মনের মুকুরে বঙ্গবন্ধু


ফারুক চৌধুরী


পনেরোই আগস্টের বেদনাবিধুর এই দিনে পরম শ্রদ্ধাভরে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি। আমরা গর্ব করে বলতেই পারি যে হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।
পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধ থেকে সরকারি কর্ম ছিল আমার জীবিকা। প্রধানত বিদেশেই ছিল আমার অবস্থান। আমি তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতির আলোড়নমুখর উত্থানপর্বে ছিলাম একজন দূরবর্তী দর্শক। তবে সচেতন দৃষ্টিসীমায় ধরা পড়ছিল যে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু নির্ভয়, অনড় ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এভাবেই তিনি আমার সত্তাকে অধিকার করে নিয়েছিলেন। মনে হতো তিনি আমারও নেতা।
স্বাধীন বাংলাদেশে কর্মসূত্রেই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের এপ্রিলে আমাকে লন্ডনের হাইকমিশনে বদলি করেছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫, এই স্মরণীয় তিনটি বছর আমার অবস্থান বিদেশে হলেও বঙ্গবন্ধু আমাকে বারবার তাঁর কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তা ছিল আমার জীবনের একটি পরম পাওয়া। তাঁকে যতই দেখেছি ততই তাঁর নেতৃত্ব আর কর্মনিষ্ঠা, সর্বোপরি তাঁর অসাধারণ দেশপ্রেম আর অসীম সাহস আমাকে ছুঁয়ে গেছে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ আমি আমার তখনকার কর্মস্থল ইসলামাবাদ থেকে ছুটিতে ঢাকায় ছিলাম। সেদিনই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম, সুদূর এক বিশাল জনসমুদ্রের ওপারে, শুনেছিলাম ‘মুক্তির’ আর ‘সংগ্রামের’ ডাকে তাঁর বজ্রকণ্ঠ।
সেই সংগ্রামের শেষেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম চাক্ষুস পরিচয়, দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সেই প্রসন্ন প্রভাতে, যেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারামুক্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘অন্ধকার থেকে আলোয়’ এই যাত্রা। সেই সময়টিতে কাকতালীয়ভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ একটি সুবৃহৎ প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে দিল্লি সফর করছিলেন। সেই দলে আমিও ছিলাম।

সিদ্ধান্ত হলো যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজাদ আর আমি সরকারের চিফ অব প্রটোকল হিসেবে দিল্লি থেকে ঢাকা যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর সহগামী হব। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু কয়েক ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করবেন। সেখানেই লন্ডন থেকে দিল্লি আসা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ প্রদত্ত ‘কমেট’ বিমানটি পরিত্যাগ করে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বিমান ‘রাজহংসে’ দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরবেন।

