চীনের সম্পৃক্ততা যাচাইয়ে কেজিবিএজেন্টকে ডেকেছিলেন ইন্দিরা


মিজানুর রহমান খান

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেদনাদায়কভাবে সপরিবারে নিহত হন, তাতে সিআইএর পরিবর্তে চীন জড়িত ছিল কি না, সেই সন্দেহ সম্ভবত তাৎক্ষণিকভাবে ইন্দিরা গান্ধীর মনে এসেছিল।
ভারতে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির তৎকালীন প্রতিনিধি লিওনিদ ভ্লাদিমিরোভিচ শেবারশিন তাঁর লেখা মস্কোর হাত: সোভিয়েত গোয়েন্দা প্রধানের নথি বইয়ে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভারতীয়দের চীনা সন্দেহ-সংশয়ের প্রসঙ্গ ছাড়াও কেজিবির ওই কর্মকর্তার বয়ান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন কিছু বিষয় এসেছে, যা ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলির নেপথ্যে বিদেশি যোগসাজশ নিয়ে যে অব্যাহত বিতর্ক, তা নিষ্পত্তির আলোচনায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই প্রতীয়মান হয়।

মিখাইল গর্বাচেভের শাসনামলে শেবারশিন কেজিবির প্রধান (১৯৮৯-৯১) ছিলেন। তাঁর একটি বিস্ময়কর মন্তব্য হলো: ‘আমার বলা উচিত, এ রকম ঘটনার পূর্বাভাস সহজে দেওয়া যায় না...কীভাবে কেউ বলে দেবেন যে একজন তরুণ মেজর, যিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তিনি নিজের অপমান ভুলবেন না, বরং বন্ধুদের জড়ো করে জাতির পিতাকে হত্যা করতে যাবেন, আর তারপর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করবেন?’

প্রথম আলোর গবেষণায় দেখা যায়, ‘এ রকম ঘটনার’ ব্যাপারে ‘পূর্বাভাস’ দেওয়া সম্ভব নয় বলে কেজিবির সাবেক প্রধান যা উল্লেখ করেছেন, সেটা অবশ্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাওয়ের দেওয়া সুস্পষ্ট পূর্বাভাসের সঙ্গে খাপ খায় না। তিনি ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদনক্রমে গণভবনে এসে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম সতর্ক করেন। এরপর পঁচাত্তরের মার্চে ঢাকায় ‘র’-এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে রাষ্ট্রপতিকে পুনরায় সতর্ক করা হয়। ওই কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিলেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী ইউনিট তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা অগ্রাহ্য করেছিলেন। মার্কিন নথিপত্রেও অবশ্য এই দাবি আছে যে তারাও মুজিবকে সতর্কবার্তা দিয়েছিল। তবে তা কবে, কখন—সে বিষয়ে বিস্তারিত এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে। অবমুক্ত হওয়া বেশ কিছু মার্কিন দলিলের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান বা বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন।

শেবারশিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন মস্কোভিত্তিক ইতিহাসবিদ ও গবেষক স্ভেৎলানা চেরভোন্নায়া। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শেবারশিনের ১৯৯২ সালের বইটির নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করে প্রথম আলোকে দিয়েছেন। বইটি পশ্চিমে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন শেবারশিন। আর এ কথা তিনি ১৯৯০-এর দিকে স্ভেৎলানাকে বলেছিলেন।

শেবারশিন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে খুব ভালো জানতেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ব্যাপারেও। তিনি ইংরেজি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষা অনর্গল বলতে পারতেন। ২০১২ সালে পিস্তলের গুলিতে মস্কোতে নিজ বাসায় ‘আত্মহত্যা করেন’।

Eprothom Aloপঁচাত্তরের ওই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে যেসব বিদেশি শক্তি কলকাঠি নেড়েছিল, তাদের পরিচয় বা কর্মতৎপরতা উদ্ঘাটনের কাজ এখনো বাকি। ওই ঘটনার পর সোভিয়েতপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো বিশ্বজুড়ে খবর প্রকাশ করে যে এতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জড়িত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে। দেশটির সন্দেহ, সিআইএকে দোষারোপ করার ব্যাপারটিতে ইন্দিরা সরকারের ইন্ধন থাকতে পারে। ভারতে তখন জরুরি অবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল, তদুপরি দেশটির সংবাদমাধ্যম ফলাও করে ওই খবরই প্রচার করেছিল।

