বাংলাদেশের কবিতা ও রাজনৈতিক চেতনায় ৭ মার্চ


মিল্টন বিশ্বাস

তাই মনে হয়, বাংলাদেশের সকল মানুষ, শ্রেণি ও মতাদর্শকে এক সূত্রে গাঁথা হয়তো কেবল মুজিবের মতো রাজনৈতিক কবির পক্ষেই সম্ভব।’ বেলাল চৌধুরী বলেছেন, কবিতা একটি জাতির ভাষার স্মৃতি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতায় বাঙালি জাতির ভাষার স্মৃতি উচ্চকিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো মহাপুরুষকে নিয়ে রচিত কবিতায় কবি সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য। কারণ কবিতার মাধ্যমে কবি একাত্মতার বাণী প্রচার করেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার এই বাণী অসংখ্য কবির অজস্র চরণে কখনো শেখ মুজিব, কখনো বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

কবিতায় বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথম উচ্চারিত হয় নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। তার একাধিক কবিতা কিংবা বলা চলে সবচেয়ে বেশি কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে। কবির ‘মুজিবমঙ্গল’ কাব্যে সংকলিত উল্লেখযোগ্য কবিতা হলোÑ ‘প্রচ্ছদের জন্য: শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘হুলিয়া’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদ-’, ‘নেড়ী কুত্তার দেশে’, ‘আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা: ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ প্রভৃতি। মুজিবকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর প্রথম তিনি কবিতা লেখেন ‘প্রচ্ছদের জন্য’ (পরে এটি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থে ‘স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়’ নামে অন্তর্ভুক্ত); তখন শেখ মুজিব কারাবন্দি। ১৯৬৯ সালে রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ তাকে নায়কের আসন দান করেন। যাকে কেন্দ্র করে বাংলার স্বপ্ন ও আশা-আকাক্সক্ষা আবর্তিত হচ্ছিল তখন। মূলত ১৯৬৭-৬৮ সালে গণ-আন্দোলন যখন সামান্য ভাটা পড়েছে, রাজনৈতিক মহলে বঙ্গবন্ধুর একলা চলার নীতি নিয়ে যখন নানা রকম দোলাচল ও বিভ্রান্তি, ঠিক সেই সময় ‘হুলিয়া’ কবিতায় তিনি লেখেনÑ ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর

Ñ আমাদের ভবিষ্যৎ কী?  আইয়ুব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করছেন? আমার নামে কতদিন আর এ রকম হুলিয়া ঝুলবে? (কাব্যসমগ্র-১, ২০১১: ২৭)

এ সম্পর্কে কবি লিখেছেনÑ ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম ১৯৬৭ সালে, যখন তার নাম ছিল শুধুই শেখ মুজিবুর রহমান। খুব সম্ভবত ঐটি ছিল তাকে নিয়ে রচিত প্রথম কবিতা। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে প্রথম কবিতাটি আমার পক্ষে লেখাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। কেননা আমার কবিতা তো তাকে অনুসরণ করে এসেছে অনেক আগে থেকেই। তিনি ছিলেন আমার কাব্যের এক প্রধান চরিত্র। দোষে-গুণে মিলে তিনি ছিলেন আমার কবিতার নায়ক। ফলে, নির্মম হত্যাকা-ের ভিতর দিয়ে তার জীবনাবসানের পর তাকে নিয়ে প্রথম তো আমারই কবিতা লেখার কথা। এটা ছিল ইতিহাস নির্ধারিত।’ তিনি এর পরই জানিয়েছেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাল্যসুহৃদ মৌলবী শেখ হালিম, আরবি ভাষায়। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ কবরস্থ করার পর বাড়ি ফিরে তিনি যা লিখেছিলেন তার বাংলা এ রকম-

হে মহান, যার অস্থি-মজ্জা, চর্বি ও মাংস এই কবরে প্রোথিত

যাঁর আলোতে সারা হিন্দুস্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশ আলোকিত হয়েছিলÑআমি আমার নিজেকে তোমার কবরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিতেছি, যে তুমি কবরে শায়িত

আমি তোমার মধ্যে তিনটি গুণের সমাবেশ দেখেছি, ক্ষমা, দয়া ও দানশীলতা- নিশ্চয়ই তুমি জগতে বিশ্বের উৎপীড়িত এবং নিপীড়িতদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলে

সেইহেতু অত্যাচারীরা তোমাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেÑ

আমি/আমরা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে তাদের বিচারের প্রার্থনা জানাই, যারা তোমাকে বিনা-বিচারে হত্যা করেছে।