কলকাতায় সেই অপরাহ্ণে বঙ্গবন্ধু একটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। পালাম বিমানবন্দরে রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতার পর বঙ্গবন্ধু সেই সকালেই অদূরের ক্যান্টনমেন্টে একটি জনাকীর্ণ জনসভায় আবেগময় ভাষণ প্রদান করলেন। তারপর দিল্লির ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে’ বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা শেষেই আমাদের কলকাতা হয়ে ঢাকা ফেরার কথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: অমিয় তরফদার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: অমিয় তরফদার
রাষ্ট্রপতি ভবনে মুজিব-ইন্দিরা আলোচনা চলছে। আমরা সবাই পাশের একটি বিরাট কামরায় অপেক্ষমাণ। এমন সময় আমার ভারতীয় সহযোগী, চিফ অব প্রটোকল মাহবুব খান ব্যস্তসন্ত্রস্তভাবে আমাকে এসে জানালেন যে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্তে রদবদল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় না গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ প্রদত্ত ‘কমেট’ বিমানেই ঢাকায় যাবেন। কিন্তু আমি যেন দিল্লির ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে নিশ্চিত হয়ে নিই যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে ‘কমেট’ বিমান অবতরণের উপযোগী। আমার সৌভাগ্য যে দিল্লিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভি ছিলেন ষাটের দশকের শুরু থেকেই আমার বিশেষ বন্ধু। ষাটের দশকের প্রারম্ভে আমরা দুজন বেইজিংয়ে কর্মরত ছিলাম। এমনকি আমি ৫ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছার পরের দিনই তিনি অশোক হোটেলে এসে আমার সঙ্গে সূদীর্ঘ সময় বসে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। স্যার টেরেন্স গারভি আমাকে তাৎক্ষণিকভাবেই টেলিফোনে জানালেন যে তাঁরা নিশ্চিত যে ‘কমেট’ বিমান ঢাকায় অবতরণ করতে পারবে। মাহবুব খান আর আমি দুজনে বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তা জানালাম।
দিল্লি থেকে ঢাকার সেই রোমাঞ্চকর যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই ঢাকায় যাওয়ার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ জানলাম। শীতের ছোট বিকেল। কলকাতার জনসভা শেষে ঢাকায় যেতে যদি সন্ধ্যা হয়ে যায়! ঢাকার অনিশ্চিত বিজলিব্যবস্থায় সন্ধ্যার পর সেখানে জনসভা অনুষ্ঠিত করা দুরূহ হবে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম বাংলার জনগণকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে অবশ্যই তিনি কলকাতায় যাবেন। তবে তা দেশে ফেরার পথে কলকাতায় ক্ষণিকের বিরতিতে নয়। অতি শিগগিরই কলকাতায় একটি বিশেষ সফরে যাবেন তিনি। আর মাঝপথে ব্রিটিশ কমেট বদলে রাজহংসে যাওয়া ভদ্রজ​েনাচিত হতো না মোটেও।
কই, আমরা কেউই তো এত কিছু ভাবিনি! চিফ অব প্রটোকল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দায়িত্বের প্রথম প্রহরেই বুঝলাম যে এই জননায়কের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। বুঝলাম যে রাষ্ট্রাচার অন্যান্য বিবেচনাবহির্ভূত নয়। সেই স্মরণীয় যাত্রায় প্লেনে শোনা আরও কিছু কথা মনে থাকবে চিরদিন।
প্লেনে বসে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের কাছে বারবার তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের কুশলাদি জানতে চাইলেন। লক্ষ করলাম, মানুষের নাম মনে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। সব কথার ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর একটি চিন্তা— দেশের মানচিত্র-সংবলিত জাতীয় পতাকা ব্যবহারিক (প্র্যাকটিক্যাল) নয়। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যেই ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২-এ আমাদের লাল-সবুজের পতাকা জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। জাতীয় সংগীত? সুন্দর জনপ্রিয় এই সংগীতের সুরটি যে রক্ত টগবগানো নয়, কিন্তু তবু তা মেনে নিতে হবে। লাখো শহীদের রক্তঝরা এই গানটি। আর সরকার? কেন, সংসদীয়ই তো হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক যাত্রায় আলোচিত সিদ্ধান্তগুলো স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল।
ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ কলকাতা সরকারি সফরের পর, সরকারপ্রধান হিসেবে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। সারা সফরটিতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের ছাপ। সেই সফরে আমাদের চাওয়ার ছিল অনেক, দেওয়ার ছিল অল্প। তবু ব্রেজনেভ, পদ্‌গরনি আর গ্রমিকোর মতো জাঁদরেল সব নেতার মুখোমুখি বঙ্গবন্ধুকে কখনো একটি মুহূর্তের জন্য খাটো মনে হয়নি। বিশ্বাসভরা ছিল তাঁর উক্তি, প্রত্যয়ী ছিল তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ। আর প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর ভাবনায় ছিল বাংলাদেশ।

