লুৎফর রহমান রিটন :
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ভয়াবহ একটা গুমট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো সারাদেশে। সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড এতোটাই নৃশংস ছিলো যে হতবিহবল বিমূঢ় মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক শোক প্রকাশও ছিলো তখন রীতিমতো দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। ঘাতক সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের দুঃশাসন এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসকের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হয়েছিলো নৈরাশ্যের দমবন্ধ এক গুমট পরিস্থিতির। সামরিক শাসকের লিখিত ও অলিখিত ভীতি আর বাধ্য-বাধকতার ভেতরে আমরা পার করছিলাম এক পাথারচাপা সময়।
মানুষের ভেতরের জমাট বাঁধা ক্ষোভ-ঘৃণা আর প্রতিরোধের নিভু নিভু চেতনাকে উসকে দিতে তখন প্রয়োজন ছিলো এক বা একাধিক বাঁশিওয়ালার। যিনি বা যাঁরা বাঁশিতে সম্মোহনী সুর তুলে পাথরচাপা সময়ের আগলটিকে ভেঙে দেবেন। রাজনীতিবিদরা যখন প্রলোভনের যৌনতায় কাতর হয়ে আপসের মখমলে নিদ্রামগ্ন তখন বিপন্ন ও বিষণ্ন জাতির সামনে আশা আর স্বপ্নের প্রদীপ হাতে এগিয়ে এসেছিলেন কতিপয় দুঃসাহসী কবি-ছড়াকার-লেখক-সংস্কৃতিকর্মী। পাথরচাপা সেই অন্ধকার সময়ে ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে প্রথম দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ নামের কবিতায় তিনি বললেন—‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি...’। গুণের কবিতাটি বাংলা একাডেমিতে সমবেত মানুষদের মধ্যে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলো তা ছিলো এক কথায় অভূতপূর্ব। এই বিষয়ে পরবর্তীতে নির্মলেন্দু গুণ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছিলেন—‘কবিতা পাঠান্তে আমার বুকের মধ্যে চেপে-বসা একটি পাথর অপসারিত হয়।’
পরের বছর, ১৯৭৮ সালের একুশের স্নিগ্ধ সকালে জাতির মননের প্রতীক সেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ঘটলো অবিস্মরণীয় আরেকটি ঘটনা। হঠাৎ করেই দু’তিনজন সাহসী মানুষ উদিত হলেন বইমেলার মাঠে, কবিতা পাঠের আসরের শামিয়ানার আশপাশে। তাঁদের হাতে বঙ্গবন্ধুকে বিষয় করে রচিত একগুচ্ছ ছড়া আর কবিতার অনন্যসাধারণ সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। খুব দ্রুত, বলতে গেলে চোখের পলকে সেই সংকলনের সমস্ত কপি নিঃশেষ হয়ে গেলো। এইরকম একটি সংকলন হাতে পেয়ে মানুষের সে কী আবেগ! সে কী প্রতিক্রিয়া! খুব কাছে থেকে সেই প্রতিক্রিয়া অবলোকন করছিলাম আমি অশ্রুসজল চোখে। বিপদের ঝুঁকি নিয়েই সেই সংকলন বিক্রি করছিলেন ছড়াকার আলতাফ আলী হাসু। কিছুক্ষণ পর সেখানে সংকলন হাতে আরেকজনের আবির্ভাব ঘটে, তিনি ছড়াকার সিরাজুল ফরিদ। বাংলা একাডেমিতে আসার আগে সিরাজুল ফরিদ সংকলন বিতরণ ও বিক্রি করে এসেছেন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের জনারণ্যে। ওদের দু'জনের সঙ্গে আরো কয়েকজনকে দেখেছি যাঁদের নাম মনে করতে পারছি না। বাংলা একাডেমিতে তাঁরা পুলিশী প্রতিরোধের মুখেও পড়েছিলেন আশ্চর্য সেই সকালে। আলতাফ আলী হাসু পুলিশের সঙ্গে তর্ক করছিলেন সাহসিকতার সঙ্গে। