“প্রথমদিন শেখ মুজিব আমাকে ‘আপনি’ করে বললেন” : নির্মলেন্দু গুণ

রাজু আলাউদ্দিন | 

জাতিরজনক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রথম কবিতা ‍লিখেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ । তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে শেখ মুজিব ও তাঁর কবিতার অজানা সব ঘটনা ও পটভূমি । বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে নির্মলেন্দু গুণের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিন। বি.স.
রাজু আলাউদ্দিন : শেখ মুজিব সম্পর্কে আপনার প্রথম লেখা তো বোধহয় ৭৫ সালে, তাই না? 
নির্মলেন্দু গুণ: কত সাল?
রাজু আলাউদ্দিন : শেখ মুজিবের মৃত্যুর পরে, তাই না?
নির্মলেন্দু গুণ:না না না। শেখ মুজিবকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখছি আমি।
রাজু আলাউদ্দিন : কিন্তু আপনার লেখা থেকেই জানলাম শেখ মুজিবকে নিয়ে প্রথম কবিতা লেখা হয়েছে উর্দু ভাষায়..
নির্মলেন্দু গুণ: সেটা তো মারা যাওয়ার পরে।
রাজু আলাউদ্দিন : ও হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন উনি মারা যাওয়ার পরে। রাইট।
নির্মলেন্দু গুণ: আমি লিখছি সিক্সটি সেভেনে ১২ ই নভেম্বরে, সংবাদে (পত্রিকায়) প্রকাশিত হইছে। বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে রচিত ওটাই ছিল প্রথম কবিতা। তার পূর্বে বাংলাদেশের কোন কবি বঙ্গবন্ধুকে সচেতন বিবেচনায় নিয়ে কোনো কবিতা লেখেননি। আমার পরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা কবেন কবি জসীমউ্দদীন এবং সম্ভবত বেগম সুফিয়া কামালও।
রাজু আলাউদ্দিন : সিক্সটি সেভেনে?
নির্মলেন্দু গুণ: সিক্সটি সেভেনে ।
রাজু আলাউদ্দিন : কোন কবিতা এটা? এটা কি আপনার ‘নির্বাচিতা’য় আছে?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, এটা আমার প্রথম বইয়ের কবিতা, কবিতাটার নাম ছিল ‘প্রচ্ছদের জন্য’, তারপরে সেটা নাম পালটে রাখা হয়েছিল ‘স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়’ ।
রাজু আলাউদ্দিন : ও হ্যাঁ, নাম পালটে পরে এই নাম দিয়েছেন। যার শুরুটা ছিল “স্বপ্নে জড়ানো অবাক কন্ঠে…”
নির্মলেন্দু গুণ:হ্যাঁ, হ্যাঁ। পরে শেখ হাসিনার সাথে যখন আমার ঝগড়া হইলো তখন আমি তাকে ‘শাস্তি’ দিলাম…
রাজু আলাউদ্দিন : ‘শাস্তি’ দিলেন? কিভাবে?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, উৎসর্গ থেকে তাঁর বাবার নাম কেটে দিয়ে। উৎসর্গ ছিল তো, কবিতা থেকে উৎসর্গ হিসেবে শেখ মুজিবের নাম কেটে দিলাম। আমার কন্ঠস্বর-এ এটার ব্যাখ্যা আছে কেন তার নামটা কেটে দিয়েছিলাম। যারা ইতিহাসের পাতা থেকে শেখ মুজিবের নাম কেটে বাদ দিতে চান তারা জেনে খুশি হবেন যে এই কাজ আমিই শুরু করেছিলাম।
রাজু আলাউদ্দিন : হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘আপনার কন্ঠস্বর’-এ আছে তো এই কথা।
নির্মলেন্দু গুণ: (হাসি)ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মার্টিন লুথার কিং নিহত হন। তিনি নিহত হওয়ার পর তাকে নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবিতা সংকলন বের করেছিলাম। তাতে আমি, আবুল হাসান, সেলিম আল দীন, হুমায়ুন কবির, হুমায়ুন আজাদ, সেলিম সারোয়ার—সবার কবিতা ছিল। ওটার প্রকাশক ছিল বেবী মওদুদ কারণ বেশির ভাগ টাকাই দিয়েছিল সে। ড. আনিসুজ্জামান সেই সময় ওই সংকলনের প্রশংসা করে সেকালে দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য