লেনিনগ্রাদ সফরের বরফঢাকা শীতের সকালে সুবিশাল একটি কবরস্থানে বাংলাদেশের তরফ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহত লাখ লাখ লেনিনগ্রাদবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যত দূর চোখ পড়ে সামনে আমাদের, অজ্ঞাতনামা সহস্র সহস্র কবর। বরফের শুভ্র আবরণে ঢাকা, যেন জমে যাওয়া বরফের ঢেউ। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছেন, পুষ্পস্তবক হাতে সৈনিকদের সঙ্গে। অকস্মাৎ চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার করে ব্রাস ব্যান্ডে বেজে উঠল ‘আমার সোনার বাংলা’। সুন্দর স্মরণীয় সকাল। ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুর উক্তি, ঢাকার সাভারে আমরা সুন্দর করে গড়ে তুলব আমাদের অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্মৃতিসৌধ। আনুষ্ঠানিকতায় ভরা সেই মুহূর্তেও বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সময়েই সাভারের জমি অধিগ্রহণ আর আনুষঙ্গিক কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।

রাশিয়া থেকে ফিরে আসার পরপরই ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফরে এলেন। ভয়ানক কর্মব্যস্ত ছিল তাঁর সফর। সফরের দ্বিতীয় দিনের একটি ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা মনে পড়ে। সফরসূচি বাস্তবায়নের সুবিধার জন্য বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি স্যুইট রাখা হয়েছিল। সেদিনের সফরসূচিতে বঙ্গভবনেই আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার। সেই এক ঘণ্টা সময় ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশ্রামের অবকাশ। লক্ষ করলাম, বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনের দোতলায় তাঁর কামরায় একা বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। সর্বদা জনসাধারণ পরিবেষ্টিত বঙ্গবন্ধুকে একা দেখতে অনভ্যস্ত ছিলাম। জানতাম, সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আছেন তাঁর একতলার অফিসকক্ষে। বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য কি রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে আসতে পারি? খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, ‘তুমি কি ভুলে গেলে, প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসেন না। তবে তাঁর সঙ্গে গল্প-গুজব করার তোমার প্রস্তাবটি উত্তম। চলো, নিচে যাই।’ জাতির পিতার কাছ থেকে চিফ অব প্রটোকলের রাষ্ট্রাচার সম্বন্ধে একটি যথার্থ শিক্ষা!

এর কিছুদিন পর এপ্রিল মাসেই আমি লন্ডনে বদলি হলাম ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্বে। সেই জুলাইতেই স্থির হলো যে তাঁর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচারের জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে আসবেন। তাঁদের লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু আর বেগম মুজিব হবেন ব্রিটিশ সরকারের অতিথি। লন্ডনে অস্ত্রোপচারের বন্দোবস্ত করা ছিল আমাদের জন্য একটি বিরাট দায়িত্ব। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর নুরুল ইসলামের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি এবং চিকিৎসক হিসেবে তাঁর গভীর জ্ঞান আমাদের জন্য ছিল আশ্বাসদায়ক। হিথরো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে সোজা নিয়ে যাওয়া হলো লন্ডনের হারলি স্ট্রিটের ‘লন্ডন ক্লিনিকে’।