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে করে অবস্থা। ধাক্কা দিতে দিতে আলতাফ আলী হাসুকে দেয়ালের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো পুলিশ সদস্যরা। সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আলতাফ আলী হাসু সেদিন গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক এই সংকলনটির প্রকাশক হিশেবে ‘সূর্যতরুণ গোষ্ঠী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’-এর নাম মুদ্রিত হয়েছিলো। এই নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন কোনো সংগঠন না থাকলেও প্রকাশক পরিচয়টি আংশিক সত্য ছিলো। কারণ এই সংকলনটির যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে। কক্ষটি বরাদ্দ ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল আজীজের নামে। কেন্দ্রীয় খেলাঘরের মেধাবী ও উদ্যমী তরুণ-সংগঠক আবদুল আজীজ। এককভাবে সংকলনটির কোনো সম্পাদক না থাকলেও এই সংকলনের নেপথ্য কর্মী বা কলাকূশলীদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল আজীজ। সংকলনটি প্রকাশের পরিকল্পনা, লেখা সংগ্রহ, ছাপাখানা নির্ধারণ, মুদ্রণ ব্যয় যোগাড়, প্রচ্ছদ নির্মাণ, প্রচ্ছদ প্রসেস, ছাপা, বাঁধাই এবং বিতরণের ব্যাপারে আবদুল আজীজের সতর্ক পরিকল্পনায় ছিলো দুর্দান্ত রকমের ছক। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই গোপনীয়তা রক্ষাই ছিলো সাফল্যের প্রধান শর্ত। আবদুল আজীজ তাঁর নিঁখুত পরিকল্পনায় তাই তৈরি রেখেছিলেন পাণ্ডুলিপির একাধিক সেট, কম্পোজের একাধিক প্রেস ও একাধিক কম্পোজিটর। মুদ্রণের জন্যে একাধিক মেশিন ও ম্যাশিনম্যান। একটা ফেইল করলে আরেকটাকে সচল করার নিখুঁত ছক তৈরি রেখেছিলেন আবদুল আজীজ। তাঁর বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ছিলেন ভীষ্মদেব চৌধুরী, সিরাজুল ফরিদ, আলতাফ আলী হাসু, নূর-উদ-দীন শেখ এবং আর্টিস্ট মানিক দে। দৈনিক সংবাদের খেলাঘর নামের ছোটদের সাপ্তাহিক পাতাটির অবৈতনিক পরিচালক হিশেবে আবদুল আজীজের অবাধ যাতায়াত ছিলো সংবাদের প্রতিটি সেকশনে। প্রতি সপ্তাহে একাধিক দিবস তাঁকে কাজ করতে হতো সংবাদ অফিসে বসে। সেই সুবাদে কম্পোজিটর থেকে শুরু করে প্রসেস বিভাগের কর্মী এবং প্লেট মেকারদের সাথেও ছিলো তাঁর গভীর সখ্য।
মানিক দে খেলাঘর পাতার জন্যে ছবি আঁকতেন। ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ সংকলনটির অর্থবহ প্রচ্ছদটি অত্যন্ত দরদ দিয়ে এঁকে দিয়েছিলেন মানিক দে। মুদ্রণ ব্যয় কমাতে লাল এবং কালো এই দুই রঙের মধ্যেই চার রঙের ইফেক্ট নিয়ে এসেছিলেন মানিক। আর প্রচ্ছদে ছিলো ক্লোজ আপ শটে মোটা ফ্রেমের কালো একটা চশমা। আর এই চশমাটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর প্রতীক। একটি চশমা থেকে অসংখ্য চশমার রিফ্লেকশন দেখানো প্রচ্ছদটি ছিলো দারূণ বক্তব্যধর্মী। চশমার মাঝখানে রিভার্স হোয়াইট লেটারিঙে সংকলনের নামটি তুলিতে এঁকেছিলেন মানিক দে। এইরকম একটি প্রচ্ছদ তখনকার অবরুদ্ধ সময়ে ঢাকার কোনো প্রসেস প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়াটা রিস্কি বিবেচনা করে আবদুল আজীজ গোপনে সংবাদের প্রসেস সেকশনেই কাজটি সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। খেলাঘর পাতার কাজ করার ছলে শুধু প্রসেসই নয়, প্লেট মেকারের সহায়তায় চারটি প্লেটও গেরিলা কায়দায় বানিয়ে নিয়েছিলেন আবদুল আজীজ। কাজটিকে আপাত দৃষ্টিতে অনৈতিক মনে হলেও সেদিনের বাস্তবতায় সেটা ছিলো একধরণের রণকৌশল। আবদুল আজীজ আমাকে বলেছেন, সংবাদে দীর্ঘদিন খেলাঘরের কাজ করতে গিয়ে অই অন্যায় কাজটি ছাড়া এক ইঞ্চি পজিটিভ কিংবা একটা আলপিনও তিনি লোপাট করেননি কোনোদিন।