পাতায় লিখেছিলেন। পুশিং সেলের এক পর্যায়ে আমরা সেইটা শেখ হাসিনাকে এক কপি কিনতে বলি । তিনি বললেন আমাদেরকে টাকা দেয়ার চেয়ে একটা ভিখিরিকে দিলে সেটা কাজে লাগবে। ‘কথাটা ঠিকই বলছেন,’ তো আমি তাকে বললাম, ‘আপনি তো ভিখিরিকে দিলেন না। আমাকে না দেয়ার জন্য ভিক্ষুকের কথা বলছেন। ’ আমি আর আবুল হাসান গেছিলাম তার কাছে। তো পরে আমি বললাম, “আমি আপনার বাবাকে নিয়ে কবিতা লিখবো আর আপনি আমার সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করবেন, কবি বলে মানবেন না, এই সংকলন ক্রয় করে আমাকে উৎসাহিত করবেন না, ধন্যবাদ দেবেন না—এইটা তো হইতে পারে না।” হা হা হা। সুতরাং ‘শাস্তি’ তোমাকে পেতেই হবে। হা হা হা। শাস্তিটা কীভাবে দেয়া যাইতে পারে, সেটা সন্ধান করতে লাগলাম—তখন ১৯৭০ সাল চইলা আসছে, জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসছেন, ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়ে গেছেন, নির্বাচন হযে গেছে; না ভুল বললাম, নির্বাচন হয় নাই। আমার বই বেরিয়েছে নভেম্বর মাসে নির্বাচনের আগে । তো বুঝাই যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত নেতা, তার কথায় বাংলাদেশে উঠে বসে। তখন আমি ভাবলাম, বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে রচিত কবিতা যদি এতই গুরুত্বহীন হয়ে থাকে, এত হীনই হয়ে থাকে, তাহলে ঠিক আছে নামটা কেটে বাদ দিয়ে দেই।
রাজু আলাউদ্দিন :আচ্ছা আচ্ছা। 
নির্মলেন্দু গুণ: এটা সংবাদের পাতায় কিন্তু আছে। উনিশ সাতষট্টির বারই নভেম্বরে, তখন বঙ্গবন্ধু জেলখানায় ছিলেন। লতিফ সিদ্দীকি তাকে( শেখ মুজিব) এই কবিতাটা পড়তে দিছিলেন। রনেশ দাশগুপ্তের মাধ্যমে তিনি(বঙ্গবন্ধু) কবিতার অর্থ উদ্ধার করেছিলেন। “দেখেন তো আপনার কবি আমাকে নিয়া কবিতা লিখছে, কী বলতে চাচ্ছে কবিতার মধ্যে।” যখন কবিতাটা পড়ে শুনালেন, তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চকন্ঠে হেসে বললেন, ‘আপনারা আমাকে চিনতে পারেন নাই, কবি আমাকে চিনতে পারছে।’
রাজু আলাউদ্দিন : এটাতো বিশাল স্বীকৃতি। 
নির্মলেন্দু গুণ:হ্যাঁ। হুমায়ুন কবিরকে যখন মেরে ফেললো, আমরা গেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে বিচার নিয়া, তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে তো আমার কথা হইছিল, তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন : এটা তো ব্যতিক্রম, কারণ উনি তো সাধারণত ‘তুই’, ‘তুমি’ বলতেন। 
নির্মলেন্দু গুণ: আমার পাশে আহমদ ছফা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা—হুদারে জিজ্ঞেস করলেই আপনি জানতে পারবেন হিস্টরিটা—তারা সবাই বলছিল, “বঙ্গবন্ধু, নির্মলকে আপনি ‘তুমি’ বলতে পারেন।” তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, “বয়স বিচারে তো আমি তাকে ‘তুমি’ বলতে পারি। কিন্তু তিনি কবি সেই জন্যই তাকে ‘আপনি’ বলছি।”
border=0রাজু আলাউদ্দিন : আচ্ছা আচ্চা। এটা কিন্তু সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা আমি জানতাম না। এই অংশটা ‘আপনার কন্ঠস্বর’-এ নাই। 
নির্মলেন্দু গুণ: এটা আমি ইচ্চা করেই উল্লেখ করি নাই। আর তাছাড়া, এটা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের কাহিনী, সেই জন্যেও এটা ওখানে নাই। কন্ঠস্বর তো উনিশ শ’ সত্তুরের নির্বাচনের আগেই শেষ হয়ে গেছে। আর উনি আমাকে ‘আপনি’ বলছেন ১৯৭২ সালে ৬ই জুন।
রাজু আলাউদ্দিন : তারপরে? 
