কবিতায় বঙ্গবন্ধু


মাসুদুজ্জামান  

‘আজ পনেরো আগস্ট, আজ বাঙালির শোক।/অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটাও আজ নত হোক’—এই উচ্চারণ শুধু একজন কবির নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের। হৃদয়মথিত এ কথাগুলোর মধ্যেই ধরা আছে অবিনাশী এক মহানায়কের প্রতিকৃতি। কে এই মহানায়ক? যে মানুষটির আত্মা ও অস্তিত্ব, জীবন ও দেহাবশেষ মিশে আছে এ দেশের প্রতিটি ধূলিকণা, মেঘ-বৃষ্টি, বৃক্ষ-জনপদ ও মানুষের সঙ্গে, তাঁর কথা আমাদের কারোরই অজানা নেই। কেননা তিনিই তো বাংলাদেশের অন্য নাম, শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই তো আমার সত্তায় ও সংরাগে, অহং ও অস্তিত্বে, আত্মপরিচয় ও অভীপ্সায় মিশে আছেন, জড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায় পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে, আবেগের সঙ্গে যে এই মহানায়কের নাম উচ্চারিত হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।


এই লেখাটি শুরু করেছিলাম মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘পনেরো আগস্ট’ শীর্ষক কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে। ওই কবিতায়ই আরো বিস্তৃতভাবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে কিভাবে একটি জাতির জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন অনার্য বাঙালি জাতির প্রতীক : ‘আজি কি কেবলি ছবি, তুলির স্বীকৃতি?/তুমি জন্ম বাঙালির জাতি প্রতিকৃতি।/কে বলেছিলে না তুমি দিবস বিভায়?/তুমি চির বাঙালির আলোক প্রতীকে/আনার্যের কৃষিযোগ্য জমিনে ও বুকে।’ সর্বকালের এই শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে, যিনি আমাদের আত্মপরিচয় নির্মাণ করে দিয়েছেন, তাঁকে ভুলে যাওয়া মানেই নিজেকে ভুলে যাওয়া, নিজের আত্মপরিচয়কে ভুলে যাওয়া। এ কারণেই শুধু তাঁর মহাপ্রয়াণের দিনে নয়, বারবার তিনি আমাদের আত্মমথিত উচ্চারণে উঠে এসেছেন। বাংলাদেশের অসংখ্য কবি নানাভাবে তাঁর কথা বলেছেন। একটি উদ্ধৃতি দিই : ‘তোমাকে হারাতে পারি না এখনও/হে নায়ক, তুমি চলে যেতে পারো না।/এমনি হঠাৎ হুট করে তুমি/চলে যাবে, ছিলো এমন কী তাড়না?/তোমাকে ছাড়তে পারি না এখনও,/হয়নি সময় তোমার যাওয়ার,/এখনও তোমার কাছে আমাদের/বাকি আছে ঢের চাওয়া পাওয়ার।’ বাস্তবে মহানায়ক অনুপস্থিত, তবু তাঁর কাছেই সমস্ত আর্তি, যা কিছু আমরা পেতে পারি, তিনিই তা দিতে পারেন। আমাদের জীবনযাপনে ও সত্তায় তিনি কতটা মিশে আছেন, বর্ষীয়ান প্রয়াত কবির মধ্যেও ঘনিয়ে উঠেছিল এই আবেগ।

শামসুর রাহমান, বাংলাদেশের কবি শিরোমণি, তিনিও শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাবকে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও পতাকার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে নিজের আত্মসত্তাকে উপলব্ধি করেছেন : ‘ধন্য সেই পুরুষ নদীর সাঁতার পানি থেকে উঠে আসে/সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;/ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে/প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়/ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।/ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মতো/দুলতে থাকে স্বাধীনতা,/ধন্য সেই পুরুষ যার নামের ওপর ঝরে/মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’ শামসুর রাহমানের এই কবিতায় বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব অভিন্ন হয়ে গেছেন। নদীর সাঁতার শেষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যিনি প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায় নেমে আসেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁকে উদ্দেশ্য করে এ রকম কবিতাই তো লিখবেন বাংলাদেশের কবিরা। প্রকৃতির এই সর্বান্বয়ী রূপ, যে রূপের মধ্যে শেখ মুজিবকে প্রাণময় করে তোলা হলো, এর মধ্য দিয়েই শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ অভিন্ন হয়ে উঠেছে।

বিপরীত ভাবচ্ছবিও আছে, কবিরা শুধু শেখ মুজিবকেই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে মহিমান্বিত করেননি, প্রকৃতিও তাঁর গুণপনাকে ধারণ করে প্রতিরোধে প্রতিশোধে ফুঁসে ওঠে : ‘আগস্টের পনর তারিখ উনিশ পঁচাত্তর/অতর্কিত শিকারীর পদশব্দে অরণ্য শঙ্কিত/বাদুড়ের ডানার ঝাপটায় গজারীর মৃত পাতা/খসে পড়ে, বানরের গোপন সংকেতে সচকিত/...ব্যাঘ্রের দু’চোখ বিদ্ধ সার্চলাইটে, হটে না এগোয়,/আহত প্রচণ্ড ক্ষোভ আলোর চাতুর্যে মানবিক/ছলনায়, শাসায় মৃত্যুকে, জানে এই বেঁচে থাকা,/শিকারীর আক্রমণে অরণ্য শঙ্কিত অযথাই,/দীর্ঘদেহী গরান শাল অতন্ত্র সেগুন/পাহারায়, নিজস্ব শাবকগুলো দুঃখে আঁচড়ায়/নখ, ফুঁসে প্রমত্ত গর্জনে সাড়া তুলবে অকস্মাৎ/বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ এই বর্ণনা, মহানায়কের মৃত্যুকালীন নৃশংস বর্ণনা। মানুষ নয়, এই বর্ণনায় ওই হত্যাকাণ্ডের মুহূর্তে প্রকৃতিতে কী প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল, তারই উল্লেখ পাচ্ছি। বাদুড়ের ডানার ঝাপটায় গজারির মৃত পাতা খসে পড়ে, বাঘ পিছু হটে না, গরান, শাল, সেগুন পাহারায়, প্রমত্ত গর্জনে শাবকেরা ফুঁসে ওঠে। একজন মানুষের মৃত্যুতে কবিসত্তার এই যে সর্বত্রচারিতা. গভীর অনুভব, তা শুধু শেখ মুজিবের মতো মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলেই বাংলাদেশের কবিদের পক্ষে ভাবা সম্ভব হয়েছিল।