সংকলনের লেখা সংগ্রহের আগে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী লেখক-কবিদের নামের একটি তালিকা প্রনয়ন করেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত হয় কোনো লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করতে পারবেন না। হয় স্বনামে লিখবেন নইলে লিখবেন না। লেখা সংগ্রহে দায়িত্ব পালন করেন মূলত দু’জন—আলতাফ আলী হাসু এবং সিরাজুল ফরিদ। এক সকালে আমাদের ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটের বাসায় হাজির হয়েছিলেন সিরাজ ভাই। চা নাশতা খেতে খেতে এটা সেটা আলাপের এক পর্যায়ে খুব সতর্কতায় ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে ফিসফিস করে খুব গোপনে সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনাটি আমাকে জানিয়েছিলেন সিরাজ ভাই। অতঃপর
আজীজ ভাইর সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি চাইলেন আমি যেনো যুক্ত হই এই সংকলন প্রকাশের গেরিলা যুদ্ধে। তখন আমি একটি বা দুটি বিজ্ঞাপন যোগাড় করে একুশের সংকলন প্রকাশ করি প্রায় প্রতি বছর। আমার হাতে সেবছর একুশের একটি সংকলন প্রকাশের স্ক্রিপ্ট ছিলো। আজীজ ভাই খুবই স্মার্ট কায়দায় আমাকে তাঁর যুদ্ধে শামিল করে নিলেন। তিনি বললেন—আমরা যে প্রেসে ছাপতে যাচ্ছি তোমার সংকলনটা সেখানেই ছাপার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওরা খুব রিজেনেবল দামেই ছেপে দেবে তোমার সংকলন। তুমি যদি তোমার পরিকল্পিত প্রেস বাদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দাও তাহলে আমার খুব উপকার হয়। প্রুফ রিডিং অর্থাৎ বানান সমন্বয়ের কাজে আমি তোমার সহায়তা পাবো তাহলে। তোমার মতো একজনকে আমার দরকার নিয়মিত ভাবে, প্রতিদিন। আজীজ ভাইয়ের প্রস্তাবে আনন্দের সঙ্গে রাজি হলাম আমি। এইরকম একটা গৌরবের অংশী হবার সৌভাগ্য ক'জনের হয়!
পুরনো ঢাকার বাবুবাজারের দোতলা একটা আধাভাঙা প্রেসে ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’-এর ইনারপেজগুলো ছাপা হয়েছিলো। সে এক অন্যরকম যুদ্ধ ছিলো বটে! কাজ করছি আমরা প্রকাশ্যে কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষা ছিলো তার প্রধান শর্ত। সামান্য অসতর্কতায় যে কোনো মুহূর্তে ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে সবকিছু।
কম্পোজিটর এবং ম্যাশিনম্যানদের সঙ্গে আলাদা খাতির তৈরিতে আজীজ ভাইয়ের জুড়ি ছিলো না। তাছাড়া একটানা ছাপার সিডিউলও নিতেন না তিনি। যে ম্যাটারটা যেদিন ছাপা হতো সেই ম্যাটার সেদিনই প্রেস থেকে সরিয়ে নিতেন আজীজ ভাই। আর ছাপার আগে দুপুরে কাছাকাছি হোটেলে আমরা যখন খেতে যেতাম আজীজ ভাই তখন মেশিনম্যানকে আমাদের ‘অনারেবল গেস্ট’ হিশেবে অনেকটা জোর করেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন। একদিনের ঘটনা বলি। আমাদের সম্মানিত অতিথি ম্যাশিনম্যানের জন্যে আজীজ ভাই অর্ডার দিলেন খুব বড় সাইজের মাছ। এ বিষয়ে মেশিনম্যানের কোনো আপত্তিই তিনি গ্রাহ্য করলেন না। ভরপেট খেয়ে দেয়ে তারপর শুরু হলো ছাপাছাপি পর্ব। এক পর্যায়ে আমাদের সতর্কতা এবং গোপনীয়তাকে মেশিনম্যানের কাছে প্রকাশ করে তাঁর সহযোগিতার জন্যে আগাম ধন্যবাদ জানাতেও ভুললেন না আজীজ ভাই। কম লেখাপড়া জানা গরিব মেশিনম্যান আমাদের ভদ্র ও মানবিক ব্যবহার এবং সৌজন্যের কাছে পরাভূত হয়ে একধরণের দায়বদ্ধতার ঋণে আবদ্ধ হয়ে পড়তেন। আজীজ ভাই সেটাই চাইতেন।
