বঙ্গবন্ধু আমাদের সকল স্বপ্নের নায়ক
নির্মলেন্দু গুণ
ব ঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচির সমর্থনে আমি কবিতা লিখতে শুরু করি সেই ১৯৬৬ সাল থেকেই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার যে উন্মেষ ঘটে— তার ভিতর দিয়ে আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় স্বাধিকার বা স্বাধীনতা-চেতনার বোধ, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার বোধ। শোষণমুক্ত পূর্ব বাংলা গঠনের যে স্বপ্ন তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন, সেই ছয় দফার কারণেই ২১ ফেব্রুয়ারির পুনর্জন্ম হয়। মাঝখানে কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারির স্রোত একটু শ্লথ হয়ে আসছিল। ছয় দফা কর্মসূচিটি ঘোষিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুরকে গ্রেফতার করা হয়, আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর এদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেসব ইতিহাস আমার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার কণ্ঠস্বর’ বইতে লিখেছি। সাহসের উত্স যদি বলতে হয়, তাহলে বলা যায়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন আমাদের সকল সাহসের উত্স।
১৯৬৭ সালে তাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখি, তিনি তখন কারাগারে ছিলেন। কারাগারে ওই কবিতাটি তাঁর হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল এবং তিনি কবিতাটি পড়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। আগেই বলেছি তিনি আমার কবিতা লেখার সাহসের উত্স; এমনকি আমার কবিতার নায়কও তিনি। পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মকেন্দ্রিক, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকে ভেঙে নতুন রাষ্ট্র তৈরির যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা আমার প্রধান প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা শেখ মুজিবের খুব প্রিয় ছিল, বক্তৃতায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলতেন। ১৯৬৮ সালে যখন পাকিস্তান সরকার রেডিও এবং টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে তিনি তখন তার বিরোধিতা করেন। ১৯৬৪ সালে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো তখন তিনি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। পাকিস্তানের অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর যে দৃঢ় অবস্থান, এই অবস্থানকে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে, আমি প্রাণ থেকে তাঁকে সমর্থন করেছিলাম। তখন সংখ্যালঘু হিসেবে আমি তো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার ছিলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে মুক্তির সন্ধান পেয়েছি, তাঁকে আশ্রয় করে আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেছি। সাম্প্রদায়িক কারণে আমাদের সাত পুরুষের ভিটে ফেলে এসে ভারতের গলগ্রহ হব— এটা আমার কাম্য ছিল না।
১৯৭১-এও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি কবিতা লিখেছি। আমার হুলিয়া কবিতার মধ্যে আমাদের সকল দুঃস্বপ্নের বিপরীতে তিনিই হয়েছেন আমাদের সকল স্বপ্নের নায়ক। মুক্তির মোহনায় তিনিই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি কবিতা লিখলাম এবং লিখলাম না শুধু ১৯৭৭ সালে একুশের ভোরে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সেটি পাঠ করে শোনালামও। ঘটনাটিকে সেইদিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। ওটা হঠাত্ করে একটা কবিতা লিখে ফেলার মতো বিচ্ছিন্ন আবেগের ব্যাপার ছিল না। তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ওটাই ছিল প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম। তখন শেখ মুজিবের নাম বাংলাদেশে প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাঁর শিশু-পুত্র রাসেল এবং অন্তঃসত্ত্বা আরজু মণিসহ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল— এরকম বর্বরতা ছিল মানব জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে অকল্পনীয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যা ঘটেছে, এরকম বর্বর ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর অনুগত চার জাতীয় নেতা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেমন— সৈয়দ নজরুল ইসলাম যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান এই চারজন সেই মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি যা খুনিদের সঙ্গে আপস করে মোস্তাকের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। তাঁদেরকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটি পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের পটভূমিতে নভেম্বরের ৩ তারিখ ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে ঢুকে এই চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাগুলো পরপর ঘটতে থাকে। সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমিই প্রথম তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাটি প্রকাশ্যে পড়ি। কবিতাটি লিখেছিলাম আগেই। কিন্তু সেটি পড়বার কোনো সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলই আমাকে তাদের প্ল্যাটফর্মে কবিতাটি পড়তে দিচ্ছিল না। তখন আওয়ামী লীগও অসংগঠিত হয়ে গিয়েছিল। তাদের নেতারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, অনেকেই কারাগারে ছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগের কোনো প্ল্যাটফর্মে সেই কবিতাটি পড়ার সুযোগ হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাশনাল পার্টি তাদের কোনো অনুষ্ঠানে কবিতাটি পড়া অনুমোদন করেনি, তারা ভেবেছিল এটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করবে। সামরিক শক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পত্রপত্রিকাগুলোও ওরকম কবিতা ছাপার সাহস দেখাতে পারেনি। এইরকম শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিবেশে আমি ২১ ফেব্রুয়ারিকে বেছে নিয়েছিলাম শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা কবিতাটি পাঠ করার জন্য—
‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’— এই কবিতাটি পাঠ করলাম— ‘শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।/ আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’
অনেক আঁকাবাঁকা পথের মধ্যদিয়ে আমরা চেষ্টা করছি এগিয়ে যেতে। শুধু বঙ্গবন্ধুকেই তো হত্যা করা হয়নি, এখানে যেমন মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে বা ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের হত্যার ভিতর দিয়ে সংবিধানের পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সংবিধানকেও হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের সংবিধানের যে মূল চারটি স্তম্ভ ছিল যেটা মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পর ১৯৭২ সালে যে বাংলাদেশ গঠিত হলে তখন যে সংবিধান লিখিত হলো তার মধ্যে চারটি মৌলিক আদর্শ ছিল— জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই চার স্তম্ভ বিশিষ্ট সংবিধানকে পাল্টে ফেলা হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠনের সুযোগ পায় তখন এই অধ্যায়টি রদ করা হয় এবং শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও সম্পন্ন হয়।
লেখক :বরেণ্য কবি