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, এটাতো আমার বইয়ে (আমার কন্ঠস্বর)থাকার কথা না। কারণ ওই সময়টার কাহিনিতো আমি লেখি নাই।
রাজু আলাউদ্দিন : হ্যাঁ, ‘কন্ঠস্বর’-এ তো এই সময়টা আসে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, এই সময় আসার কথা না।
রাজু আলাউদ্দিন : এর পরেই বোধহয় আপনার দ্বিতীয় কবিতা পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরে, তাই না? 
নির্মলেন্দু গুণ: না না না । তারপরে ‘হুলিয়া’ কবিতার মধ্যে লিখলাম না “আইয়ুব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?” যে কবিতা নিয়া গাফফার চৌধুরী ‘তৃতীয় মত’ কলাম লিখলেন, তখনকার সবচাইতে বিখ্যাত কলাম। কলামে লিখলেন যে কবি কন্ঠে এই সময়ের সবচেয়ে জরুরী প্রশ্নটি উচ্চারিত হয়েছে। ‘হুলিয়া’ কবিতাটি হচ্ছে এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। সময়কে ধারণ করে এটি রচিত হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম তরুণ কবিরা জীবনবিমুখ, কিন্তু এই কবিতাটি শুনার পরে মনে হচ্ছে নতুন একদল তরুণ কবি আসছে যারা স্বাধীনতার শপথ নিয়া বঙ্গবন্ধুর সহযোগী হতে চায়। বিরাট একটা লেখা লেখছিল গাফফার চৌধুরী, সেটার উদ্ধৃতি আছে আমার কন্ঠস্বর বইটার মধ্যে। উনসত্তুর সালের দিকে লেখাতো। বঙ্গবন্ধু আবার গাফফার চৌধুরীকে খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু যা বলতেন গাফফার চৌধুরী সেইটা লিখতেন আরকি। আর আমাদের আবিদুর রহমান, সম্পাদক যে…
রাজু আলাউদ্দিন : কী নাম বললেন?
নির্মলেন্দু গুণ: আবিদুর রহমান। ‘দি পিপল’-এর সম্পাদক। তাকেও বলতেন কী লিখতে হবে। এই দুইজনকে তিনি গাইডলাইন দিতেন আর কি। প্রতিদিন রাত্রে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতেন এরা। আমার ‘হুলিয়া’ নিয়া যখন গাফফার চৌধুরী ‘তৃতীয় মতে’ লিখলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, “এই কবি তো আমাকে নিয়ে কবিতা লিখছিল সেই সিক্সটি সেভেনে, আমি তখন জেলে ছিলাম। এই কবি আমার সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করলো, কেন? কোথায় থাকে এই কবি। আমার সঙ্গে একবার কথা বলাতে পার কিনা এই কবির। কোথায় থাকে জান?” গাফফার ভাই বললেন, এই কবি তো বোহেমিয়ান, কোথায় থাকে কেউ জানে না। তখন আবিদুর রহমান বললেন, আমি জানি। আমার কাগজে চাকরী করে।
রাজু আলাউদ্দিন : ও হ্যাঁ, তখন তো আপনি পিপল-এ। 
নির্মলেন্দু গুণ: উনি বললেন, “তাহলে তাকে আসতে বল। তুমি তাকে নিয়ে আস আমার কাছে, আমি কথা বলবো তার সাথে।” শেখ মুজিব কী ভুল করছে মানে উনি ‘কী ভুল’ করছেন সে সম্পর্কে তিনি আমার কাছ থেকে শুনবেন। আবিদুর রহমান সাহেব যখন আমাকে বললেন, “শেখ সাহেব আপনার সাথে দেখা করতে চান।”
রাজু আলাউদ্দিন : এই কথা শুনার পরে আপনার কী অনুভূতি হলো?