এর ফলাফল তো একদিন পেলাম হাতেনাতে।
দুপুরে ছাপা হচ্ছে কয়েকটি পৃষ্ঠা। অদূরে, আমাদের সংকলনের সদ্য ছাপানো ফর্মার বাণ্ডিলের ওপর সিরাজুল ফরিদ বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। আমি আর আজীজ ভাই মুদ্রণ তদারক করছি। এমন সময় একজন আগন্তুকের অনুপ্রবেশ ঘটলো—'কী ছাপা হচ্ছে এখানে?' সিরাজ ভাইয়ের ঝিমুনি উধাও হয়ে গেলো মুহূর্তেই। তিনি কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে পড়লেন মুদ্রিত ফর্মার বান্ডিলের ওপর। আজীজ ভাই আর আমি ধরা পড়ে যাবার দুঃশ্চিন্তায় ভেতরে ভেতরে অস্থির। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে মেশিনম্যান অপরূপ দক্ষতায় ক্ষিপ্র গতিতে মেশিনটা লক করে দিয়ে মেশিনের সঙ্গে যুক্ত থাকা সদ্য ছাপা কাগজগুলোর ওপর অন্য আরেকটি ছাপানো ফর্মা ডাম্প করে ফেললেন চোখের পলকে। আগন্তুক লোকটা মেশিনের ওপর থেকে একটা কাগজ তুলে নিলেন হাতে তারপর শকুন দৃষ্টিতে পড়তে থাকলেন। মেশিনম্যান খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন—জ্বি স্যার এইটাই ছাপতাছি।
লোকটা কোনো গোপন জিনিস ছাপা হচ্ছে না—এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে বেরিয়ে গেলেন।
আমাদের দিকে তাকিয়ে মেশিনম্যান বললেন—টিকটিকি স্যার।
আজীজ ভাই বারবার করে ধন্যবাদ জানালেন মেশিনম্যানকে, তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্যে।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম—ভাইজান আপ্নে বুঝলেন ক্যাম্নে যে এইটা টিকটিকি?
তিনি বললেন—পঁচিশ-তিরিশ বচ্ছর ধইরা মেশিনম্যানের কাম করি।
আমাদের মধ্যে সবচে বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সিরাজ ভাই। কারণ তিনি তখন সরকারি চাকরি করেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে। খুব বড় চাকরি নয়। ধরা পড়লে, এইরকম একটি সংকলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে চাকরিটা তার চলে যেতো নিশ্চিত। সঙ্গে জেল-জুলুমও জুটতো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে।
২০০৯ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চ্যানেল আই অনেকগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলো। তার একটির নাম ছিলো--‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। আমার উপস্থাপনায় প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিশেবে আমন্ত্রিত ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং আবদুল আজীজ। অনুষ্ঠানে আবদুল আজীজ বলেছিলেন সংকলনটি প্রকাশের নেপথ্য কাহিনি। বিশেষ করে বিরুদ্ধ সময়ে ঐতিহাসিক এই সংকলনটি প্রকাশের অন্তর্গত তাগিদ-প্রেরণা এবং ঝুঁকির বিষয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন তিনি। আমরা জানতে পেরেছিলাম, তিনি সংকলনের প্রচ্ছদ ছাপাতে গিয়েছিলেন যে প্রেসে সেই প্রেসের মেশিনম্যান বিপরীত রাজনৈতিক বিশ্বাসের সৈনিক ছিলেন। আর সে কারণেই প্রচ্ছদের মাজেজা বুঝে ফেলার পর বারবার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিলেন। নষ্ট করে ফেলছিলেন প্লেট। ঘটনা নিশ্চিত হবার পর আবদুল আজীজ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পরিচিত অন্য আরেকজন মেশিনম্যানকে আনিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রচ্ছদটি ছাপিয়ে সেখান থেকে সরে পড়েন। তখন ছিলো মধ্যরাত। সেই রাতে, নতুন মেশিনম্যান আসা এবং প্রচ্ছদ ছাপা না হওয়া পর্যন্ত আজীজ ভাই আটকে রেখেছিলেন সন্দেহভাজন সেই মেশিনম্যানকে।