মার্কিন সিনেটর টমাস এগলটন ১৯৭৫ সালের ২১ আগস্ট ভারত সফরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে স্পষ্ট জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন মুজিব হত্যায় সিআইএ জড়িত ছিল?’ জবাবে ইন্দিরা দুবার বলেন, ‘আমাদের কাছে এ রকম কোনো খবর নেই।’

আর কয়েক দশকের পর এই প্রথমবার জনসাধারণ কেজিবির সূত্রেই জানতে পারল ওই অভ্যুত্থানে চীনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে ভারতের শঙ্কিত হওয়ার কথা।

লিওনিদ শেবারশিনের স্মৃতিচারণা: ‘আমার মনে পড়ছে, সেদিন সোভিয়েত দূতাবাসে পার্টি কমিটির বৈঠক ছিল। স্বভাবতই আমরা এটা-সেটা আলোচনা করছিলাম, যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়। সকালে কেজিবির কর্মকর্তারা বিভিন্ন দায়িত্ব বুঝে নিলেন। ঢাকার তথ্যকেন্দ্রে একটা অনুরোধ পাঠানো হলো। এখনো আমার মনে পড়ে সেদিনের বিরক্তির কথা। দলীয় বৈঠকের আসল কাজে বিঘ্ন ঘটিয়ে অন্য কিছু করাতেই এমন অনুভূতি হয়েছিল।’

শেবারশিন লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সাল নাগাদ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। আগে যেসব বিষয়ে মতৈক্য ছিল, সেগুলো নিয়েও সন্দেহ, পারস্পরিক নিন্দা ও দ্বন্দ্বের সুযোগ তৈরি হয়। ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর পাঁচ কর্মকর্তা একদল সেনা নিয়ে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে প্রবেশ করেন। হত্যা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকে (এ তথ্য সঠিক নয়। মনসুর আলী ৩ নভেম্বর কারাগারে নিহত হন)। বাংলাদেশকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এসব ঘটনা ভারতকে বিস্মিত করেছিল।’

কেজিবির সাবেক প্রধান পঁচাত্তরে দিল্লিতে তাঁর রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের স্মৃতিচারণা করে আরও লিখেছেন, ‘দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা আচমকা জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে টেলিফোন এসেছে। ইন্দিরা গান্ধীর একজন সহকারী আমাকে 
ডেকে পাঠিয়েছেন। যত শিগগির সম্ভব দেখা করতে হবে।’

লিওনিদ শিবারশিন
লিওনিদ শিবারশিন
জাতীয় পুরস্কারজয়ী সোভিয়েত গোয়েন্দাপ্রধান এল ভি শেবারশিন অবশ্য ভারতীয়দের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের ওই অভ্যুত্থানের ঘটনায় কোনোভাবে চীনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করেন। ইন্দিরার শীর্ষ সহযোগীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমি নিষ্ঠার সঙ্গে বলছি, এ রকম উপসংহারে পৌঁছানোর মতো কোনো তথ্য-প্রমাণ আমার কাছে নেই।’
শেবারশিনের আরেকটি বর্ণনায় ইঙ্গিত রয়েছে যে বাংলাদেশের ওই অভ্যুত্থান সম্পর্কে তাঁর কোনো আগাম ধারণা ছিল না। তবে ওই সময়ে কেজিবি ও ‘র’-এর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে কোনো জটিলতা থাকার কথা নয়। অথচ সাবেক কেজিবিপ্রধানের ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানবিষয়ক ভাষ্য নানা প্রশ্ন তৈরি করে। ১৯ আগস্ট ১৯৭৫ সিআইএর টপ সিক্রেট নথিতে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশ অভ্যুত্থানে মস্কো বিস্মিত। অভ্যুত্থানের দিনটিতে ঢাকায় সোভিয়েত কর্মকর্তাদের অভ্যুত্থানের উৎস এবং নতুন সরকারের দিকনির্ণয়ের ঝোঁক অনুধাবনে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।

১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে দায়িত্ব পালনের সময় শেবারশিনের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। ১৯৬৬ সালে তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে কোসিগিনের সুনজরে পড়েন, পুরস্কৃত হন। ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে তাঁকে ভারতে কেজিবির উপপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। জরুরি অবস্থার সময় (১৯৭৫-৭৭) তিনি কেজিবির প্রধান হিসেবে কাজ করেন।

