বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতার কথা


১৭ মার্চ… বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। বাঙালীর স্মরণীয় দিন। এই দিন আমার ব্যাক্তিগত জীবনেও বিশেষ দিন। আমাকে নিয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতার কথাই এখানে বলবো।
ব্যক্তিত্বকে নিয়ে সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা রচনার বিষয়টা অহরহই চোখে পড়ে। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতার সংখ্যা অতুলণীয়ভাবে বেশি। সংখ্যা বেশির চেয়েও মানোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা অনেক এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কবিতা রচনায় সফলতা দেখিয়েছেন শামসুর রাহমান। তিনি মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে লিখেন বিখ্যাত কবিতা ‘সফেদ পাঞ্চাবি’ এবং আসাদকে নিয়ে লিখেন আসাদের শার্ট। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও অনেকগুলো ভাল কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কাবিতা ছড়া নিয়ে কয়েকটি সংকলিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বেবী মওদুদ সম্পাদনা করেন একটি সংকলন। এছাড়া বিশাকা প্রকাশণ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মুজিব মঙ্গল’ নামে ২২ কবির কবিতা সম্বলিত একটি কাব্য সংকলন। নামটি ২২ কবির মনসা মঙ্গল হতে নেয়া হয়েছিল। কবি ও প্রাবন্ধিক সুমন্ত রায় গত বই মেলায় প্রকাশ করেছেন ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামক একটি সংকলিত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন কবি, ‘প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও রাজনীতিবীদ নূহ- উল- আলম লেনিন। তিনি লিখেছেন, আসলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা/ছড়া রচিত হলেও সেসব কবিতার একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহের অভাব বঙ্গবন্ধুভক্ত মাত্রই অনুভব করেন। তবে এই অভাব পূরণের ব্যাপারটিও রয়ে গেছে শর্ত সাপেক্ষে। বলাবাহুল্য আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিল্পরসোত্তীর্ণ কবিতার কথা বলছি। যে কবিতা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে রচিত ও শ্লোগানধর্মী, তার আয়ুষ্কাল সীমিত। পক্ষান্তরে শিল্পের দাবী মিটিয়ে যেসব কবিতা সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়, সেসব কবিতা কালের বিবর্তনে ক্লাসিকসের পর্যায়ে উন্নীত হয়।’ জনাব লেনিন ঠিকই বলেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো বছাই করা সহজ নয়। একজনের প্রিয়তর কবিতাটি অন্যজনের পছন্দ নাও হতে পারে। কেউ শ্লোগানধর্মী কবিতা পছন্দ করেন, কেউ ছন্দবদ্ধ। সাধারণ পাঠকরা ভাল কবিতা ও খারাপ কবিতা বুঝতে পারেন না। কবিতার গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হলে, ভাষা সম্পর্কেও ভাল ধারণা থাকতে হয়, বহু শব্দ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। অনেক লেখকের কাছে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা চাইতে গেলে বলে দেন, পড়ে দেখ, শ্রেষ্ঠটি পেয়ে যাবে। আবার কবিতা চেয়ে পাওয়ার পরে মনে হল, এটি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পেতে পারে না তখন সম্পদককে নির্মম হতে হয়। এই নির্মম হওয়াটা অনেক ঝুঁকিও বহন করে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো সম্পর্কে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অনেকগুলো মানোত্তীর্ণ কবিতা এসবস্থানে ঠাই পেয়েছে। এইসব সংকলনে স্থানপাওয়া কয়েকটি কবিতা নিয়ে এখানে আলোচনা করবো।
অন্নদা শংকর রায়ের লেখা কবিতা- যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরি যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান। এই কবিতাটি অন্যতম পঠিত সন্দেহ নেই। অন্নদা শংকর রায়ের ৮ লাইনের ছোট কবিতাটিতে আছে দুটি কথা: একটি হল বঙ্গবন্ধুর কীর্তি চিরদিন টিকে থাকবে এবং অন্যটি মুজিব ভক্তদের সাহস দিয়ে বলেছেন, নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়। আবার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ‘র ’আমি কিংবদন্তীর কথা ব’লছি’র মতো দীর্ঘ কবিতা রয়েছে। এই কবিতায় তিনি লিখেছেন: আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/ আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি।/ তাঁর করতলে পরিমাটির সৌরভ ছিল/ তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল। তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন/ অরণ্য এবং শ্বাপদেও কথা বলতেন/ পতিত জমি আবাদেও কথা বলতেন/ তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আকর্ষণীয় ও আবৃত্তিতে অতুলনীয় কয়েকটি কবিতা লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ। তার কবিতা স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো এবং আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি কবিতা দুটি ছাড়া কোন সংকলনের কথা ভাবা যায় না। গুণের কবিতা দুটি বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণের উপর লেখা। প্রথম কবিতায় তিনি লিখেছেন-
