ফকির ইলিয়াস
শিল্পে-সাহিত্যে-চিত্রকর্মে-সংস্কৃতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য নাম। যে মানুষটির জন্ম না হলে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভব হতো না, তিনি জাগরূক থাকছেন এ প্রজন্মের মননে। তার ৭ই মার্চের ভাষণকে আজ বিশ্বের রাজনীতি বিশ্লেষক, কবি-সাহিত্যিকরা বলছেন সেরা পঙ্ক্তিমালা। বিশেষ করে কবিতায় বঙ্গবন্ধু স্থান করে নিয়েছেন একটি অতি উচ্চ আসন। বলা হয়ে থাকে, তিনিই বিশ্বের একমাত্র মানুষ, যাকে নিয়ে লেখা হয়েছে সবচেয়ে বেশি কবিতা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিলেন এ কবিতাটি। এ সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, “যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি, তার সবে আরম্ভ। যুদ্ধে হেরে গেলে পাকিস্তানিরা কি শেখ সাহেবকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে দেবে? প্রতিশোধ নেবে না? এর মাস চার-পাঁচ আগে থেকেই তার প্রাণ রক্ষার জন্যে আবেদন বিশ্বময় ধ্বনিত হয়েছিল। তার জন্যে কলকাতার ময়দানে আমরা সাহিত্যিকরাও জমা হয়েছিলুম। তার কিছুদিন আগে কি পরে আমি রচনা করি-
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
কবি শামসুর রাহমানের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা উঠে এসেছে খুব চমৎকারভাবে। তিনি লিখেছেন-
‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা”
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন অনেকগুলো কবিতা। তার লেখা ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদ-’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ ইত্যাদি শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার লেখা প্রথম কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে’। ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর কবিতাটি তিনি যখন লেখেন, তখন মুজিব কারাগারে। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যতরুণ গোষ্ঠীর একুশে স্মরণিকায় ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এটিই ছিল প্রথম প্রতিবাদী কবিতার সংকলন।
খুব কম শব্দে মুজিব হত্যার তীব্র ও তীক্ষè প্রতিবাদ করেছিলেন কবি শহীদ কাদরী। তিনি ‘হন্তারকদের প্রতি’ কবিতায় লিখেছেন-
‘বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোন উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবেনা।
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম,
বুট, সৈনিকের টুপি’
কবি মোহাম্মদ রফিক তার ‘ভালোবাসার মাস’ কবিতায় আমাদের দেখিয়েছেন এক চমৎকার চিত্রকল্প।
‘ওই দেখো, অন্ধকার বাঁশঝাড়ে, শটিবনে, দেহখানা নড়েচড়ে,
হায় হায় জলগন্ধে ভুরভুর নিঃসীম পাথার!’
বাংলাদেশের প্রায় সকল কবি-শিল্পীই জাতির জনকের প্রতি তাদের ঋণ শোধ করেছেন পঙ্্ক্তিমালায়; শিল্পে। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বীর নেই আছে শহীদ’, সুফিয়া কামালের ‘ডাকিছে তোমারে’, কায়সুল হকের ‘সমষ্টির স্বপ্নের নির্মাতা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পিতা তোমার কথা এখন এখানে আর’, দিলওয়ারের ‘বিতর্কিত এই গ্রহে’, বেলাল চৌধুরীর ‘রক্তমাখা চরমপত্র’, মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’।
সানাউল হকের ‘লোকান্তর তিনি আত্মদানে’, আবুল হোসেনের ‘শিকারের কবিতা’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘কোন ছবিগুলি’ উল্লেখযোগ্য।
অসীম সাহার ‘প্রতিশোধ’, সিকদার আমিনুল হকের ‘আত্মজের প্রতি’, আসাদ চৌধুরীর ‘দিয়েছিলো অসীম আকাশ’, আবু কায়সারের ‘সূর্যের অনল’, রবীন্দ্র গোপের ‘আমার বুকে অর্ধনমিত পতাকা’, নাসির আহমেদের ‘গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ’, কামাল চৌধুরীর ‘এখনো দাঁড়িয়ে ভাই’, ত্রিদিব দস্তিদারের ‘বাঙালির ডাক নাম’, মিনার মনসুরের ‘কেউ কী এমন করে চলে যায়’- এসব কবিতায় জাতির জনকের জীবন ও সংগ্রাম উঠে এসেছে প্রত্যয়ের সাথে।
ভারতীয় ও পাকিস্তানি কবি ছাড়াও জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি অ্যান ওয়ালশ, জামান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়া কবি ইভিকা পিচেস্কি ও ব্রিটিশ কবি টেড হিউজসহ বিভিন্ন বিদেশি লেখকদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অনেক কবিতার সংকলন বেরিয়েছে দেশে-বিদেশে। এর অন্যতম একটি ‘বাংলাদেশের আকাশ’। এ কাব্য সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে মার্চ, ২০০৭ সালে। সম্পাদনা করেছেন ইংল্যান্ড অভিবাসী কবি কাজল রশীদ। বঙ্গবন্ধু নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্তার শৌর্য-বীর্যের আত্মগরিমা! পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের কালরাতে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়! শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন বিশ্বলোকে। প্রজন্মের গহিন হৃদয়ে। শুধু রাজনীতিতেই নয়, শিল্পে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতেও হয়ে উঠেছেন প্রজন্মের আলোর দিশারী!