লিওনিদ শেবারশিন লিখেছেন, (বাংলাদেশ থেকে) ‘যেসব তথ্য আসছিল, সেগুলোয় দ্রুত চোখ রাখছিলাম: সারগর্ভ কিছু নয়, বেশির ভাগই অনুমাননির্ভর, আলোচনা আর শঙ্কা।’

ভারতীয় কোন কর্মকর্তা তাঁকে টেলিফোন করেছিলেন, সেটা প্রকাশ করেননি শেবারশিন। তবে ওই ব্যক্তি সম্ভবত পি এন ধর, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কার্যালয়ের তৎকালীন অন্যতম সচিব। তিনি ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারের মধ্যে যোগাযোগের মুখ্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। লক্ষণীয় যে কেজিবির প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনায় অনীহা জানিয়েছিলেন।

শেবারশিনের ভাষ্য, ‘আমি তাঁকে বলি, দূতাবাসে একজন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (রাষ্ট্রদূত ভি এফ মালৎসেভ ছুটিতে ছিলেন) আছেন। আমাকে সম্ভবত ভুল করে ডাকা হয়েছে। আমি চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে আপনাদের আগ্রহ এখনই জানিয়ে দিচ্ছি। আর তিনি নিঃসন্দেহে আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে যাবেন।’

ইন্দিরার ওই সহকারীকে শেবারশিন কিন্তু টেলিফোনেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ঢাকার পরিস্থিতি কৌতূহলোদ্দীপক। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।’ তবে যখন তাঁকে বলা হলো, শীর্ষ ব্যক্তির (ইন্দিরা গান্ধী) কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছে এবং আপনার সঙ্গেই কথা বলতে বলা হয়েছে। শেবারশিন তখনই ছুটে যাওয়ার মনস্থির করেন। শিবারশিন লিখেছেন, ‘আমি পরিষ্কার বুঝলাম। কারণ আমি যাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাঁকে আমি চিনতাম। তাঁর ওপরে কেবল প্রধানমন্ত্রীই আছেন।’ শেবারশিন লিখেছেন, ‘প্রথম আলাপচারিতায় আমি ভারতের জানতে চাওয়ার বিষয়ে সন্তুষ্ট করার মতো কিছুই বলতে পারিনি। তবে ব্যক্তিগত বিবেচনায় বলেছি, চীনের জড়িত থাকা অসম্ভব।’

স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত নেতৃত্ব বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) শীর্ষ পর্যায়কে জানায়, মুজিবকে উৎখাতের ঘটনায় সিআইএ যুক্ত ছিল আমাদের কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই।

এই বক্তব্যের ব্যাপারে মঞ্জরুল আহসান খানের মতো সোভিয়েতপন্থী নেতাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সত্যিকারের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজে কেজিবির সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিআইএর কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়ে সন্দেহমুক্ত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজও একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। গোড়াতে তিনিও বিষয়টিকে কেজিবির পদ্ধতিগত প্রচারণার অংশ হিসেবে মনে করলেও পরে তিনি ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের’ ভিত্তিতে দ্রুত মত পাল্টান।

মিত্রখিনের নথি

কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা ভাসিলি মিত্রখিন যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-ফাইভের সহযোগিতায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি যুক্তরাজ্যে নিয়ে যান। সেগুলোর সমন্বয়ে ২০০৫ সালে কেমব্রিজের ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রুর সঙ্গে তিনি লেখেন দ্য মিত্রখিন আর্কাইভ টু, দ্য কেজিবি অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড।এতে তাঁরা উল্লেখ করেন যে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে সিআইএ জড়িত ছিল বলে কেজিবি মনে করত না। তবে সিআইএকে অভিযুক্ত করার জন্য খবরের কাগজে সাজানো রিপোর্ট ছাপাতে কেজিবি তৎপরতা চালিয়েছিল।

ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু ও মিত্রখিন লিখেছেন, ‘কেজিবি থেকে পদত্যাগের পর শেবারশিন একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে তাঁর “ভাবালুতাপূর্ণ পুরোনো সময়, অসত্য তথ্য ও জাল নথিপত্র, সংবাদমাধ্যমের জন্য স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি” ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে স্মৃতিকাতর কথাবার্তা বলেন।’ তাঁরা আরও লিখেছেন, ‘সিআইএর যোগসাজশ সম্পর্কে কেজিবি অন্তত ৭০টি সংবাদ তৈরি করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তা প্রচার করে। দিল্লি কেজিবি তখন দাবি করেছিল, ইন্দিরা গান্ধীর মনে তাঁরা সিআইএ-ভীতি অত্যন্ত গভীরে প্রথিত করতে সফল হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে তাই কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনায় ইন্দিরা যখন ভারতে সিআইএর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন কেজিবি বেজায় উৎফুল্ল হয়েছিল।