নির্মলেন্দু গুণ: একজন কবি হিসেবে তো এটা খুবই সম্মানজনক: বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। আমি বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্যে, বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে ইনভলবড হয়ে গেলাম ইন দ্য হায়েন্ট ফর্ম। তখন আমি বললাম আমি অবশ্যই যাবো। আজকে না, কালকে। কালকে করতে করতে ইতিমধ্যে ২৫শে মার্চ চলে আসলো । ২৫শে মার্চের রাত্রে— সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি ছিল (সৈয়দ আহমদ)ফারুক আর আনোয়ারুল আলম শহীদ ছিল জিএস। ওরা এসে আমাকে নিয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হইলো না, কারণ বঙ্গবন্ধু ঘরের ভিতরে ছিলেন, হাই কমান্ডের সঙ্গে মিটিংয়ে ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার আলোচনা ভেস্তে গেছে, ইয়াহিয়া খান তার সাথে আর আলোচনায় আগ্রহী না, বঙ্গবন্ধু আরও চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাই দিস টাইম অপারেশন সার্চ লাইট প্লান পুরোপুরি শেষ করে এনেছেন। হি ফ্লেড এওয়ে ইন দা ইভিনিং। আমরা সেটা জানতাম না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু গট দ্য নিউজ দ্যাট হি লেফট বাংলাদেশ ইন দ্য ইভিনিং। কোনো রকমর ঘোষণা ছাড়াই ইয়াহিয়ার আকস্মিক চলে যাওয়ার মধ্যে বঙ্গবন্ধু একটা বিপদসংকেত পেলেন। ২৫শে মার্চ রাত্রে এইটার মোকাবেলা কিভাবে করা যাবে এই নিয়ে তিনি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে ,আর্মির সঙ্গে, বিডিআর-এর সঙ্গে, তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে কথা বলবেন। ফলে ওই দিন তিনি আর অন্য কাউকে সময় দেন নাই। সন্ধ্যার পর তিনি আর এক মুহূর্তের জন্যও বাইরে বেরিয়ে আসেননি। সেদিন রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। শেখ হাসিনা বেলকনি থেকে আমাকে দেখে ভেতরে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি যাইনি। বঙ্গবন্ধুর সময় নষ্ট করা হবে বিবেচনায় আমি আর যাইনি। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারি নাই। আমার সঙ্গে সেদিন সারাক্ষণ ছিলেন এপিএনের সাংবাদিক খালেদ চৌধুরী(প্রভু)।
রাজু আলাউদ্দিন :আর এর পরে বোধহয় তৃতীয় কবিতা…
নির্মলেন্দু গুণ: এরপরে তৃতীয় কবিতা হলো কলকাতায় গিয়ে লেখা ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, কবিতাটা পরবর্তীকালে পাইছি, তার আগে চাই সমাজতন্ত্র বইতে আছে। ‘আমার কাছে সমস্ত শক্তির উৎস শেখ মুজিব’।–এই রকম আরকি।
রাজু আলাউদ্দিন : এই কবিতাটা বোধহয় আপনার ‘নির্বাচিতা’য় রাখেন নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: তা জানি না, মনে নাই। শেখ মুজিব নিয়ে তো অনেক কবিতা আছে, কত কবিতা আর রাখবো।
রাজু আলাউদ্দিন : হ্যাঁ, তা ঠিক। এটাই বোধহয় পঁচাত্তর পরবর্তী তৃতীয় কবিতা, তাইতো?
