মিলনীতে অংশগ্রহণ। ১৯০৫ সালে কুমিল্লার টাউন হলে বক্তৃতা করেন। ১৯০৭ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে বক্তৃতা করেন। ১৯০৮ সালের ১১-১২ ফেব্রুয়ারি পাবনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৪ সালের ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি পাবনায় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তম অধিবেশনের আয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সম্মেলনে ভাষণ প্রদান করেন। ১৯১৯ সালের ৩ নভেম্বর গুয়াহাটি থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সিলেট শহরে পৌঁছান ৫ নভেম্বর। ৬ নভেম্বর রতনমণি লোকনাথ টাউন হলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।  ৭ নভেম্বর মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্ররা তাকে সংবর্ধনা দেয়।

১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। ঢাকা পৌরসভা এবং জনসাধারণ তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে। একই দিনে ঢাকার করপোরেশন পার্কে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নারীদের সংগঠন দীপালি সংঘ কবিকে। সংবর্ধনা দেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বক্তৃতা করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ কবিকে সংবর্ধনা দেয়। ১০ ও ১৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে The Meaning of Art ‰es The Rule of the Giant শীর্ষক দুটি লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন। ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে আসেন। ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যালিটি সূর্যকান্ত টাউন হলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্মমন্দিরে কবিকে সংবর্ধনা দেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সাহিত্য সমাজ তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কবি কুমিল্লায় আসেন। ২০ তারিখে কুমিল্লার অভয় আশ্রমের কর্মীরা তাঁকে সংবর্ধনা জানায়। ২১ ফেব্রুয়ারি অভয় আশ্রমের বার্ষিক উৎসবে সভাপতিত্ব করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ভাষণ দিয়েছেন তার বিভিন্ন অংশে পূর্ববঙ্গের মানুষ, জনজীবন, জনজীবনের মানসিক শক্তি, আত্মিক স্ফুরণ এবং এই ভূখণ্ড তাদের মাধ্যমে যেভাবে উজ্জ্বল হয়তো উঠেছে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই ভূখণ্ডের অমিত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে। তাঁর অভিজ্ঞতায়, অনুভবে পূর্ববঙ্গবাসীর আত্মজাগরণের জায়গাটি চমৎকারভাবে ফুঠে উঠেছে।

১৯২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ছাত্রসংঘ কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করে। স্থানীয় হাইস্কুলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়  শোভাযাত্রা করে। দীর্ঘ কয়েক বছর এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বাস করে ১৯০১ সালে তিনি সংসার গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। তারপর আসা-যাওয়া করেছেন। নদীতে বসবাস করেছেন বটের পতিসর-শাজাদপুর ঘরোয়া সময় বিল-নদীর নৌপথে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিবরণ পত্র-সাহিত্যে পাওয়া যায়। কত নিবিড়ভাবে মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখেছেন তা বর্ণনা করে শেষ করার নয়। ১৯৩৭ সালে কবি শেষবারের মতো পূর্ববঙ্গে আসেন। গ্রাম ছিল পতিসর। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কবির আত্মিক যোগ। সেবার তিনি নাগর নদীপথে পতিসর ছাড়েন। তারপর আত্রাই স্টেশন থেকে ট্রেনে কলকাতায় যান।

১৯৩৬ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘Degree of Doctor of Literature’ প্রদান করে। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারকে কবি যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে আছে— ‘কল্যাণীয়েষু, ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ওই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাদেরই জলযানে। ভেসে পড়ব। ১০ তারিখ পর্যন্ত তাদের আতিথ্য ভোগ করে কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল। ইতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।—১৬ মাঘ ১৩৩২।’ এভাবে গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে ঢাকা শহর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

যে পূর্ববঙ্গের কথা এই লেখায় উল্লিখিত হলো তা আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাতি অর্জন করেছে স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান মহান কবির একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি তাকে বরণ করেছেন গভীর শ্রদ্ধায়, প্রদীপ্ত চেতনায়, জ্ঞানের মাহাত্মে, সাহসের বলিষ্ঠতায়, মননের শাণিত প্রভায় এবং দিব্যলোকের অনিঃশেষ যাত্রায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের প্রফেসর মযহারুল ইসলাম আয়োজন করেছিল। সে সময়ে মহাপরিচালক কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম। তারিখটি ছিল ১৯৭৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘না, না আমি কেন সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়তো যাব? আপনারা আমাদের শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানান। কবি জসীমউদ্দীন আছেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আছেন, তাঁদের কাউকে বলুন। বাংলা একাডেমির সবাই প্রবল আপত্তি জানায়। সবাই চায় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। কারণ তিনি শুধু সরকার প্রধান নন, তিনি একজন শিল্পসাহিত্য বোধের মানুষ। তিনি একজন রবীন্দ্রঅনুরাগী রাজনীতিবিদ। সবার দাবির মুখে তিনি মৃদু হেসে বলে আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাকে সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই।

শেখ মুজিবুর রহমান যে ভালোবাসার কথা বলেছেন তা একজন কবিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা মাত্র নয়, এই ভালোবাসা রাজনৈতিক জ্ঞানের আলোকে নিজেকে আবিষ্কারও। তিনি সংস্কৃতির কবিকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। দু’জন নেতৃস্থানীয় মানুষের এই বন্ধন গণমানুষের জীবনদীক্ষার দিগবলয়। একজন সংস্কৃতির কবি তার সাহিত্যসাধনার ভুবনে দাঁড়িয়ে দু’চোখ ভরে দেখেছেন গণমানুষের জীবন। লিখেছেন তাঁদের কথা। বলেছেন পল্লীর উন্নয়নের কথা। আর একজন রাজনীতির কবি রাষ্ট্রব্যবস্থার অবস্থানে থেকে অবসান ঘটাতে চেয়েছেন জীবনযাপনের অনিয়ম। দু’জনই পূর্ববঙ্গের উর্বর ভূমি শক্তির সন্তান।

SUMMARY

1131-1.jpg