এ ভাবনা থেকেই উৎসারিত আরেকটি চমৎকার কবিতা রফিক আজাদের ‘এই সিঁড়ি’। বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে নিহত হলেও তাঁর ছায়া বাংলাদেশের মানচিত্রকে ঢেকে দিয়েছে, উর্বর হয়েছে এ দেশের মাটি, সবুজ হয়েছে শস্যক্ষেত্র : ‘তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে/সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ/তার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে/মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে/তার রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে।/এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে/স্বপ্নের স্বদেশ ছেপে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।’ আগেই বলেছি, শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ কবিদের ভাবনায় অভিন্ন হয়ে উঠেছিল।


বাঙালি জাতির ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুকে ঘিরেই সবচেয়ে মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। এর অভিঘাত সমকালীন কবিদের মনকে যেমন বিষণ্ন করে তুলেছে, বেদনার্ত করেছে, তেমনি তাঁর অনুপস্থিতির অভাবও তীব্রভাবে অনুভব করেছেন তাঁরা। মহাদেব সাহা লিখেছেন, ‘তুমি কি আসবে না আর এই দগ্ধ বিরান ভূমিতে/তোমার অভাবে দেখো এই দেশ বিপন্ন কেমন,/কেমন মলিন দেখো তোমার অভাবে স্বাধীনতা।/তুমি নেই বলে তাকে অমর্যাদা প্রকাশেরও/কেউ কেউ দেখায় ধৃষ্টতা যেন বা অনাথ শিশু এই স্বাধীনতা।’ শেখ মুজিব শুধু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, সব ধরনের সংকট থেকে তিনিই জাতির মুক্তি সম্ভব করে তুলতে পারতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকট দেখা দিয়েছে, এ রকমটাই বলেছেন মহাদেব সাহা : ‘তুমি নেই বলে তাই—/জয় বাংলা নিষিদ্ধ এখানে/মুজিব তোমার দেখো দুঃসহ অভাবে এই স্বাধীনতা/পায় না মাটির গন্ধ/তুমি কি আসবে না তবু এই দগ্ধ ব্যথিত বাংলায়?/যদি বা না আসো বলো কোথায় থাকবে তুমি,/তোমার শরীর দেখি ছেয়ে আছে/এ দেশের প্রতি ইঞ্চি স্বপ্ন আর মাটি।’ মহাদেব সাহার ভাবনায় শেখ মুজিব এভাবেই হয়ে উঠেছেন অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নের প্রতীক। যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন তত দিন এই স্বপ্ন দেখেছে বাংলাদেশ।

সৈয়দ শামসুল হকও ভেবেছেন রাজনীতির এই মহানায়কের নৃশংস হত্যার কারণে প্রতিটি মানুষ আজ বিপন্ন। বেঁচে থেকেও তারা মৃত, জীবদ্দশাতেই তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে : ‘পিতা তোমার কথা এখন কেউ এখানে আর বলে না,/তোমার পালঙ্কে এখন কত বিশাল বলে মনে হয় এ বাড়ির/মানুষের কাছে, পিতা, সেখানে কেউ স্বপ্ন দেখবার জন্যে পূর্ণিমায় আর শুয়ে পড়ে না, বসে যাচ্ছে মাটি,/পিতা তোমার পুত্ররা জানে না—তাদের পায়ের কাছে গর্ত করছে/ইঁদুর এবং তাদেরই জীবদ্দশায়, তারা জানে না/পিতা, একটি জীবনের শেষে বিদায় নিয়েছিলে তুমি, হোক না তা/অকস্মাৎ, আর তোমার পুত্ররা তো বিদায় নিচ্ছে/তাদের এই জীবদ্দশাতেই।’ মুজিবের মৃত্যুতে বাংলাদেশের মানুষ যে কতটা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, এ হলো সেই ছবি।


পনেরোই আগস্টের ঘটনা শুধু সামান্য একটা ঘটনা নয়, এর একটা সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক অভিঘাত লেগেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। শেখ মুজিবকে ঘিরে রচিত হয়েছে অনবদ্য কবিতা। তিনিই যে বাঙালির মহানায়ক, বাঙালির মুক্তিদাতা, কবিদের লেখাতেও এর চমৎকার প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে একে নতুন সংযোজন বলা যায় নিঃসন্দেহে। বাংলা সাহিত্য এর দ্বারা সমৃদ্ধও হয়েছে। আজ এই মহানায়কের মহাপ্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি জ্ঞাপন করছি অতল শ্রদ্ধা।

SUMMARY

1096-1.jpeg