বঙ্গবন্ধুর অস্ত্রোপচার করেন বিখ্যাত চিকিৎসক স্যার ফ্রেডরিক মায়ারস। অস্ত্রোপচারের দিন দুই পর্বের একটি ঘটনা। ক্ষীণ কণ্ঠে শারীরিকভাবে দুর্বল বঙ্গবন্ধু বললেন, তাঁকে দেখতে এসে কেউ নাকি বলে গেছেন যে লন্ডনে তাঁর সহগামীরা সব রয়েছেন লন্ডনের দামি অভিজাত হোটেলে। তাঁকে আশ্বাস দিলাম যে কথাটি মোটেও সত্যি নয়। কারণ, লন্ডনের অভিজাত হোটেলের কুলপঞ্জিতে মাউন্ট রয়েল হোটেলের স্থান সাধারণেরই মাঝে। তাঁকে বোঝাতে হলো যে তাঁর সহগামীরা দিনে মাত্র নয়টি পাউন্ড দৈনিক ভাতা গ্রহণ করেন এবং সেই টাকায়ই তাঁরা হোটেলে অাস্তানা গেড়েছেন। আশ্বস্ত বঙ্গবন্ধু। শারীরিক অসুস্থতার মাঝেও তাঁর চিন্তা, সরকারি অর্থের যেন অপচয় না হয়। সেই সময়েই বঙ্গবন্ধুকে একদিন দেখতে এলেন খ্যাতনামা টেলি সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। বঙ্গবন্ধুর জন্য উপহার হিসেবে ডেভিড ফ্রস্ট নিয়ে এলেন ফ্রান্সিস বেকনের প্রবন্ধ সংকলনের দুর্লভ ও মূল্যবান দ্বিতীয় সংস্করণ। ‘আমি বিনিময়ে কী দিতে পারি আপনাকে?’ বঙ্গবন্ধুর জিজ্ঞাসা। তারপর তাঁর বুক পকেট থেকে বের করলেন তাঁর কলম। ফ্রস্টের হাতে তা তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই সামান্য আমার উপহার; এটা দিয়ে আপনি লিখুন আমার দরিদ্র মানুষের কথা।’ ডেভিড ফ্রস্টকে দেখে মনে হলো, তিনি সামলে রাখছেন মহামূল্যবান কোনো সম্পদ। অসুস্থতার মাঝেও বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় বাংলাদেশের মানুষ।

..
.
নীরবতা ভাঙলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, ‘ভেবে দেখো, সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশ। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ।’ কানাডার অরণ্যরাজির মাঝেও তাঁর চোখে ভাসছে বাংলাদেশের জনঅরণ্য। তাঁর চিন্তায় সর্বক্ষণ বাংলাদেশ।
অপারেশনের পর বঙ্গবন্ধু প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন জেনেভা শহরের অনতিদূরে ‘লা রিজার্ভ’ হোটেলের প্রীতিপদ পরিবেশে সুইজারল্যান্ড সরকারের অতিথি হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা, জেনেভায় অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে পররাষ্ট্রবিষয়ক একজন আমলা থাকবেন। আদেশ হলো, জেনেভায় আমিই হব সেই আমলা। জেনেভায় কর্মব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ‘লা রিজার্ভ’ হোটেল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরই একটি অংশে পরিণত হলো।

পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা ইকবাল আতহার। ইকবাল আতহার ছিলেন বাংলাদেশের সমর্থক। আমাদের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন।

পরে তিনি ছিলেন ইতালিতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত। জেনেভায় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইকবাল আতহার বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর মিসর সফরের রিপোর্ট পেশ করছিলেন। আমিও কাগজ-কলম হাতে উপস্থিত, আমার নোট নেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে। ইকবাল আতহার বললেন, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বঙ্গবন্ধুকে জেনেভা থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে মিসর সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সফরকালেই মিসর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করবে। বঙ্গবন্ধু তাকালেন আমার দিকে। ‘এ বিষয়ে তোমার বক্তব্য কী?’ প্রধানমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা। বললাম, ‘স্যার, স্বীকৃতি চাইতে আপনি কোনো দেশেই যাননি। মিসরের বেলায় কেন তার ব্যতিক্রম হবে? স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দায়িত্ব মিসরের।’ আমার বক্তব্যে ইকবাল আতহারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনি আমার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘মুজিব ভাই, আমি যখন রাষ্ট্রদূত, এরা ছিল তৃতীয় সচিব। আজ তারা যেন সবজান্তা!’ বিস্মিত বঙ্গবন্ধু। অপ্রতিভ আমি। সবিনয়ে বললাম, ‘স্যার, প্রধানমন্ত্রী যখন আমার অভিমত চেয়েছেন, আমি তা নির্ভয়েই ব্যক্ত করব।’ পাইপ হাতে হাজির বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা ধন্যবাদ, এখন তুমি যেতে পারো।’ বঙ্গবন্ধুর স্যুইটের পাশেই আমার কামরা। ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে ভাবছি, আমার এত কথা বলার ছিল কি কোনো প্রয়োজন? মিনিট পনেরো পরে দরজায় টোকা পড়ল। ডেকে পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মৃদু হেসে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। ‘তোমার সঙ্গে আমি একমত।’ শরীরের অবস্থা উল্লেখ করে এখন মিসরে যাওয়ার অপারগতাই জানাতে বলেছি ইকবাল আতহারকে। তিনি তোমার বয়োজ্যেষ্ঠ। তাই এ কথাটি তাঁকে বলার আগে তোমাকে চলে যেতে বললাম। তাঁর সহকর্মীদের অনুভূতির প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন সদা সচেতন।