নির্মলেন্দু গুণ: না, পঁচাত্তর পরবর্তী না, একাত্তরে লেখা।
রাজু আলাউদ্দিন : আচ্ছা আচ্ছা, একাত্তরে। এরপরে যেটা লিখলেন…
নির্মলেন্দু গুণ: এরপরে তো আমি শেখ মুজিরের সমালোচনাই করতাম। আমি তার বিরুদ্ধে চলে গেলাম না?
রাজু আলাউদ্দিন : আচ্ছা আচ্ছা। 
নির্মলেন্দু গুণ: ‘গণকন্ঠে’ জযেন করলাম না আল মাহমুদের সঙ্গে!
রাজু আলাউদ্দিন :হ্যাঁ হ্যাঁ, রাইট। 
নির্মলেন্দু গুণ: সেখানে তো আওয়ামী লীগের অপকর্ম, দুর্নীতি ইত্যাদি সমালোচনা লেখাটাই ছিল আমাদের কাজ।
রাজু আলাউদ্দিন : কিন্তু এমনিতে ব্যক্তি মুজিবের প্রতি তো আপনার কোনো সমালোচনা ছিল না, তাই না?
নির্মলেন্দু গুণ: ব্যক্তিগতভাবেও তার সমালোচনা আমি করছি। ওআইসিসিতে যোগদান করার সিদ্ধান্তটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী—এটা আমি তখন বলছি।
রাজু আলাউদ্দিন : হ্যাঁ, এইটা একটা ভালো কথা বলছেন। এইটা আমিও মানতে পারি না। এইখানে যোগ না দিলেও কিছু আসতো যেতো না। বাংলাদেশ এতে লাভবান হইছে—তাতো আমার মনে হয় না। বরং…

mujibur.jpg

শিল্পী গোলাম মোস্তফা নির্মিত বঙ্গবন্ধুর কাঠের ভাস্কর্য। কাশবনে কবি নির্মলেন্দু গুণের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত।

নির্মলেন্দু গুণ: তিনি রাজনৈতিকভাবে এন্টিআমেরিকান যে অবস্থানটা নিয়েছিলেন এবং রাশিয়াসহ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াটা আমাদের পক্ষে ছিল, যে রেফারেন্স নিয়ে কালকে তোফায়েল পর্যন্ত কথা বললো যে জিএসপি সুবিধা আমেরিকা আমাদেরকে রাজনৈতিক কারণে দেয় নাই। তারা ১৯৭১ সালে আমাদের বিরোধিতা করছিল, এখনও তারা আমাদের উন্নতির বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যে আমাদেরকে তলাহীন ঝুড়ি বলছিল, সেটা তারা এখনও ভুলতে পারে নাই।
রাজু আলাউদ্দিন : আসলে তো ভোলা যায়ও না, তাই না?