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মধ্যে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিত জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি নূহউল আলম লেনিন অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। নূহ-উল-আলম লেনিন তার ‘আমরা আজ আর শোক করবো না’ কবিতায় লিখেছেন- আমরা আজ আর শোক করবো না/ আমাদের শোক এখন শক্তির দ্যোতনা।/ ওরা বলেছিল কেউ তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না/ ওদের দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। কবি এখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় নিয়ে চূড়ান্ত কথাটি বলেছেন।
মহাদেব সাহা তার ‘সেই দিনটি কেমন ছিলো’ কবিতায় লিখেছেন: সেদিন কেমন ছিলো- ১৫ই আগস্টের এসই ভোর/ সেই রাত্রির বুকচেরা আমাদের প্রথম সকাল/ সেদিন কিছুই ঠিক এমন ছিলো না/ সেই প্রত্যুষের সূর্যোদয় গিয়েছিলো/ সহস্র যুগের কালো অন্ধকারে ঢেকে,/ কোটি কোটি চন্দ্রভুক অমাবস্যা তাকে গ্রাস করেছিলো,/ রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিলো সেই অভিশপ্ত দিন। ১৫ আগস্ট কালোরাত নিয়ে লেখা এটিই সম্ভবত এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ লেখা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক লিখেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ‘আমার পরিচয়’ নামের কবিতায় লিখেছেন: এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/ যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/ তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-/ চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি। এই কবিতার একটি লাইন আবারো লিখি: ‘যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান’ অর্থাৎ এই প্রেরণাতেই কবি পথ চলেছেন।
ছোটদেও জন্যও অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। প্রধান কবিরাও লিখেছেন। শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘অমর নাম’ নামে একটি ছড়া: গাছের পাতা ধুলিকণা/ বলছে অবিরাম,/ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর’/ অমর তোমার নাম। লুৎফর রহমান রিটন লিখেছেন, নাম লিখে রাখলাম: ফরিদপুরের অখ্যাত এক/ টুঙ্গিপাড়া গ্রাম/ ইতিহাসে টুঙ্গিপাড়ার / নাম লিখে রাখলাম। ‘সেই ছেলেটি’ নামের এই লেখকের নিজের লেখা একটি ছড়াও উল্লেখ করছি: দেখতে দেখতে সেই ছেলেটি/ বদলে দিল একটি জাতির চেতনা/ টুংগীপাড়ার সেই ছেলেটি না জন্মালে/ একটি জাতি স্বাধীনতাই পেত না।
আমাদের স্বাধীনতা নিয়েও যেমন কয়েকটি অমর কবিতা রচিত হয়েছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও রচিত হয়েছে অনেকগুলো অসাধারণ অমর কবিতা। বঙ্গবন্ধুকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাগুলোর সাহিত্যমূল্যও অনেক।
বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে লেখা কবিতার সঙ্কলন
ইয়াসির আজিজ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অসংখ্যজন অগণিত সংখ্যক লেখা লিখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই মহানায়কের মূল্যায়ন মহাকালব্যাপী ধ্বনিত হবে। বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে, শ্রদ্ধা করে, স্মরণ করে কবিতাও কম লেখা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ ‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’, সম্পাদনা করেছেন প্রত্যয় জসীম, প্রকাশিত হয়েছে একুশের বইমেলা ২০১০-এ। এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সম্পাদকের সযত্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। স্বল্প পরিসরে একটি বইতে অধিকসংখ্যক গুরম্নত্বপূর্ণ কবির কবিতা স্থান দিতে পারাটাই হচ্ছে সম্পাদকের কৃতিত্ব। মোট ৮৫ জন কবির কবিতা রয়েছে গ্রন্থটিতে। কবিতাগুলো এসেছে কবিগণের নামের বর্ণনানুক্রম অনুসারে। প্রথমেই রয়েছে কবি অন্নদাশংকর রায়ের কবিতার প্রথম চার লাইন, যা বিখ্যাত হয়ে আছে_
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।’
এখানে একটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলাদেশের নদীগুলোর বর্তমান অবস্থান আজ ভাল নয়_ যার প্রধান কারণ ভারত কতর্ৃক উজানে বাঁধ নিমর্াণ। কিন্তু ভারতেই কবির কামনায় ধ্বনিত হয়েছে এইসব নদীর ধারা অননত্মকাল ধরে বহমান থাকবে আর উচ্চারিত হবে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের নাম। কবি অন্নদাশংকর রায় সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরে লিখেছেন এই কবিতার শেষ চারটি লাইন_
‘দিকে দিকে আজ অশ্রম্নুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।’
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতার পাশাপাশি তরম্নণ কবিদের কবিতাও জায়গা পেয়েছে এই বইয়ে।
কবি শামসুর রাহমান এর কবিতা ‘ধন্য সেই পুরম্নষ’-এর শেষ চারটি লাইন_