আগস্ট ১৯৭৩। অটোয়াতে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করল। ১৯৭২ সালে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াকুবু গওন আমাদের কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভের বিরোধী ছিলেন। তাঁর তখন ছিল নাইজেরিয়ার একটি অংশ বিয়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্যা। তিনি তাই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বিয়াফ্রার সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে বলে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল তখন ছিলেন কানাডার আর্নল্ড স্মিথ। লন্ডনে আমার সেই সময়কার একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সঙ্গে নিবিষ্ট সম্পর্ক রাখা। মনে আছে, কমনওয়েলথ সম্মেলনে আমাদের যোগদান পাকাপোক্ত করতে এই ইয়াকুবু গওনের কারণেই যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

সেই ইয়াকুবু গওনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মুখোমুখি দেখা অটোয়াতে কমনওয়েলথ সাংবাদিক প্রদত্ত একটি অভ্যর্থনা সভায়। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট আর চাদর পরিহিত বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই অভ্যর্থনা সভার সবচেয়ে দৃষ্টিকাড়া রাষ্ট্রনায়ক। তাঁকে ঘিরে অনেক বিদেশি সাংবাদিক। হঠাৎ দেখলাম, তিন পিস ধোপদুরস্ত স্যুট পরিহিত জেনারেল ইয়াকুবু গওন এগিয়ে আসছেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। পেছনে তাঁর সামরিক পোশাকে ভীমকায় এক সহচর। বঙ্গবন্ধুর পেছনে কম্পিত হৃদয়ে বেসামরিক বঙ্গসন্তান আমি। সম্ভাষণ জানালেন ইয়াকুবু গওন বঙ্গবন্ধুকে। তারপর অপ্রত্যাশিত তাঁর একটি প্রশ্ন। বললেন, ‘আচ্ছা প্রধানমন্ত্রী, বলুন তো, অবিভক্ত পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী দেশ! কেন আপনি সেই দেশটিকে ভেঙে দিতে গেলেন?’

অবাক আমরা সেই প্রশ্নে। অবাক চারপাশের সাংবাদিকেরা। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। হো হো করে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে নীরবতা ভাঙলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর তর্জনী সংকেতে বললেন, ‘শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনার কথাই হয়তো ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল, তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তো হতো অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হয়তো হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া, আর মহাশক্তিশালী হতো এক জোট এই বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?’ কথাটি বলেই তাঁর গলার সাদা চাদরটি হাতে নিলেন বঙ্গবন্ধু। তুলে দিলেন হতবাক প্রেসিডেন্ট গওনের হাতে। বললেন, ‘এই নিন বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে আমার এই ক্ষুদ্র উপহার। ভীমকায় সেই সামরিক কর্মকর্তাটি চাদরটি তুলে নিলেন বিস্মিত তাঁর প্রেসিডেন্টের হাত থেকে। সেই সন্ধ্যায় বাগ্‌যুদ্ধে কে ছিলেন জয়ী, উপস্থিত সাংবাদিকদের মনে ছিল না সন্দেহের কোনো অবকাশ।