নির্মলেন্দু গুণ: হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো এবাউট ইট? কালকে আমি এটা নিয়ে আলাপ করছিলাম, সেটা হলো এখন তো শেখ মুজিবকে নিয়ে লক্ষ কবিতা রচিত হচ্ছে । শেখ মুজিবকে কবিতায় বিষয় করে তোলা—কেন জানি আমার মাথাতেই সর্বাগ্রে আসছিল।
রাজু আলাউদ্দিন : হ্যাঁ হ্যাঁ, তাতো বটেই। আপনার মধ্যেই তো সেটা প্রথম দেখা গেল। শেখ মুজিব যখন বিরোধী দলীয় আন্দোলনের নেতা, তখন প্রথমবারের মতো সম্ভাবনা আপনিই উপলব্ধি করছেন। 
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, সেটা ঠিক।
রাজু আলাউদ্দিন : একটি জাতির নেতৃত্বে আছেন বিপক্ষীয় দলের নেতা হিসেবে, সেটা আপনিই উপলব্ধি করেছেন।
নির্মলেন্দু গুণ: আমারতো ইন্ডিয়াতেই চলে যাওয়ার কথা ছিল, আমি শেখ মুজিবের কারণে ইন্ডিয়াতে যাই নাই। সিক্সটি ফোরের রায়টের সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোনীত হয়ে ভর্তি হইতে পারি নাই, ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে আর্কিটেকচারে রিটেনে পাস করা সত্ত্বেও ভাইবাতে আমাকে ফেল করানো হইছিল। আমি ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া মেট্রিকে, ইন্টারমিডিয়েটে, আমি শেষে পাসকোর্সে বিএসসিতে ভর্তি হইছি। আমার এজেন্ডার মধ্যেই ছিল রাস্তায় থাকা। আমি দেখলাম যে ভাসানী, মনি সিং, ন্যাপ পার্টি—আমি বুঝেছিলাম যে এদেরকে দিয়ে হবে না। আমার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ব্যাপারটা ছিল, তখন মনে হতো দেশ স্বাধীন না হলে তো আর সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে না। অতএব দেশ স্বাধীন করতে হবে। পাকিস্তান থেকে একে আলাদা করতে হবে। পাকিস্তানতো আর সমাজতন্ত্র হাইদা দিবে না, তারা গণতন্ত্রই দেয় না, আর সমাজতন্ত্র দিবে কেন।
রাজু আলাউদ্দিন : আপনি জিয়াউর রহমানের সময় যখন লিখলেন, মানে শেখ মুজিব মারা যা্ওয়ার পর, তখন আপনি তাদের দ্বারা হেনস্তা হন নাই?
নির্মলেন্দু গুণ: কখন, কখন?
রাজু আলাউদ্দিন : পঁচাত্তরে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পরে আপনি যখন তাকে নিয়ে কবিতা লিখলেন তথন সেই সময়ের সরকার, পুলিশ বা মিলিটারি দ্বারা হেনস্তা হন নাই?
নির্মলেন্দু গুণ: কম । রমনা থানা হাজতে আমি সাত দিন ছিলাম। আর্মি ধইরা নিয়ে আমাকে রমনা থানা হাজতে কাস্টোডিয়ান হিসেবে জমা দিয়ে গিয়েছিল আর কি। সেই কাহিনি তো আমার ওই বইয়ে আছে, রক্ত ঝরা নভেম্বর ১৯৭৫।
রাজু আলাউদ্দিন : ওই সময় লেখকদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি এনিয়ে?
নির্মলেন্দু গুণ: আরে, লেখকদের মধ্যে!….মহাদেব(সাহা) গেছিল আমার ছোটভাইকে নিয়ে দৈনিক বাংলায়, তখন শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব, হাসান হাফিজুর রহমান—তখন দৈনিক বাংলার সাথে যারা যুক্ত, তারা মহাদেবকে ডিসকারেজ করলো যে নির্মলকে নিয়ে তুমিও প্রোবলেমে পড়বা। বিবৃতি দেয়াতো দূরের কথা, তারা মহাদেবকে নিবৃত করেছিল আমার ইসুটা নিয়ে মুভ না করার জন্য। আমার মুক্তির জন্য কেউ দাবী জানায় নাই। কিন্তু আমাকে দেখতে গিয়েছিল, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, সিরাজুদ্দীন ভাই, মানে সিভিল সার্ভিসের