অ্যান্ড্রু ও মিত্রখিনের বই বলছে, ইন্দিরাকে বোঝানো হয়েছিল যে সিআইএ তাঁকে উৎখাতের চেষ্টা করছে। ১৯৭৩ সালে দিল্লিতে এক ভোজ অনুষ্ঠানে ফিদেল কাস্ত্রোকে ইন্দিরা এ কথা বলেন। ইন্দিরা শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েককেও ‘কেজিবির জাল নথিপত্র’ সংযুক্ত করা এক চিঠিতে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ করেন। শ্রীমাভো তা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। ইন্দিরার জীবনীকার ও মার্কিন লেখক ক্যাথরিন ফ্রাঙ্কের বর্ণনায়, ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মকাল নাগাদ ইন্দিরার এই আশঙ্কা ‘একধরনের বিকারে রূপ নেয়’।

চীনা ফ্যাক্টর

মুজিব হত্যার অন্যতম মূল ষড়যন্ত্রকারী ফারুক ও রশীদ ১৯৭৫ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকায় মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে 
সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের লক্ষ্যে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ পাওয়া যাবে কি না, জানতে চান ফারুক। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার একটি তারবার্তা পাঠিয়ে ওয়াশিংটনকে জানান, ভারতকে ঠেকাতে চীন বা পাকিস্তান থেকে ‘পর্যাপ্ত সাহায্য’ মিলবে না ভেবে তারা এখন মার্কিন সামরিক সহায়তা চাইছে।

পরে (১৯৭৫ সালের ২০ নভেম্বর) ব্যাংককে, যখন ওই খুনি চক্র মার্কিন ভিসা পাওয়ার অপেক্ষা করছিল, ফারুক রহমান যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাকে বলেন, ‘ভারতকে প্রতিহত করতে সীমান্তে চীন নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেছে।’ মজার ব্যাপার হলো, ভারতীয় কর্মকর্তারা ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, যুদ্ধকালে তাঁরা একটি পশ্চিম পাকিস্তানি সাংকেতিক বার্তার অর্থ উদ্ধার করেন। এতে ইঙ্গিত ছিল যে ইয়াহিয়া সমুদ্রপথে এবং চীনের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত থেকে সামরিক সহায়তার আশা করছেন।

কিসিঞ্জার তাৎক্ষণিক জবাব দেন, ‘আমরা সেখানে ছিলাম না।’ ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার তাঁর বিখ্যাত গোপনীয় চীন সফরের পরে নিক্সনকে লেখেন, চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ মনে করেন ভারতই পূর্ব পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। চৌ ১৯৬২ সালে চীনের কাছে ভারতের পরাজয়ের কথা স্মরণ করে ইঙ্গিত দেন, এমনটা আবারও ঘটতে পারে। ক্রুশ্চেভ কী করে সীমান্ত সংঘাতে ভারতের কথায় বিশ্বাস করে প্রথমবারের মতো চীনবিরোধী বিবৃতি দিয়েছিলেন, চীনা নেতা সে কথাও কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন।

কিসিঞ্জার নিক্সনকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে মুজিবের ‘বাংলা দেশ’ না হতে দিতে চীন সামরিকভাবে ইয়াহিয়ার পাশে দাঁড়াতে 
পারে, কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেনি। কিসিঞ্জার লিখেছিলেন, ‘চীনের প্রতি ভারতের বৈরিতা স্পষ্ট হয়েছে। আবার পাকিস্তানের জন্য চীনের উষ্ণ বন্ধুত্বের ব্যাপারটাও একটা নির্ভরযোগ্য ও স্পষ্ট ব্যাপার। চৌ এন লাই হয়তো আরেকটা বিষয় বোঝাতে চাইছেন যে যারা চীনের পাশে দাঁড়াবে এবং কথা রাখবে, তারা প্রতিদান পাবে।’

চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ বাংলাদেশ ও মোশতাক সরকারকে আগস্টের ওই অভ্যুত্থানের পরপরই স্বীকৃতি দেন এবং অক্টোবরে কূটনৈতিক মিশন চালু করার ঘোষণা দেন।

 

SUMMARY

111-1.jpg