মনে পড়ে অটোয়ায় গ্রীষ্মের সুদীর্ঘ এক অপরাহ্নে গাড়িতে করে কিছুক্ষণের জন্য হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। অটোয়া শহরের উপকণ্ঠের সুবিশাল অরণ্যরাজির মাঝ দিয়ে জনমানব আর যানবাহনহীন মসৃণ পথে দ্রুতবেগে চলছি আমরা। ঘন পল্লবিত গ্রীষ্মের তরুরাজির ওপর পড়ন্ত রোদের আবরণ। আলো-ছায়ার মাখামাখি। নীরবতা ভাঙলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, ‘ভেবে দেখো, সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশ। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ।’ কানাডার অরণ্যরাজির মাঝেও তাঁর চোখে ভাসছে বাংলাদেশের জনঅরণ্য। তাঁর চিন্তায় সর্বক্ষণ বাংলাদেশ।

সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ দেবেন বাংলায়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে উচ্চারিত হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা। ঢাকায় বসেই গভীর মনোযোগে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতার খসড়া পড়লেন। বললেন, ‘ভালোই ফরেন অফিসের বক্তৃতা, কিন্তু আসল কথাই তো তোমরা লেখ নাই। দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা বিরাজ করছে। সেই কথাটি তো আমি জাতিসংঘে বলবার চাই। বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিশ্ববাসী আমার মুখ থেকেই শুনুক। তোমাদের সংশয় কেন?’ বঙ্গবন্ধু কথাটি জাতিসংঘে দ্বিধাহীনভাবে তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন।

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ নিউইয়র্কের জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় প্রদত্ত বক্তৃতার অনুবাদ যুগপৎভাবে ইন্টারপ্রিটারের বুথ থেকে পাঠ করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হলো। আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সঠিকভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারব তো? অভয় দিলেন বঙ্গবন্ধু। হোটেলে তাঁর কামরায় বার তিনেক রিহার্সেল দিলাম বঙ্গবন্ধুর স‌েঙ্গ। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সিংহভাগ মানুষ তো তোমার ইংরাজি অনুবাদই শুনবে। অতএব বক্তৃতা পড়ার সময় তুমি নিজেকেই প্রধানমন্ত্রী ভাববে।’ তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘অবশ্য তা কেবল বক্তৃতা পড়াকালীন সময়ের জন্য!’ দিন শেষে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘শাবাশ, শুনেছি ভালোই হয়েছে তোমার বক্তৃতা!’ আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এর চেয়ে স্বস্তিদায়ক প্রশংসা কোনো দিন পাইনি।

১৯৭৫-এর মে মাসে জ্যামাইকার কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলন ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মবহুল জীবনের অন্তিম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেই সম্মেলনের যুগ্ম ইশতেহারের ১৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে একটি ঘোষণা। তাতে বলা হয়েছে যে ‘কিছু অমীমাংসিত সমস্যার জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে, শ্লথ হয়েছে জাতীয় পুনর্গঠনের গতি। তার মাঝে রয়েছে মানুষের স্বদেশ প্রেরণ ও সম্পত্তির বাঁটোয়ারা। এই ঘোষণায় কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানেরা আশা করেন যে ‘সংশ্লিষ্ট দেশগুলো’র মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যাবলির সমাধান ঘটবে।

এ ধরনের প্রস্তাব পাস করানোই ছিল আমাদের অভিপ্রায়। যদিও পাকিস্তান তখন কমনওয়েলথের সদস্য ছিল না, তারা আমাদের এ ধরনের প্রস্তাব পাস করানোর বিরুদ্ধে লবিং করার জন্য কানাডায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইফতেখার আলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। আমরা তা বঙ্গবন্ধুকে অবগত করলাম।

সেই দিনটি ছিল শুক্রবার ২ মে ১৯৭৫। কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের একটি রেওয়াজ আছে যে সম্মেলন চলাকালীন সপ্তাহ শেষে শুধু সরকারপ্রধানরা একটি ‘রিসোর্টে’ চলে যান, আমলাবিহীন রাষ্ট্রনায়কেরা সেই দুটি দিন তাঁদের মাঝে করেন খোলাখুলি আলোচনা। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন যে পাকিস্তানিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা সম্বন্ধে অন্যান্য সরকারপ্রধান, বিশেষ করে স্বাগতিক দেশের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি আর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে নিজেই কথা করবেন। আমাদের আমলাদের এ বিষয়ে আর করণীয় কিছু নেই।