সিরাজুদ্দীন ভাই, এরকম কিছু কিছু লোক। আহমদ ছফা আমাকে দেখতে গেছিলেন, তবে সে আমার সম্পর্কে যা বলেছিল তা আমার বিরুদ্ধেই গেছে। হা হা হা। সে বলছিল যে, হায়, এরে ধরে নিয়ে আসছেন, তার সব আত্মীয়স্বজন তো ইন্ডিয়া চলে গেছে, সে একলা থাকে দেশে। ওকে দেখার কেউ নাই। আমরাই ওর দেখাশুনা করি। পুলিশের লোকরা তখন বললো, উনিই তো বললেন তার আত্মীয়স্বজন ইন্ডিয়াতে যায় নাই। আমিতো মিথ্যা বলছিলাম যাতে আমারে সন্দেহ না করে। আমি বলছিলাম আমার আত্মীয়স্বজন এইখানে, সব ভাইবোন এইখানে, ইন্ডিয়াতে কেউ নাই। আর এই দিকে ছফা বলতেছে আমার আত্মীয়স্বজন সব ইন্ডিয়াতে গেছে। (হাসি) তবে বাংলাদেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে আমি কোন না কোনোভাবে জড়িত।
রাজু আলাউদ্দিন : তাইতো দেখতে পাচ্ছি। খুবই সত্যি। 
নির্মলেন্দু গুণ: বাংলাদেশের ইতিহাস আমাকে ফাঁকি দিয়ে রচিত হয় নাই।
রাজু আলাউদ্দিন : গুণদা, আপনি এখন ঢাকায়তো?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ। কালকে (১২/০৮/২০১৫) এগ্রিভার্সিটি গেছিলাম। সেখানে মোনায়েম খানের প্রশংসা করে আসলাম। আমরা মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলাম, আমরা যে মোনায়েম খানরে গুলি কইরা মারছি… কিনতু এই মোনায়েম খানই এগ্রি ভার্সিটি তৈরি করছিল। মাইমেনসিংয়ের জন্য মোনায়েম খানের দুইটা বড় অবদান আছে। একটা হলো এগ্রিভার্সিটি এবং আরেকটা হলো মাইমেনসিং মেডিকেল কলেজ। এই দুটোই মোনায়েম খান করেছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন : তাইলে এটাকে আঞ্চলিক প্রশংসা বলা যেতে পারে। 
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, ওইখানে গিয়ে এটা বলাটা প্রাসঙ্গিক বেশি। দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তো করবেই। আমি দেখলাম তার এই অবদানের কথা কেউ জানতো না। এগুলো চাপা পড়ে গেছে। আমি বলার পর সবাই চমকে উঠলো। যখন এখানে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না তখন বাবা আমাকে এখানে নিয়ে আসছিল। এখানে ভেটেনারী স্কুল ছিল আর বড় বড় গাই গরু ছিল। লিটন মেডিকেল স্কুল ছিল। সেখান থেকে এলএমএফ ডিগ্রি দেয়া হইতো। সেখানে অনেকগুলো নরকঙ্কাল বা নারী কঙ্কাল যা-ই বলি কেন—ছিল। আমরা কঙ্গাল দেখলে নরকঙ্কালই বলি, এর কোনো লিঙ্গভেদ করি না। কিন্তু আমার মনে হয় আমার পরিচিত মেডিকেল কলেজগুলোতে কঙ্কাল যেগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু নারী কঙ্কালও নিশ্চয়ই কিছু আছে। নারী কঙ্কাল আছে শুনে নারীরা আবার হাসাহাসি করলো; তাদের যে কঙ্কাল আছে, এটা তারা ভুলেই গেছিল। (হাসি) বুদ্ধদেব বসুর কবিতার মধ্যে আছে: একটা সুন্দরী নারীর বর্ণনা দিচ্ছে যার ভিতরে একটা কঙ্কাল আছে।
রাজু আলাউদ্দিন :হ্যাঁ, বুদ্ধদেব বসুর একটা কবিতা আছে।
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ। তারা প্রথমবারের মতো জানলো নারী কঙ্কালও হয়। (হাসি)
রাজু আলাউদ্দিন : আপনার বলার স্টাইল অসম্ভব রকমের উপভোগ্য।
নির্মলেন্দু গুণ: এগ্রি ভার্সিটিতে একঘন্টা বক্তৃতা দিছি, সেই বক্তৃতাতে আমি বঙ্গবন্ধু নিয়ে যেসব কবিতা লিখেছিলাম সেগুলোর পটভূমি ব্যাখ্যা করেছিলাম।

SUMMARY

1111-1.jpg