আমরা মহান আল্লাহর নিকট তোমার আখিরাতের মঙ্গল কামনা করি। বিদায়! বিদায়! বিদায়! হে মহান জাতির জনক। (কবিতায় বঙ্গবন্ধু, ২০১২: ৬০) নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তার প্রশস্তিমূলক কবিতা রচনা করেননি; এমনকি ‘বাকশাল’ গঠনকে মেনে নিতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আহত হৃদয়ে পঙক্তির পর পঙক্তি রচনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রথম বাংলা ভাষার কবিতাটি লিখেছিলেন তিনিই। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবৃতিÑ ‘এ কথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অনেকদিন চলে গিয়েছিল, দেশের ভিতরে কোথাও প্রকাশ্যে কেউ তার নাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। এ ব্যাপারে সামরিক শাসকদের কোনো বিধি-নিষেধ আরওপিত না থাকলেও, তাদের আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া অলিখিত বিধি-নিষেধ দেশের মানুষের মধ্যে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছিল। যার ফলে ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রবল প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কোনো কবিতা পাঠ করার সাহস অর্জন করতে পারিনি। ১৯৭৬ সালে আমি একুশের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে পড়েছিলাম ‘ভয় নেই’ নামের একটি কবিতা। ‘৭৫ এর নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের পর যে ভয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার চাপ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করাটাই ছিল ওই কবিতার উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে নিজেকেও ভয়ের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা।

১৯৭৭-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি যে কবিতাটি পাঠ করি (আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি) সেটি আমি লিখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। দু-একটি অনুষ্ঠানে ওই কবিতাটি পাঠ করবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ওইসব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আমাকে তখন ওই কবিতা পাঠ করার অনুমতি দেননি। আমিও কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের কোনো সাংস্কৃতিক অঙ্গ-সংগঠনকে তাদের অজ্ঞাতসারে কবিতাটি পাঠ করে বিপদে ফেলতে চাইনি। ফলে, কবিতাটি প্রকাশ্যে পাঠ করার জন্য আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে কাটাতে হয়। তারপর ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে জন্মগ্রহণ করা, জনগণের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে একুশের ভোরের কবিতা পাঠের আসরে আমি ওই কবিতাটি পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিই এবং অনুষ্ঠানে সমবেত সকলকে চমকে দিয়ে আমি ওই কবিতাটি পাঠ করি। কবিতা পাঠান্তে আমার বুকের মধ্যে চেপে বসা একটি পাথর অপসারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং পরবর্তীকালের বঙ্গ-শাসকদের প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ যে, তারা আজ পর্যন্ত ওই কবিতা রচনা এবং পাঠের জন্য আমাকে কোনোরূপ দ- প্রদান করেননি। ওই কবিতা পাঠের পর পুলিশ আমাকে কিছুদিন নাজেহাল করেছিল বটে, কিন্তু তা আমার জন্য এমন অপ্রীতিমূলক কিছু ছিল না। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই তা ছিল সীমাবদ্ধ।’

এই কবিতার জন্য ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র কবিকে অপমান করে। তাদের একজন তাকে ‘বেঈমান’ বলে গালি দিয়েছিল। সে সময় নিউমার্কেটের মাংস বিক্রেতা বলেছিল, ‘স্যার কিছু মনে করবেন না, বুঝছি আপনে শেখেরে নিয়া কিছু লিখছেন, তাই ওগো রাগ অইছে। ও অইছে হেইদিনের ছেমড়া, হে বঙ্গবন্ধুর মূল্য বুঝব কেমতে?’ কবি এই ঘটনা উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মধ্যে কত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা কিংবা পরবর্তী স্বৈরশাসকরা যেখানে জাতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বেঈমানি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল সেখানে কিশোরদের চেতনায় এ ধরনের বিশ্বাস ঢুকে পড়েছিল কিভাবে এটাই বিস্ময়কর। কারণ বঙ্গবন্ধু কোনো দুর্নীতি করেননি এবং ভারতের কাছে দেশকে বিক্রি করে দেবার অভিযোগও ছিল না তার বিরুদ্ধে। তাহলে অপপ্রচার ছিল ভয়াবহ। সেই বিরুদ্ধশক্তির অপপ্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি। বরং কবিদের রচনা ও মননশীল লেখকদের বিশ্লেষণ বঙ্গবন্ধুকে আরও বিস্তৃত করেছিল জনগণের মধ্যে। বিশিষ্ট কথাকাররা কবিতা লিখেছেন তাকে নিয়ে। যেমন, মনীশ ঘটকের ‘সূর্যপ্রণাম’, শওকত ওসমানের ‘১৫ আগস্টের এলিজি’, মাহমুদুল হকের ‘বকুলগন্ধ বাঘের চোখে’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ (যেখানে মুজিব ও রাসেলকে কেন্দ্র করে একটি মর্মন্তুদ কবিতা লেখা হয়েছে)। মূলত পঁচাত্তর পরবর্তী কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের আবেগ শতধারায় উৎসারিত হয়েছে এভাবে-

সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,

রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল

আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।

আমি তার কথা বলতে এসেছি। (আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি, কাব্যসমগ্র-১, ২০১১: ২৬২)। (চলবে-৩)

লেখক:  অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদনা: আশিক রহমান

SUMMARY

1129-1.png