সোমবার ৫ মে ১৯৭৫-এর সকালেই বঙ্গবন্ধু আমাদের জানালেন যে তিনি প্রস্তাবটির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। বললেন, ‘এ বিষয়ে আমি মাইকেল আর হ্যারল্ডের সঙ্গে কথা বলেছি।’ তারপর চোখ টিপে বললেন, ‘সব ঠিক আছে।’

সেই দিন সকালের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দিলেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ভুট্টোর সফর সম্পর্কে তিনি অন্য সরকারপ্রধানদের জ্ঞাত করলেন। তারপর জোর আশা প্রকাশ করলেন যে কমনওয়েলথের সরকারপ্রধানগণ পাকিস্তানিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং দুই দেশের মাঝে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা বিষয়ে তাঁদের চিন্তা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যক্ত করবেন। বঙ্গবন্ধুর উক্তির সঙ্গেই স্বাগতিক দেশ জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি বললেন যে তাঁর মতে যুগ্ম ইশতেহারে বাংলাদেশের বক্তব্যটি ব্যক্ত হওয়া উচিত। তার পরপরই বক্তব্য দিলেন হ্যারল্ড উইলসন। তিনি বললেন যে বাংলাদেশের দাবি ব্রিটেন সর্বান্তকরণে সমর্থন করে। তাঁর ভাষায়, ‘ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে দুই জাতিতে পরিণত একটি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পত্তির যথাযথ বাঁটোয়ারা হয়নি।’

বাদ সাধলেন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়রেরে। তাঁর বক্তব্য, তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে কমনওয়েলথ একটি ক্লাব। পাকিস্তান তার সদস্য নয়। অতএব, ক্লাবটির কি উচিত হবে সেই দেশকে জড়িয়ে প্রস্তাব পাস করা? আমাদের উৎকণ্ঠা, বঙ্গবন্ধু এখন কী বলবেন জুলিয়াস নায়রেরের জবাবে? চোখ থেকে তাঁর কালো ফ্রেমের চশমাটি অপসারণ করলেন বঙ্গবন্ধু। স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন নায়রেরের দিকে।

তারপর বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ জুলিয়াস, কমনওয়েলথ একটি ক্লাব। কিন্তু আমি সেই ক্লাবেরই একজন সদস্য। অন্য সদস্যকে যদি সামান্য একটি প্রস্তাব পাস করে আমাকে সাহায্য না করেন, তাহলে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার কী-ই বা ছিল প্রয়োজন? একটা দরিদ্র দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আমি। তবু আমি অর্ধেক পৃথিবী পেরিয়ে এসেছি এই সম্মেলনে।’ অখণ্ডনীয় যুক্তি। হতবাক নায়রেরে। হাত তুলে বললেন, ‘ঠিক আছে মুজিব। তুমি যা চাও তাই হবে।’

এই প্রস্তাবটি পাসের এক শ দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারবর্গকে হত্যা করা হলো। তবে এটাই ধ্রুব সত্য যে বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই। তিনি অমর।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির নির্মাতা ছিলেন। এই নিবন্ধটি তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনা অথবা পররাষ্ট্রনীতির ওপর আলোচনার কোনো প্রচেষ্টা নয়। এই নিবন্ধটির লক্ষ্য কাছ থেকে দেখা, স্মৃতিতে সঞ্চিত কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনার মাঝ দিয়ে একটি সত্য তুলে ধরা। তা হলো যে সাধারণ প্রত্যাহিকতার মাঝেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ, একজন বিরল ব্যক্তিত্ব।

SUMMARY

113-1.gif

লেখককে নির্দেশ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, লন্ডন ১৯৭২