শান্তিনিকেতনের এক সময়ের শিক্ষার্থী ও সাহিত্যিক-সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীকে মুক্তির পরে এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে আমি ভালোবাসি তার মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য। সঞ্চয়িতা-সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। সব মিলিয়ে এগারো বছর কাটিয়েছি জেলে। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়ানওয়ালি জেলের ন’মাস সঞ্চয়িতা সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি। আমার একটি প্রিয় গানকেই ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি।
বাঙালীর স্বভাবে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তার সরলতা, তার কল্পনাবৃত্তি, নতুনকে চিনে নেয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টি, রূপসৃষ্টির নৈপুণ্য, অপরিচিত সংস্কৃতির দানকে গ্রহণ করার সহজ শক্তি, এই সকল ক্ষমতাকে ভাবের পথ থেকে কাজের পথে প্রবৃত্ত করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্র গুণমুগ্ধ শেখ মুজিব। আর এই মুজিবের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মস্থান হিসেবে পরিচিত পূর্ব বাংলায়। পাকিস্তান যুগে যেখানে তার প্রবেশাধিকারকে সঙ্কুচিত এবং বিজাতীয় বলে অবজ্ঞা করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রদেশের নাম পূর্ববঙ্গ বহাল থাকলেও বঙ্গভাষার ব্যবহার রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পাওয়ার পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত ও সাবধানী হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক মিল ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে নানা ছক কাটা শুরু করে। স্কুলের পাঠ্যবইগুলোয় বিশেষ বদল হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথের লেখা গেল কমে। ‘উড়াও উড়াও কওমী নিশান’, ‘ভাঙ্গিল জিন্দান টুটিল জিঞ্জির’, ‘কলিজানের খুনে ওয়াতানের ধূলি, ‘আরব ইরান তুর্কী মিসর, কণ্ঠে আমার পায় খুঁজে স্বর’ ইত্যাদি কাব্যের বিস্তার ঘটতে থাকে। বাংলাভাষাকে বিকৃত করা শুরু হয়। বাঙালী শিক্ষিতজনদের আশরাফ ভাবাপন্নরা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি অধিক প্রয়োজনীয় বলে রব তুলতে থাকেন। বাংলাভাষী মুসলমানকে বাঙালী বলতেও কুণ্ঠাবোধ হতো তাদের। সৈয়দ আলী আহসান তো লিখলেনই ‘মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল স্বাতন্ত্র্যবোধের ওপর ভিত্তি করে। এই স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় মিলবে আমাদের সাহিত্যে ও কাব্যে। ... নতুন রাষ্ট্রের স্থিতি প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজব। সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং হয়তবা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশি।’ষাটের দশক ছিল রবীন্দ্রনাথ থাকবেন কি থাকবেন না প্রশ্নের সংগ্রাম। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে ঢাকায় আগত পাকিস্তানের বিরোধী নেতাদের সম্মানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরোধে সান্জিদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির পুরোটাই গেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার গান, কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ নিয়ে। শেখ মুজিব নিজেও গুনগুন করে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। বঙ্গবন্ধুর জনসভায় রবীন্দ্রনাথের গানও পরিবেশিত হতো। বাঁধা গায়ক ছিলেন সুপুরুষ শিল্পী জাহিদুর রহিম।
১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। পাকিস্তান সংসদে সে সময়ের তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নবাববংশের খাজা শাহাবুদ্দিন বললেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। ক্ষোভ বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা বাংলাভাষীর জন্য। কারণ বাঙালী সংস্কৃতির ওপর এ যেন মারণাঘাত। রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা বাঙালীমাত্রই অবহিত। জন্ম শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এমনিতেই সাধারণের মধ্যে সর্বপ্রথম একটি জীবন্ত সত্তায় পরিণত হন। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে একটি শক্তি পাকিস্তানী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিতর্ক শুরু করে। সংবাদপত্রগুলোয় এর প্রকাশ দেখা যায়। এমনটিও পত্রিকায় লেখা হয় যে, ‘রবীন্দ্রনাথের দোহাই পাড়িয়া অখ- বাংলার আড়ালে আমাদের তমদ্দুনিক জীবনের বিপদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেয়া চলিবে না।’ ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির ঘোষণা পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ‘রেডিও ও টেলিভিশন থেকে পাকিস্তানবিরোধী রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে রবীন্দ্রনাথের অন্য গানের প্রচারও হ্রাস করা হবে’ খাজা শাহাবুদ্দিনের এ ঘোষণা প্রগতিশীল রাজনীতিক ও সংস্কৃতিমনাদের ক্ষুব্ধ করে। প্রতিবাদ সভা, বিবৃতি দান, পথসভা, মিছিল চলতে থাকে। তবে একই সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানী শাসকের ঘোষণাকে প্রশংসিত করে ও রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে একদল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী অপ তৎপরতা চালায়। ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই ‘পয়গাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত তিরিশ মাওলানার বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘রবীন্দ্রনাথের বহু সঙ্গীত মুসলিম তমদ্দুনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতি (ও যৌন ভোগলালসার) জয়গান গাহিয়াছে। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও-টেলিভিশনকে পবিত্র রাখার প্রয়োজন ছিল।’ রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগসহ ন্যাপ। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুমধুর আবেদনকে কোন কালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’ ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপীয়ার; এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা; যিনি একজন বাঙালী কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি নাÑ আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হইবেই।’ তিনি রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর থেকে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে রেডিও-টিভিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারেরও দাবি জানান।
রবীন্দ্র বিরোধিতা পাকিস্তানি আমলেই এ দেশে রবীন্দ্রনাথকে আরো বেশি শক্তিশালী করেছে। বাঙালির জীবনে ও চেতনায় কবি আরও বেশি অবিভাজ্য হয়ে উঠেছিলেন। সত্তর সালের গোড়ায় বঙ্গবন্ধু জাহিদুর রহিমকে দায়িত্ব দেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্য। কলিম শরাফী তখন ই এম আই গ্রামোফোন কোম্পানির ঢাকার কর্ণধার। ১৯৬৯ ও ৭০ সালের মধ্যে এই কোম্পানি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের দুইশ’ গান রেকর্ডে ধারণ করে। প্রথম ১২টি গানের একটা গুচ্ছ গেয়েছিলেন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, রাখী চক্রবর্তী, আফসারি খানম, বিলকিস নাসিরউদ্দিন ও কলিম শরাফী। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশে ছায়ানটের শিল্পীরাও এগিয়ে আসেন। কলিম শরাফীর ব্যবস্থাপনায়, আবদুল আহাদের পরিচালনায়, সনজীদা খাতুনের বাসায় তাঁরই যত্ম-আত্তিতে খাটুনিতে তৈরি হয় গানটি। সম্মেলক কণ্ঠে ছিলেন, জাহিদুর রহিম, অজিত রায়, ইকবাল আহমদ, ফাহমিদা খাতুন, জাহানারা ইসলাম, হামিদা আতিক, নাসরীন আহমদ প্রমুখ। সর্বত্র বাজতে থাকে এই রেকর্ড। অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের কণ্ঠে এই গান ধ্বনিত হতো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী কলিম শরাফী রমনা রেসকোর্সে লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্রসংগীতের এক সেট গানের রেকর্ড উপহার দিয়েছিলেন সাড়ে সাতকোটি মানুষের বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।
৭০ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে দিকে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই ভবিতব্য বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে জনগণ ‘আমার সোনার বাংলা’কে নির্বাচন করেছিল। আর এই গ্রহণের ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সোনার বাংলা গানটি পূর্ববাংলার শিল্পীরা যে সুরে গাইতেন বা এখনও গাওয়া হয়, তা স্বরবিতানে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর ছাপা স্বরলিপির সুরের অনুসরণ নয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এইচ এম ভি প্রথম ‘আমার সোনার বাংলা (নম্বর-২৭৭৯০) গানের রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর পিঠে ছিল ‘সার্থক জনম আমার’। গেয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র।
শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন এই গানের ট্রেনার। ফলে স্বরবিতানের সুর থেকে এই সুরটি আরও বেশি বাউলাঙ্গ হয়ে পড়ে। এই সুরেই ফাহমিদা খাতুন ষাটের দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। তারা সুচিত্রা মিত্রের রেকর্ড থেকেই গানটি তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি এতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ‘তখন বহু জায়গায় তা অশুদ্ধ উচ্চারণে ও ভুল সুরে কিন্তু সত্যিকার আবেগ দিয়ে গাওয়া হত। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে গৃহীত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু শোনেন যে, স্বরবিতানের ছাপানো সুরের সঙ্গে আমাদের শিল্পীদের গাওয়া সুরের মিল নেই। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যে সুর গেয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সুরেই আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, সেটিই জাতীয় সংগীতের সুর।’ বঙ্গবন্ধুর নিদের্শে কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। দায়িত্ব দেন শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র রবীন্দ্র স্নেহধন্য শিল্পী আবদুল আহাদকে। বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের সভায় উপস্থিত হয়ে তারা জানালেন, ‘আমার সোনার বাংলা গানটি স্বরলিপি বইয়ে যেভাবে ছাপা আছে, সেটা আমরা গাই না। যে সুরটি প্রথম খুব সম্ভব সুচিত্রা মিত্র শিখেছিল ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে এবং রেকর্ডও করেছিল—বাংলাদেশের দরকার সেই সুরটির স্বরলিপি। শান্তিদেব ঘোষ যিনি রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের ট্রেনারছিলেন, সভায় তিনিও ছিলেন। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত জানালো বিশ্বভারতী যে, তারা স্বরলিপি তৈরি করে বাংলাদেশের সরকারকে কিছুদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন। যথারীতি বিশ্বভারতী স্বরলিপি ছাপিয়ে পাঠিয়েছিলেন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ২৫ মার্চ রাতে যে গোলাবর্ষণ হয়েছিল, তাতে সঞ্চয়িতাও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থের সংগ্রহ পাকবাহিনী লুটপাট করে নিয়ে যায়, এমনকি গ্রামোফোন যন্ত্র। তাই রেকর্ড হাতে আক্ষেপ করে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন অমিতাভ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে, ‘হায়রে কপাল, ও তো জানেও না যে, বাড়িতে গ্রামোফোন নাই।’ রবীন্দ্রনাথের প্রচুর কবিতা বঙ্গবন্ধুর মুখস্থ ছিল। কবিতা তাকে প্রেরণা যোগাতো। পাকিস্তানী কারাগারে নয়মাসের বন্দীজীবনে রবীন্দ্র কবিতা আওড়াতেন, ছিল যা মুখস্থ।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে। বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই জাতিকেই আবিষ্কার করেন সোনার বাংলায়। এনে দেন আত্মমর্যাদা, স্বাধীন সত্তা। এই বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’। আর বঙ্গবন্ধু তা একটি জাতির জাতীয় সঙ্গীতে রূপান্তর করে, চিরস্থায়ী করে দেন।
কিন্তু দু’টি শক্তি এখনো মুখোমুখি। একটি শক্তি সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ হিংসার দর্শন দ্বারা পরিচালিত। অপরটি ভাষা আন্দোলনের পধ ধরে যে অসাম্প্রদায়িক, মননশীল, উদার মানবিকতার বিকাশ ঘটেছে তার পক্ষে। যদিও বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে ধর্মীয় জাতীয়তাবোধকে বর্জন করে। বাংলাদেশে প্রকাশ্য রবীন্দ্রবিরোধিতা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর। সেই সঙ্গে বিতর্কিত করা হয় বাঙালি জাতীয়তাবোধকে। তাই আজও অগাস্ট মাসে শোক দিবস আসে, ২২ শ্রাবণ যায়, রবীন্দ্রনাথ হয়ত চমকে ওঠেন পুনরায় উৎক্ষেপণের ভয়ে। কিন্তু যে প্রজ্ঞায় ভালবাসায় শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার উৎপাটন আর সম্ভব বলে মনে হয় না।