এই সংকলনে তাঁদের লেখাই নেয়া হয়েছিলো প্রতিকূল সময়েও যাঁরা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন। লেখা চাইতে গিয়ে বা সংগ্রহ করতে গিয়ে বিদ্রুপের সম্মুখিনও হতে হয়েছে উদ্যোগতাদের। প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখক সরাসরি অসম্মতিও জানিয়েছেন। কিন্তু পরর্তীতে তাঁরা বাতাস বুঝে নৌকায় উঠেছেন। সংকলনের অন্যতম নেপথ্য কর্মী ভীষ্মদেব চৌধুরী ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ শিরোনামের স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন—‘...অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিই সেদিন বঙ্গবন্ধু স্মরণে কবিতা লিখতে অপারগতা বা উন্নাসিকতা প্রদর্শন করেন—যাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে রাজনৈতিক হাওয়া বদলের আনুকূল্যে বঙ্গবন্ধু স্মরণে কবিতা লিখে দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন।...কথাসাহিত্যিক রাহাত খান ও মাহমুদুল হক সম্ভবত এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় সংকলনে জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখেছেন। অন্তর্গত তাগিদ ও দায়িত্ববোধ না থাকলে একজন অবিমিশ্র কথাসাহিত্যিকের পক্ষে কবিতা রচনা বিরল এমন কি তুলনারহিত ঘটনা।’
(সূত্রঃ নেপথ্য কাহিনি/সম্পাদনা লুৎফর রহমান রিটন, পৃষ্ঠা-৮৮, আগামী প্রকাশনী, ২০০১)
কারা কারা লিখেছিলেন সেই ঐতিহাসিক সংকলনে? মুদ্রিত প্রকাশনার পৃষ্ঠাক্রম অনুসারে লেখক তালিকাটা ছিলো এরকম—অন্নদাশঙ্কর রায়, দিলওয়ার, হায়াৎ মামুদ, রাহাত খান, মাশুক চৌধুরী, ফরিদুর রহমান বাবুল, সুকুমার বড়ুয়া, মোহাম্মদ মোস্তফা, মাহমুদুল হক, আমিনুল ইসলাম বেদু, নির্মলেন্দু গুণ, তুষার কর, আলতাফ আলী হাসু, মোহাম্মদ রফিক, আবদুল আজীজ, শান্তিময় বিশ্বাস, আখতার হুসেন, ভীষ্মদেব চৌধুরী, জিয়াউদ্দীন আহমদ, জাহিদুল হক, ইউসুফ আলী এটম, সিরাজুল ফরিদ, ফজলুল হক সরকার, মহাদেব সাহা, জাফর ওয়াজেদ, লুৎফর রহমান রিটন, নূর-উদ-দীন শেখ, ওয়াহিদ রেজা, কামাল চৌধুরী এবং খালেক বিন জয়েনউদ্দীন।
কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতার শিরোনামকেই বেছে নেয়া হয়েছিলো সংকলনের নাম হিশেবে।
একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই ছিলো ১৯৭৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় প্রকাশিত ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ সংকলনটি। এখনকার প্রজন্ম হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না, সংকলনটি প্রকাশকালে, ৪০ বছর আগে কী ভয়ংকর দমবন্ধ একটা অন্ধকার সময় বিরাজ করছিলো বাংলাদেশে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণও একটা দুঃসাহসের ব্যাপার ছিলো তখন।
রচনাকাল/২৭ অক্টোবর ২০১৪
[সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু সমগ্র/লুৎফর রহমান রিটন, প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ, প্রকাশক কথা প্রকাশ, প্রকাশকাল ২০১৭।]