ধন্য সেই পুরম্নষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো/ দুলতে থাকে স্বাধীনতা/ধন্য সেই পুরম্নষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’ শহীদ কাদরীর কবিতার নাম ‘হনত্মারকদের প্রতি’, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার নাম ‘আমার পরিচয়’, নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন ‘শেখ মুজিব : ১৯৭১’, রফিক আজাদের কবিতা ‘পাঠ্যবইয়ে যে কথা নেই’, মহাদেব সাহা লিখেছেন ‘এই নাম স্বতোৎসারিত হোক’, মুহম্মদ নূরম্নল হুদার কবিতা ‘পনেরো আগস্ট’, আসাদ চৌধুরী লিখেছেন ‘ দিয়েছিলে অসীম আকাশ’, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছেন ‘কোন ছবিগুলি’ এবং কাজী রোজী লিখেছেন ‘স্মৃতি জাদুঘর’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রয়াত বিখ্যাত কবিদের মধ্যে রয়েছেন কবি জসীমউদ্দীন, কবি সুফিয়া কামাল, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ প্রমুখ। এ প্রজন্মের কবিদের মধ্যে আছেন আবু হাসান শাহরিয়ার, কামাল চৌধুরী, গাজী রফিক, আমিনুল ইসলাম, প্রত্যয় জসীম, মুজিব ইরম, হাসান আল আব্দুলস্নাহ, তারিক সুজাত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বদরম্নল হায়দার এবং আরও অনেকে।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘শোনো একটি মুজিবুরের থেকে’ কবিতাটি গান হিসেবে বাঙালীর হৃদয়ে আজও ধ্বনিত হয়_ ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ্য মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে উঠে রণি।/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’
বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে কবিরা যে সমসত্ম কবিতা লিখেছেন তার বেশিরভাগই প্রাণের আবেগ দিয়ে লেখা শ্রদ্ধার্ঘ। বাংলার কবিরা কবিতায় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে বীরত্বের ইতিহাস লিখেননি, লিখলে তা মহাকাব্যের চরিত্র ধারণ করতে পারত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা উপন্যাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাই, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের আশা-নিরাশার কথা পাই। সেসব লেখা বিসত্মৃত পটভূমি তৈরি করে আমাদেরকে সেই সময়ের কাছে নিয়ে যায় সত্য, কিন্তু এই সব কবিতার মতো করে প্রাণের গভীরে বেজে ওঠে না। একমাত্র কবিতাই কান্না-হাসি হয়ে হৃদয়কে দোলায়িত করতে পারে। কবিতার ছন্দে-সুরে যেভাবে আবেগ ক্রিয়া করে সেভাবে অন্য কোন মাধ্যম পারে না।
দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু সঙ্কলন গ্রন্থটি পাঠক সংগ্রহে রাখতে পারেন,
ইতিহাসের মহানায়ককে নিবেদন করে বাংলা ভাষার কবিদের উচ্চারণের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন।
‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ করেছেন নাসিম আহমেদ। ১১২ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য ১২০ টাকা।
কবিতাঃ বংগবন্ধু এবং অন্যান্য
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি |
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের ম
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।
তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।
তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।
আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে বাংলাদেশের কবিরা এযাবৎ কত প্রশস্তি রচনা করেছেন তার কোনো হিসেব নেই। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন আজ থেকে একত্রিশ বছর আগে। যখন বেঁচে ছিলেন, বাংলার মানুষ তাঁকে বসিয়েছিল হৃদয়ের সিংহাসনে। এরপর এ দেশে অনেক বিপরীত স্রোত বয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে। সবই ব্যর্থ হয়েছে। তাঁকে মানুষের হৃদয়ের সিংহাসন থেকে যে টেনে নামানো যায় নি, তারই এক অনবদ্য প্রমাণ ও প্রকাশ এই কবিতাগুচ্ছ। এই কবিতাগুচ্ছে সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি- বাংলাদেশের ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডির নায়কের প্রতি ব্যথিত মনের উচ্ছ্বাস। আর সেই সঙ্গে একটি প্রত্যয়ের ঘোষণা, মুজিবের মৃত্যু নেই। আমার বিস্ময় এখানেই যে দেশের যে প্রজন্ম তাঁকে কখনো দেখেনি, তাঁর কণ্ঠস্বর শোনেনি, সেই প্রজন্মের কবিকুল কেমন সহজে তাঁকে চিনেছে, তাঁর উচ্চতা, তাঁর বিশালতা উপলব্ধি করেছে এবং কেমন মুগ্ধতায় তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে। এই হৃদয়বান পুরুষটি যে নিজেও দেশের হৃদয় জয় করেছেন, যেন এর চেয়ে সহজ সত্য আর হয় না। আমি এই কবিতাগুচ্ছকে বরণ করছি, আর কোনো কারণে নয়। বঙ্গবন্ধু মুজিব যে এখনো, স্বদেশে ও প্রবাসে, সকল বাঙালির প্রাণের সম্রাট, এই সত্যটির এক প্রবল ও আত্তÍরিক উচ্চারণ, এই বিবেচনায়। কবির ব্যক্তিগত আবেগের স্বর এক সম্মিলিত সুর-মূর্ছনায় পরিণত হয়েছে। মুজিবের মৃত্যু নেই। কবিতার মৃত্যু নেই ।
স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো
নির্মলেন্দু গুণ
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি, মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ…।
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, – এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?, ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত

SUMMARY

1095-1.jpeg